গ্রীক দেব-দেবীদের রাণী: হেরা

2

বিয়ে, পরিবার ও সন্তান জন্মদানের দেবী হেরা গ্রীক পুরাণে উল্লেখিত সকল দেব-দেবীদের রাণী। আদর্শ নারীর প্রতিরূপ হিসেবে স্বীকৃত হেরা ছিলেন দেবরাজ জিউস এর বোন ও স্ত্রী। হেরার সবচেয়ে বেশি পরিচিতি মূলত তার প্রতিহিংসা পরায়ণতা ও প্রতিশোধ স্পৃহার কারণে। তার এই স্বভাবের লক্ষ্যবস্তু ছিলো মূলত তার স্বামী জিউসের প্রনয়ীনীগন ও তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানেরা। তবে জিউস এর বহুগামীতার কথা হেরার জানা থাকলেও সে সব সময় স্বামীর প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত ছিলো। এমনকি খুব অল্প সংখ্যক যে কয়জন দেব দেবী নিজের সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলো হেরা তাদের মধ্যে একজন।

হেরার জন্ম কাহিনীঃ  

হেরা ছিলো সর্ব কনিষ্ঠ টাইটান ক্রোনাস এবং রিয়ার সন্তান। ফলে সে ছিলো জিউস এর বড় বোন। কারণ জিউস হচ্ছে ক্রোনাস ও রিয়ার সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। ঐ সময় মহাজগতের অধিকর্তা ছিলো ক্রোনাস। কিন্তু ভবিষ্যতবাণী করা হয় যে ক্রোনাস এর কোন এক সন্তান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।

ফলে সিংহাসন হারানোর ভয়ে যখনি রিয়ার গর্ভে কোন সন্তান জন্ম নিত ক্রোনাস তাকে গিলে ফেলতো এবং তাকে পেটের মধ্যে কয়েদ করে রাখতো। এভাবে ক্রোনাস একে একে হেরা, হেসটিয়া, পোসেইডন, ডিমিটার ও হেডিস কে বন্দি করে রাখে। জীউস এরও হয়তো একই পরিণতি বরণ করতে হতো। কিন্তু জিউস এর জন্মের সাথে সাথেই তাকে ক্রীট নগরীতে লুকিয়ে রাখা হয় আর তার পরিবর্তে ক্রোনাস কে পাথরের টুকরো দেয়া হয় যা সে গিলে ফেলে।

হেরা
হেরা
Source: Pinterest

জিউস ধীরে ধীরে ক্রীট এ বড় হয় এবং ক্রোনাস কে হারিয়ে সে সবকিছু দখল করে নেয়। ক্রোনাস কে জিউস কোন একটি ঔষধের মিশ্রন খাইয়ে দেয় ফলে সে তার পেটের ভেতর থাকা সন্তানদের উগরে দেয়। তারপর তিন ভাই মিলে টাইটানদের হারিয়ে সবকিছু নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এর মাঝে এরা ওশেনাস এর তত্বাবধানে প্রাপ্ত বয়স্কা হয় এবং জিউস এর সাথে তার বিয়ে হয়।

রাণী হিসেবে অলিম্পাসে হেরার ভূমিকাঃ

হেরা ছিলো জিউস এর তৃতীয় স্ত্রী। কোকিল পাখির রূপ ধরে জিউস হেরাকে প্রলুব্ধ করে ও বিয়ে করে। বিয়ের পর হেরা হয়ে যায় মর্ত্যলোকের অধিকর্তা দেবরাজ জিউসের অর্ধাঙ্গিনী ও অলিম্পিয়ান দেব-দেবীদের রাণী। বিয়ের সময় হেরা উপহার হিসেবে গায়ার(পৃথিবী)নিকট থেকে একটি বাগান পায় যেখানে সোনার আপেল ফলে।

হেরা ও জিউস
হেরা ও জিউস source: Pinterest

হেরা মূলত জিউস এর উপদেষ্টা ছিলো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সে জিউস কে উপদেশ ও পথ নির্দেশনা দিতো।একবার মতের অমিল হওয়ায় হেরা, অ্যাথেনা ও পোসেইডন মিলে জিউস কে বন্দি করার চেষ্টা করে কিন্তু থেটিস এর হস্তক্ষেপে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

সন্তান জন্মদান, বিয়ে ও পরিবারের দেবী হিসেবে তার উপাসনা করা হয়। শোনা যায় যে প্রতি বছর হেরা যখন ক্যানাথাস ঝর্ণায় গোসল করে, সে তার কুমারিত্ব ফিরে পায়।

হেরার সন্তানেরাঃ

হেরার গর্ভে জিউস এর তিন সন্তানের জন্ম হয়; এরিস (যুদ্ধের দেবতা), এলিথিয়া(সন্তান জন্মদানের দেবী)ও হিবি(তারুণ্যের দেবী)। এছাড়াও হেরা হেফায়েস্টাস(ধাতু কর্মী দেবতা)এর জন্ম দেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে জিউস এর কোন ভূমিকা ছিলোনা। শোনা যায় যে, জিউস যখন এথেনাকে জন্ম দেয় তখন হেরা খুব রাগান্বিত হয়। রাগ করে সে তার হাত দিয়ে মাটিতে আঘাত করার ফলে হেফায়েস্টাস এর জন্ম হয়।

হেফায়েস্টাস পঙ্গু হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। ফলে তার কুৎসিত শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্য হেরা তাকে অলিম্পাস পর্বত থেকে পৃথিবীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। হেফায়েস্টাস মায়ের এই আচরণের প্রতিশোধ নিতে একটি জাদুর সিংহাসন তৈরি করে এবং হেরা কে এতে বন্দি করে ফেলে। সে হেরাকে তখনি মুক্তি দেয় যখন হেরা হেফায়েস্টাস এর নিকট প্রতিজ্ঞা করে যে প্রেমের দেবী অ্যাফ্রোদিতিকে তার সাথে বিয়ে দিবে।

হেরার প্রতিশোধ পরায়ণতাঃ  

হেরাকে প্রতিনিয়ত তার স্বামী জিউসের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে তৎক্ষণাৎ প্রতিশোধ নিয়েছে। শুধুমাত্র জিউস এর উপপত্নীরাই নয় বরং তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানেরাও হেরার ক্ষোভ থেকে রেহাই পায়নি। সে দোষীদের শাস্তি দিয়েছে কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার স্বামীর দ্বারা সম্মোহিত হওয়া নির্দোষরাও শাস্তি পেয়েছে।

ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হেরার মূর্তি
ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হেরার মূর্তি Image source: wikipedia

হারকিউলিস   হেরা

হেরার প্রতিশোধ পরায়ণতার সবচেয়ে বড় শিকার জিউস ও আল্কমিনির পুত্র হারকিউলিস। হারকিউলিস এর মা আল্কমিনি হেরার উপাসনা করতো এবং হেরার সম্মানেই সন্তানের নাম রাখেন হারকিউলিস যার অর্থ “সুপ্রসিদ্ধ হেরা”। কিন্তু তাতে হেরার প্রতিশোধ স্পৃহার পরিবর্তন ঘটেনি।  হেরা যখন জানতে পারে যে আল্কমিনির গর্ভে জিউস এর সন্তান সে আল্কমিনির পা দুটো জোড়া লাগিয়ে দেয় যাতে সে সন্তান জন্ম দিতে না পারে। এছাড়াও শিশু হারকিউলিস কে মারার জন্য হেরা দুটো সাপ পাঠায়, হারকিউলিসকে পাগল করে দেয় ও নিজের স্ত্রী সন্তানকে মারতে বাধ্য করে ও ইউরিসথিয়াস কে দিয়ে ১২টি শ্রমসাধ্য অভিযান এ পাঠায় যা এতো বিপদজনক ছিলো যে হেরা ভেবেছিলো হারকিউলিস মারা যাবে। হেরার কারণেই হারকিউলিসকে হাইড্রা, ড্রাগন ও সিংহের সাথে লড়াই করতে হয়।

হেরা   লেটো

হেরার ক্রোধের আরেকজন শিকার লেটো। লেটোকে হেরা এতোটাই শাস্তি দেয় যে গর্ভবতী অবস্থায় তাকে নিরাশ্রয় হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। কারণ হেরা ভূপৃষ্ঠের কোথাও তাকে সন্তান জন্মদানের অনুমতি দেয়নি। তারপর একমাস ঘুরে বেড়ানোর পর লেটো সমুদ্র দেবতা পোসেইডন এর সহায়তায় ডেলোস নামক ভাসমান দ্বীপে দেবতা অ্যাপোলোর জন্ম দেয়।এছাড়াও লেটোকে মারার জন্য হেরা অজগর কে পাঠায় যাকে হত্যা করে অ্যাপোলো তার মায়ের প্রাণ রক্ষা করে।

হেরা  ও আইও-

হেরাকে ঘিরে প্রচলিত কল্পকথা গুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হেরা, জিউস ও আইও এর কাহিনী। কোনো কোনো মতে, আরগোস এর রাজকুমারী আইও ছিলো হেরার মন্দিরের ধর্মযাজিকা। কিন্তু হেরা আইওকে গরুতে রূপান্তর করে দেন যাতে করে জিউস তার পিছু নেয়া বন্ধ করে। আবার কোনো মতে, জিউস নিজেই আইওকে একটি সাদা রঙের গরু বানিয়ে দেয় যাতে সে গোপনে আইও এর সাথে মিলিত হতে পারে অথবা হেরাকে বোঝাতে যে আইও এর প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু হেরা জিউস এর প্রণয় ধরে ফেলে এবং গরুটাকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে নেয়। তারপর হেরা একশত চোখওয়ালা জানোয়ার আরগোস কে নিযুক্ত করে গরুর পাহারাদার হিসেবে। জিউস তখন হারমিস কে পাঠায় আরগোস কে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে মেরে ফেলার জন্য। আরগোস এর স্মরণে হেরা তার একশত চোখ ময়ূর এর পালকে লাগিয়ে দেয় আর আইও কে সারা জীবন ধরে যন্ত্রণা দেয়ার জন্য ডাঁশমাছি কে পাঠায়।

জিউস ও আইও
জিউস ও আইও source: Wikipedia

এছাড়াও হেরার প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলো সিমিলি যাকে হেরা কুমন্ত্রণা দেয় যেন সে জিউসকে তার দেবতার রূপ ধারণ করে আসতে বলে। ফলে জিউস দেবতা রূপ ধারণ করা মাত্রই তার আলোকচ্ছটায় সিমিলি ধ্বংস হয়ে যায়। ক্যা্লিস্টো ছিলো জিউস এর আরও একজন প্রেমিকা যাকে হেরা ভালুক এ পরিণত করে দেয় এবং দেবী আর্টেমিস এর তীরের আঘাতে সে মারা যায়। জিউস পরবর্তীতে ক্যালিস্টকে একটি নক্ষত্রপুঞ্জে পরিণত করে দেয়।

পরিশেষে, দেবরাণী হেরার ক্রোধের আরও দুজন শিকার হচ্ছে ইক্সিয়ন ও টিটিয়স। হেরা কে প্রলুব্ধ করতে গিয়ে ইক্সিয়ন হেরার ক্রোধানলে পড়ে এবং শাস্তি হিসেবে তাকে পাতালপুরীর একটি ঘূর্ণায়মান চাকার সাথে বেঁধে দেয়া হয় যা সারা জীবন ধরে ঘুরতে থাকবে। একই কাজ করার ফলে হেরা টিতীয়স কে একটি পাথরের সাথে বেঁধে রাখে যেখানে প্রতিদিন একটি শকুন এসে তার কলিজা খেয়ে যায়।

ট্রয় যুদ্ধে হেরাঃ

ট্রয় যুদ্ধে শুরু থেকেই হেরা জড়িত ছিলও কারণ অ্যাফ্রোদিতি ও অ্যাথেনার সাথে “সবচেয়ে সুন্দরীর জন্য” লেখা সোনার আপেলের জন্য হেরাও একজন দাবিদার ছিলো। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস অ্যাফ্রোদিতিকে সেরা সুন্দরী নির্বাচিত করে এবং এতে হেরা রেগে যায়। ফলে ট্রয় যুদ্ধে হেরা গ্রীকদের সঙ্গ দেয়। ট্রয় যুদ্ধে হেরার হস্তক্ষেপের কারণেই মূলত ট্রোজানরা হেরে যায়। কারণ সে জিউস কে প্রতিজ্ঞা করায় যে সে যেন ট্রয় যুদ্ধে কোন পক্ষ না নেয় এবং কাউকে সাহায্য না করে।

সোনার আপেল নিয়ে প্যারিস এর সামনে হেরা, এথেনা ও আফ্রোদিতি
সোনার আপেল নিয়ে প্যারিস এর সামনে হেরা, এথেনা ও আফ্রোদিতি
source: Owlcation

প্রাচীন গ্রীসে হেরার উপাসনাঃ 

 প্রাচীন গ্রীসে ব্যাপক পরিসরে হেরার উপাসনা হতো। করিন্থ, ডেলোস, অলিম্পিয়া, পায়েসটাম, প্যারাকোরা, স্পারটা ও টাইরিয়ন্স এ হেরার উপাসনা মন্দির ছিলও। এছাড়াও সামোস এ নির্মিত “দ্য হেরাইয়ন” মন্দিরটি ছিলও গ্রীসের সর্ববৃহৎ মন্দির গুলোর একটি। আরগোস ও মাইসিন সহ প্রাচীন গ্রীসের অনেক নগরীর লোকজন হেরা কে তাদের নগরদেবী হিসেবে উপাসনা করতো। এমনকি দেবরাজ জিউস এর চেয়েও অনেক আগে থেকে গ্রীকরা হেরার উপাসনা করতো। ফলে, গ্রীসের সব প্রাচীন মন্দির গুলো হেরার নামে উৎসর্গ করা।এছাড়া প্রাচীন গ্রীসে হেরার সম্মানে মেয়েদের খেলাধুলার উৎসব ও হেরা ও জিউস এর বিয়ের আদলে বিয়ে উৎসব হতো।

রোমানদের নিকট হেরা বিয়ে ও পরিবারের দেবী জুনো নামে পরিচিত। জুপিটার ও মিনার্ভা এর পাশাপাশি রোমানদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দেব দেবীদের মধ্যে জুনো ছিল একজন।প্রাচীন রোমে জুনোর সম্মানে মাসব্যাপী “ম্যাট্রোনালিয়া” নামক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো এবং রোমান সংস্কৃতিতে এই সময়টা ছিলও বিয়ের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

Source Featured Image
Leave A Reply
2 Comments
  1. Xbofuc says

    purchase terbinafine – terbinafine canada purchase grifulvin v generic

  2. Wttqmr says

    generic semaglutide 14 mg – buy DDAVP spray DDAVP order

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More