অ্যাকিলিস ছিলেন গ্রীক পুরাণে উল্লেখিত একজন বীরযোদ্ধা ও ট্রয় যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। শক্তি, সামর্থ্য আর দ্রুত গতির কারণে সম্মুখ যুদ্ধে একিলিস ছিলো অদ্বিতীয়। অস্ত্র চালনায়ও সে ছিলো অনন্য সাধারণ, বিশেষ করে তলোয়ার চালনা ও বর্শা নিক্ষেপ এর ক্ষেত্রে সে ছিলো সুনিপুণ।
অ্যাকিলিস ছিলো জলদেবী থেটিস ও মারমিডন্স এর রাজা পেলেয়াস এর পুত্র। পুরাণে উল্লেখ রয়েছে যে গ্রীক দেবরাজ জিউস এবং সমুদ্র দেবতা পোসেইডন দুজনেই থেটিস এর পাণিপ্রার্থী ছিলেন। থেটিসকে কে বিয়ে করবে এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিলো। কিন্তু প্রমিথিউস ভবিষ্যতবাণী করলেন যে থেটিস এর ছেলে তার বাবার খ্যাতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। এই কথা শোনার পর জিউস এবং পোসেইডন দুজনেই থেটিসকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিল। ফলে পেলেয়াস এর সাথে থেটিস এর বিয়ে হয়ে গেলো এবং এই বিয়ের আসরেই ঝগড়ার দেবী এরিস কর্তৃক নিক্ষেপকৃত “সোনার আপেল” নিয়ে দেবরাণী হেরা, এথেনা ও অ্যাফ্রোদিতির মধ্যে ঝগড়া ও ট্রয় নগরী ধ্বংসের বীজ প্রোথিত হয়ে গিয়েছিলো। আর সেই সাথে নির্ধারিত হয়েছিলো মহাবীর অ্যাকিলিস এরও ভাগ্য।
অ্যাকিলিসকে অমরত্ব দানের চেষ্টা:
বিভিন্ন গ্রন্থ ও বর্ণনা থেকে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, অ্যাকিলিস এর জন্মের পর তাকে অমরত্ব দানের উদ্দেশ্যে তার মা থেটিস তাকে স্টিক্স নদীতে অবগাহন করায়। স্টিক্স নদীটি পৃথিবী ও মৃত্যুপুরীর সীমানা নির্দেশক এবং বিশ্বাস করা হতো যে, এই নদীর পানির স্পর্শ পেলে সবাই অমর হয়ে যায়। নদীর পানিতে ডোবানোর সময় থেটিস অ্যাকিলিসের বাম পায়ের গোড়ালি ধরে ছিলো। ফলে সেখানে নদীর জল স্পর্শ করতে পারেনি এবং অ্যাকিলিসের সারা শরীর অমর হলেও একমাত্র বাম পায়ের গোড়ালি মরণশীল রয়ে যায় এবং এটিই হয়ে ওঠে তার একমাত্র দুর্বলতা।
অন্য আরেকটি সংস্করণ থেকে জানা যায় যে, থেটিস অ্যাকিলিস এর শরীরে অমৃত মেখে তাকে আগুনের উপর ধরে রাখে যেন পিতৃসূত্রে পাওয়া অ্যাকিলিস এর শরীরের নশ্বর অংশটুকু পুড়ে যায়। কিন্তু পেলেয়াস মাঝপথে বাঁধা দেয়। এর ফলে থেটিস রাগান্বিত হয়ে পেলেয়াস এবং অ্যাকিলিসকে রেখে চলে যায়।

বালক বয়সে উপনীত হওয়ার পর পেলেয়াস অ্যাকিলিসকে পেলিয়ন পর্বতে কাইরন নামক এক সেন্টর (নরঘোটক) এর নিকট প্রেরণ করেন তার লালন পালন ও যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষার জন্য। সেখানেই অ্যাকিলিস বেড়ে উঠে। তবে হোমার এর মতে, অ্যাকিলিস তার প্রিয় সহচর প্যাট্রোক্ল্যাস এর সাথে থিয়ায় বড় হয়।
যাই হোক, অ্যাকিলিসের বালক বয়সেই ক্যালকাস নামক একজন ভবিষ্যৎবক্তা থেটিসকে বলে যে অ্যাকিলিস যুদ্ধে যাবে, অল্প বয়সে অনেক গৌরব ও মর্যাদা অর্জন করবে এবং মারাও যাবে। কিন্তু যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে সাধারণ ভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। একিলিস প্রথমটা বেছে নেয় এবং ট্রয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
স্কাইরোস এ ছদ্মবেশে থাকা:
হোমারের পূর্বের অনেক উৎস থেকে জানা যায় যে অ্যাকিলিস কে যুদ্ধ থেকে দূরে রাখতে থেটিস (কোন কোন মতে পেলেয়াস) বালক অ্যাকিলিসকে স্কাইরোস এর রাজার নিকট লুকিয়ে রাখে। সেখানে রাজা লাইকোমিডস এর কন্যাদের সাথে অ্যাকিলিসকে মেয়ে সাজিয়ে রাখা হয় এবং তার নাম দেয়া হয় “পিরহা” বা লাল চুলের মেয়ে। সেখানে লাইকোমিডস এর কন্যা ডেইডামিয়ার সাথে অ্যাকিলিস একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় যার নাম রাখা হয় নিউপোটলেমাস।

এই কাহিনী অনুসারে, ওডিসিয়াস ক্যালকাস এর নিকট থেকে জানতে পারে যে অ্যাকিলিসের সাহায্য ছাড়া গ্রীকরা ট্রয় নগরী দখল করতে পারবেনা। তাই ওডিসিয়াস হকার এর ছদ্মবেশে স্কাইরোস যায় এবং মেয়েদের গয়না ও জামাকাপড় বিক্রয় করতে থাকে। কিন্তু জামা কাপড়ের সাথে সে একটি বর্শা ও একটি ঢাল লুটিয়ে রাখে। সব মেয়েরা গয়না ও জামাকাপড় নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বর্শা ও ঢাল দেখা মাত্রই অ্যাকিলিস তা তুলে নেয়। ওডিসিয়াসও তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারে যে এই হচ্ছে অ্যাকিলিস । ফলে ওডিসিয়াস তাকে বুঝিয়ে গ্রীকদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য রাজি করায়। গল্পের আরেকটি সংস্করণ অনুযায়ী, ওডিসিয়াস ডঙ্কা বাজানো শুরু করে এবং এতে মেয়েরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু অ্যাকিলিস ভয় না পেয়ে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। এভাবেই ওডিসিয়াস তাকে চিনে ফেলে।
ট্রয় যুদ্ধে অ্যাকিলিস :
যখন ট্রয় যুদ্ধ শুরু হয় অ্যাকিলিস মারমিডন্স থেকে ৫০ টি জাহাজ নিয়ে রওয়ানা হয় এবং প্রতিটি জাহাজে ৫০ জন করে মারমিডন্স এর সৈনিক ছিলো। এছাড়াও সে আরো ৫ জন দলনেতা নিযুক্ত করে যাদের নেতৃত্বে ছিলো ৫০০ জন করে যোদ্ধা। যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিল মেনেস্থিয়াস, ইউডোরাস, পেইস্যান্ডার, ফ্যোনিক্স ও অ্যালকিম্যাডন। যাত্রা শুরুর পর অ্যাকিলিস তার বাহিনী নিয়ে ভুল করে মিসিয়া চলে আসে। মিসিয়ার শাসনকর্তা ছিলো টেলিফাস এবং তার সাথে অ্যাকিলিস এর যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে টেলিফাস আহত হয়। কিছুতেই টেলিফাস এর ক্ষত যখন ভালো হচ্ছিল না তখন ওরাকল এর মাধ্যমে সে জানতে পারে যে , আঘাত যে দিয়েছে সেই এটা ভালো করতে পারবে। টেলিফাস তখন অ্যাকিলিস এর কাছে যায় এবং তার ক্ষত সারিয়ে দেয়ার বদলে ট্রয় এর পথ নির্দেশনা দেয়।
ট্রয় এ পৌঁছার পর একিলিস ট্রয়ের বিভিন্ন মিত্র শহর গুলো জয় করার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার পরিচয় দিতে থাকে। গ্রীক সৈনিকরা একে একে ট্রয়ের অনেক মিত্র নগরী দখল করে নেয়। একদিন তারা লারনেসস নামক একটি নগর আক্রমণ করে এবং এখানে সূর্য দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির থেকে ক্রিসেইস ও ব্রিসেইস নামে মন্দিরের দুই যাজিকা কে তুলে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ক্রিসেইস কে নেয় রাজা অ্যাগামেনন এবং অ্যাকিলিস তার পুরষ্কার হিসেবে পায় ব্রিসেইস কে। কিন্তু দেবতা অ্যাপোলো তার প্রিয় যাজিকাকে অ্যাগামেনন এর নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়। ফলে অ্যাগামেনন অ্যাকিলিসের নিকট থেকে ব্রিসেইস কে নিয়ে নেয়। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় একিলিস। কারণ কারো নিকট থেকে তার পুরষ্কার ছিনিয়ে নেয়া তার জন্য অপমানজনক।

অ্যাকিলিস যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার ফলে সবকিছু ট্রজানদের অনুকূলে চলে যেতে থাকে। গ্রীকরা নিরুপায় হয়ে তার কাছে মিনতি করলেও সে যুদ্ধে ফিরে আসেনি। ফলে ধীরে ধীরে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যেতে থাকে। অ্যাকিলিস এর প্রিয় বন্ধু প্যাট্রোক্ল্যাস বুঝতে পারে যে তাকে জোর করে লাভ হবেনা। তাই সে একটি সমাধান বের করে। সৈনিকদের মনোবল ও সাহস ফিরিয়ে আনতে সে একিলিস এর বর্ম পরে ছদ্মবেশে যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। কিন্তু প্যাট্রোক্ল্যাস ঐ দিনই হেক্টর এর হাতে নিহত হয়। অ্যাকিলিস কে বধ করেছে এই ভেবে হেক্টর বর্ম পরিহিত অবস্থাতেই প্যাট্রোক্ল্যাস এর মৃতদেহ নিয়ে যায়। প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে অ্যাকিলিস ক্রোধে অন্ধ হয়ে যায়। প্যাট্রোক্ল্যাস এর মৃত্যুর শোধ নিতে সে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে। থেটিস শিল্পকার ও অগ্নি দেবতা হেফায়েস্টাস এর নিকট থেকে একিলিস এর জন্য নতুন বর্ম তৈরি করে নিয়া আসে। আর তা পরেই অ্যাকিলিস হেক্টর বধে নামে। হেক্টরকে হত্যা করে সে বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয় এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হেক্টরের মৃতদেহকে তার চ্যারিয়ট এর পেছনে বেঁধে টেনে নিয়ে আসে। ট্রয়ের বীর যোদ্ধা হেক্টরের মৃতদেহকে অ্যাকিলিস সমাহিত করতে দেয়নি বরং ক্রোধে অন্ধ হয়ে সে হেক্টরের মৃতদেহকে খুঁটির মাথায় বেধে রাখে। ওই রাতে ট্রয়ের রাজা প্রায়াম তার সন্তান ও বীর যোদ্ধা হেক্টরের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য অ্যাকিলিস এর কাছে হাত জোড় করে ভিক্ষা চায়। শেষ পর্যন্ত অ্যাকিলিস এর মনে দয়ার উদ্রেক হয় এবং প্রায়াম কে হেক্টরের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
অ্যাকিলিস এর মৃত্যু:
ট্রয় যুদ্ধ ১০ বছর ধরে চলেছে। ১০ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গ্রীকরা ট্রয় দখল করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে অ্যাকিলিস মেমনন ও আমাজন যোদ্ধা প্যান্থেসিলিয়া সহ প্রতিপক্ষের অনেককেই ঘায়েল করেছে। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের হাতে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অ্যাকিলিস সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। দেবতা অ্যাপোলো কর্তৃক নির্দেশিত তীরে, প্যারিসের হাতে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু হয় একিলিস এর। প্যারিস এর নিক্ষেপিত তীর অ্যাকিলিস এর বাম পায়ের গোড়ালিতে লাগে কারণ এটিই ছিলো তার শরীরের একমাত্র নশ্বর অংশ। অ্যাকিলিস এর মৃত্যুর পর তার স্বর্গীয় বর্ম একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জিতে নেয় ওডিসিয়াস।
অ্যাকিলিস এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয় গ্রীক পুরাণের অ্যাকিলিস অধ্যায়ের। তবে মৃত্যু মুছে দিতে পারেনি এই বীর যোদ্ধার অমর কীর্তিকে। শক্তি, সাহস আর বীরত্বে অ্যাকিলিস অমর হয়ে আছে ইতিহাস আর পুরাণ প্রেমীদের মনে।
তথ্যসুত্রঃ
www.greekmythology.com
levaquin canada order levaquin 500mg pills
digitürk şanlıurfa bayi ile en uygun digiturk paketinden sizde yararlanın.