একটু শান্তি লগ্নি করতে মানুষ যেকোনো কিছুই করতে প্রস্তুত আর শান্তিটা যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মিশ্রিত থাকে তবে যেকেউ স্বর্গীয় অনুভূতি মর্ত্যে থাকতেই অনুভব করতে চাইবেই। একটি নতুন সমীক্ষায় উঠে এসেছে দশটি দেশের নাম যার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে দুদণ্ড শান্তি আর এ দশটি দেশকে পৃথিবীর বুকে থাকা এক টুকরো স্বর্গের টুকরো বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
“গ্লোবাল পিচ ইনডেক্স” (GPI) রিপোর্ট অনুসারে গবেষকরা ২৩ টি শান্তি নির্দেশক দিক হতে বিবেচনা করে মান প্রদান করে থাকেন যার মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সম্পর্কের ভিত্তি, জাতিসংঘের শান্তি চুক্তিতে অবদান, সন্ত্রাসবাদ, হাঙ্গামায় নিহতদের সংখ্যা, খুনের সংখ্যাও গণনা করা হয় এবং এর ভিত্তিতেই নির্ণয় করা হয় পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকা।
পৃথিবীর সেরা দশটি শান্তিপূর্ণ দেশ সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
১. আইসল্যান্ড (GPI স্কোর ১.১১১)
সর্বনিম্ন জিপিআই স্কোর হিসেবে আইসল্যান্ডই হলো পৃথিবীর এক নম্বর স্থান যা শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী। ৯৯% শিক্ষার হার সমৃদ্ধ এই দেশটাতে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা হয়। বৈষম্য এবং বিশৃঙ্খলার হার একদম শূন্যের কোটার কাছাকাছি।
আইসল্যান্ড একটি দ্বীপ যা তার নান্দনিক ভূপৃষ্ঠের নকশার জন্যে জগদ্বিখ্যাত। ইউরোপের উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে অবস্থিত আইসল্যান্ড প্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার জনবল সমৃদ্ধ যার আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ৩ হাজার বর্গ কিঃমিঃ। আইসল্যান্ড সম্পর্কিত বেশ কিছু মজার তথ্য রয়েছে।
সময় ৮০০ খৃষ্টাব্দ যখন নরওয়ের সমুদ্র দস্যুদের দ্বারা আইসল্যান্ড স্থাপিত হয়। ইউরোপের প্রথম পার্লামেন্ট ভূমি হিসেবে খ্যাত আইসল্যান্ড। মধ্য আটলান্টিকে অবস্থিত সক্রিয় আগ্নেয়গিরির ভূমিস্থল এই দ্বীপ। প্রায় ১২৫ টি আগ্নেয় পর্বত রয়েছে এইখানে। অর্ধেক অংশ তুষার নদী দ্বারা আবৃত।
এই দেশটিতে শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কোন খরচ বহন করতে হয় না নাগরিকদের যার কারণে সভ্যতা এ দেশটির একটি অলঙ্কার।
২. নিউজিল্যান্ড (GPI স্কোর ১.২৪১)
উন্নত এবং অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ড অনেকটা এগিয়ে আছে বিধায় নিউজিল্যান্ডকে দ্বিতীয় শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাধীন বিচার পরিষদ, নিরাপত্তা এবং উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিক হতে বিবেচনা করে নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় স্থানে থাকাটাই স্বাভাবিক।
ওশেনিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৪ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এবং এতে বসবাস করে প্রায় ৪৮ লক্ষেরও বেশি মানুষ। নিউজিল্যান্ড আগে নিউ সাউথ ওয়েলস এবং পরে অস্ট্রেলিয়ার একটি অংশ হিসেবে পরিচালিত হতো। প্রত্যেক নাগরিকের নিজস্ব মতামত দেয়ার স্বাধীনতা, উন্নত মানের কম খরচে শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিউজিল্যান্ডকে দিয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় শান্তিপূর্ণ স্বর্গীয় দেশের স্থান।
৩. পর্তুগাল (GPI স্কোর ১.২৫৮)
তিন নাম্বার স্থানে ১.২৫৮ স্কোর নিয়ে রয়েছে পর্তুগাল যার আয়তন প্রায় ৯২ হাজার ৩৫৫ বর্গ কিঃমিঃ। গত বছরের চেয়ে দ্রুত এবং লক্ষণীয় উন্নতি সাধন করে দেশকে আরো শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ করে এই স্থান দখল করেছে পর্তুগাল। পর্তুগাল একটি আকর্ষণীয় এবং ঐতিহ্যবাহী দেশ যার মধ্যে অবস্থিত ইউরোপের সর্ব প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় “University of Coimbra”, বলা বাহুল্য পর্তুগীজ ভাষা সারাবিশ্বে প্রায় নয়টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। আইবেরীয় উপদ্বীপের পশ্চিম অংশে অবস্থিত পর্তুগাল ইউরোপের একটি প্রাচীনতম শহর। “Bertrand Bookstore” নামক বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগার পর্তুগালেই অবস্থিত। মিতব্যয়ী জীবন ব্যবস্থা, স্বচ্ছ কর ব্যবস্থাপনা, জলবায়ুগত অনুকূল পরিবেশ, নিরাপদ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সার্বিক দিক মিলিয়ে পর্তুগাল জায়গা করে নিয়েছে তৃতীয় শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায়।
৪. অস্ট্রিয়া (GPI স্কোর ১.২৬৫)
আল্পস পর্বতমালার উপরে অবস্থিত, চতুর্দিকে পর্বতে ঘেরা একটি দেশ অস্ট্রিয়া, যা বিশ্বের চতুর্থ শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে নির্বাচিত। প্রায় ৮৩ হাজার ৮৫৮ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এই দেশে বসবাস করে ৮৭ লক্ষ মানুষ। জার্মান শব্দ “Austro” হতে আগত অস্ট্রিয়া শব্দটির অর্থ হলো “পূর্ব”। এ দেশের পতাকা বিশ্বের প্রাচীন পতাকা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বকে সেলাই মেশিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া ব্যক্তি “Josef Madersperger” একজন অস্ট্রিয়ান ছিলেন। বিশ্বের অন্যতম দামী গাড়ি “Porsche” এর জনক “Ferdinand Porsche” ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান। আরেক হলিউড সুপারস্টার “Arnold Schwarzenegger” বড় হয়েছিলেন অস্ট্রিয়াতে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং রিসাইক্লিংয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা, খুন-রাহাজানির স্বল্পতা এবং মাথাপিছু আয়ের দিকে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পাকাপোক্তভাবেই বিশ্বের শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে চতুর্থ স্থান দখল করে নিয়েছে অস্ট্রিয়া।
৫. ডেনমার্ক (GDI স্কোর ১.৩৩৭)
উত্তর পশ্চিম ইউরোপের একটি রাষ্ট্র ডেনমার্ক। কম দুর্নীতি এবং অন্যতম সুখী দেশ হিসেবে ডেনমার্কের স্থান তালিকার পাঁচ নম্বরে। প্রায় ৪৩ হাজার ৯৪ বর্গ কিঃমিঃ বিস্তৃত জুড়ে বসবাস করে প্রায় ৫৪ লক্ষ ৫১ হাজার মানুষ। ডেনমার্কে ৪৪৩ টি দ্বীপ রয়েছে, যার মধ্যে ৭৬ টি বসবাসযোগ্য।
উন্নতমানের সামাজিক কার্যকলাপ যা ডেনমার্কের অধীনস্থদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করে এবং কোপেনহ্যাগেন যা অত্যন্ত জনবহুল শহর হিসেবে পরিচিত যেখানে সাইকেলিংকে উৎসাহিত করা হয় এবং ২০২৫ এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যার কারণে এটি তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে।
৬. চেক রিপাবলিক (GPI স্কোর ১.৩৬০)
মধ্য ইউরোপের একটি রাষ্ট্র চেক রিপাবলিক। প্রায় ৭৮ হাজার ৮৬৬ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এই রাষ্ট্রে বসবাস ১ কোটি ৫ লাখ ১৩ হাজার মানুষের। অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্লোভাকিয়া এবং পোল্যান্ডের বর্ডারের সাথে লাগানো চেক রিপাবলিক। ভ্রমনপিপাসু পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এই রাষ্ট্র। “Prague” অন্যতম সুন্দর চেক রিপাবলিকের রাজধানী ইউরোপের সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষিত এরিয়া। কোন ধরণের খুন রাহাজানি, চুরির চিন্তাভাবনা ছাড়া যেকেউ নিঃসঙ্কোচে এই দেশ ভ্রমণ করতে পারবে। সবচেয়ে সস্তা যোগাযোগব্যবস্থার কারণে এ দেশে পর্যটকদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো।
৭. স্লোভেনিয়া (GPI স্কোর ১.৩৬৪)
মধ্য ইউরোপের একটি রাষ্ট্র স্লোভেনিয়া যার রাজধানীর নাম লিউব্লিয়ানা। প্রায় ২০২৭৩ বর্গ কিঃমি আয়তনের এই দেশে বসবাস করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এ দেশে অপরাধের মাত্রা একদম স্বল্প এবং এখানকার মানুষেরা অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের যার কারণে পর্যটকেরা নিঃসঙ্কোচে এখানে যেতে পারে।
৮. কানাডা (GPI স্কোর ১.৩৭১)
কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র যা উত্তর আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। আয়তন প্রায় ৯৯ লাখ বর্গ কিঃমিঃ যার মধ্যে বসবাস প্রায় ৩ কোটি ২২ লাখ মানুষের। কানাডিয়ান সরকার জনগণের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার দিকে নজর দেয় যার কারণে এ দেশে অপরাধ এবং খুন রাহাজানির মাত্রা কম, তাছাড়া দেশে বেকারত্বের হার মাত্র ৬.৬%।
OECD এর রিপোর্ট অনুসারে এখানকার নাগরিক জীবনযাপনের সন্তুষ্টির মাত্রা ৭.৬ / ১০। বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ শিক্ষার হার রয়েছে কানাডার পক্ষে। সরকারের প্রতি নাগরিকদের রয়েছে দৃঢ় আস্থা।
৯. সুইজারল্যান্ড (GPI স্কোর ১.৩৭৩)
পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত হলেও এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়। প্রায় ৪১ হাজার ২৮৫ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এই রাষ্ট্রে বসবাস করে প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ। বহিরাগত আক্রমণ ঠেকাতে এই রাষ্ট্রের প্রধান পয়েন্টগুলো নিরাপত্তায় বেষ্টিত যাতে আক্রমণের পূর্বমুহূর্তে প্রবেশ পথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যায়। এখানকার নাগরিক পার্লামেন্টের যেকোনোও আইনের প্রতি মতামত জানাতে পারে। এখানকার জনগণের গড় আয়ু অন্যান্যদের তুলনায় বেশি।
পরিচ্ছন্ন শহর, কম মাত্রার অপরাধ এবং উন্নত মানের খাদ্য ব্যবস্থা সুইজারল্যান্ডকে পৃথিবীর নবম সুখী দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
১০. জাপান (GPI স্কোর ১.৪০৮)
প্রায় ৬৮৫২ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত জাপান একটি আগ্নেয়গিরীয় দ্বীপমালা। এর বৃহত্তম দ্বীপগুলো হলো হোনশু, হোক্কাইদো, ক্যুশ ও শিকোকু। ১২ কোটি ২৯ লাখ জনসংখ্যা সমৃদ্ধ এই দেশটির আয়তন প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার বর্গ কিঃমিঃ। বিশ্বে জাপান তথ্য প্রযুক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানরত একটি দেশ। যোগাযোগের সুব্যবস্থা, বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র, অপরাধ স্বল্পতা এবং উন্নত জীবনযাত্রার মান মিলিয়ে জাপানের স্থান তালিকার দশ নাম্বারে।
দিনশেষে সবাই খুঁজে ফিরে একটু সুশীতল স্নিগ্ধ বাতাস যা হতে টেনে নিতে পারা যায় নির্মল শ্বাস। বিস্ময় জাগানিয়া হিসেবে বিশ্বের বলয়ে অবস্থিত এই দশটি রাষ্ট্র আসলেই বিস্ময়ের জোগান দেয় এবং অন্যদের দেখিয়ে দেয় কিভাবে পথ পরিচালনা করলে নিজেদের স্থানকেও সবার বসবাস উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। এই রাষ্ট্রগুলো যতোটা আকর্ষণীয় তারচেয়েও বেশি শিক্ষণীয় কিছু দান করে অন্যদের জন্য।