‘মসোলিয়াম’ বা সমাধিসৌধ শব্দটি আজকাল ব্যবহার করা হয় “পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা বিশেষ ভবন“ বুঝাতে। ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু করে বানানো সমাধিই হল মসোলিয়াম। এই শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ‘মাওসোলাস’ থেকে, মূলত যার জন্যেই প্রথম মসোলিয়াম তৈরি করা হয়। বর্তমান বোড্রাম, তুর্কিতে অবস্থিত এই মসোলিয়াম “প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্য“ এর মধ্যে অন্যতম এক আশ্চর্য। আর এই কারণে, বোড্রামের মসোলিয়াম প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত এক স্থাপত্যশৈলী। গিজার পিরামিডের পর এই মসোলিয়াম হল দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম যা প্রায় দেড় সহস্রাব্দ ধরে গর্বের সাথে অবস্থান করছে ।
ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে হ্যালিকারনেসাস ছিল এশিয়া মাইনরের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত অ্যাকেমেনিড সাম্রাজ্যের ছোট এক রাজ্যের রাজধানী। এই রাজ্যের শাসক ছিলেন মিলাস এর হেকাটোমনাস। পারস্যের অধীনে একজন প্রাদেশিক শাসক হেকাটোমনাস বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী শহর এবং এলাকাগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে হেকাটোমনাসের মৃত্যুর পর রাজ্য যখন সম্রাট মাওসোলাস এর হাতে আসে, রাজ্য তখন অ্যানাটোলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।

হ্যালিকারনেসাস এর মসোলিয়াম তৈরি করা হয়েছিল সম্রাট মাওসোলাস এর জন্য, যিনি ছিলেন হেকাটোমনিড রাজবংশ থেকে কারিয়া এর দ্বিতীয় শাসক, যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। হ্যালিকারনেসাস এর পুনরুদ্ধারক হিসেবে মাওসোলাস, গ্রীক রীতি অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সম্মান এবং শহরের কেন্দ্রে সমাধিসৌধের অধিকারী ছিলেন। সমাধিস্তম্ভ স্থাপনের সবকিছুর ভার ছিল মাওসোলাসের শোকার্তা সহধর্মিণী আর্টেমিসিয়ার উপর যিনি আবার ঘটনাক্রমে ছিলেন তার আপন বোন এবং তারা ছিলেন হেকাটোমনাস এর পুত্র এবং কন্যা। তারা ছাড়াও হেকাটোমনাস এর আরও সন্তান রয়েছে: অ্যাডা (আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর পালক মাতা), ইদ্রিয়াস এবং পিক্সোদারুস।

মাওসোলাস এবং আর্টেমিসিয়া ২৪ বছর ধরে হ্যালিকারনেসাস এ অবস্থান করে পুরো রাজ্য শাসন করে। স্থানীয় হলেও মাওসোলাস কথা বলতো গ্রীক ভাষায় এবং গ্রীকদের জীবন যাপনের ধারা ও রাজ্য পরিচালনার পদ্ধতিতে মুগ্ধ ছিলেন। তিনি গ্রীক নকশায় অনেকগুলো শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং গ্রীক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। হয়তো গ্রীক সংস্কৃতির প্রতি অন্যরকম মুগ্ধতা থাকার কারণেই সম্রাট মাওসোলাস এর সমাধি স্তম্ভে গ্রীক কাঠামোর আধিক্য ছিল।
মসোলিয়াম এর নির্মাণ
বলা হয়ে থাকে, সমাধিস্তম্ভটির নকশা করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতকে তৈরি লাইসিয়ান সান্থোস এর নেরেইড সৌধের আদলে, তবে তার থেকে অনেকটা বৃহৎ পরিসরে। কথিত আছে, পুরো মসোলিয়ামের নকশা করার জন্য আর্টেমিসিয়া গ্রীক স্থপতি সাটিরোস এবং পাইথিওস কে আমন্ত্রণ জানিয়ে গ্রিস থেকে আনিয়েছিলেন। অপরদিকে, স্তম্ভের অন্দরসজ্জার দায়িত্ব ছিল বাইরাক্সিস, লিওকারিস, তিমথিউস এবং পারোসের স্কোপাস নামের ভাস্করদের উপর। তাদের কর্মী হিসেবে কাজ করেছিল শত শত মজুর এবং কারিগর। সবশেষে, এতগুলো মানুষের কাজের ফলস্বরূপ ইতিহাস পেল তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি- গ্রীক, লাইসিয়ান এবং মিশরীয়- এর সমন্বয়ে তৈরি একটি আশ্চর্য যা হয়ে উঠেছে পৃথিবী বিখ্যাত।

মসোলিয়ামটির উচ্চতায় ছিল সম্ভবত ৪৫ মিটার ( ১৪৮ ফিট )। সম্ভবত, মসোলিয়ামটি পাহাড় চূড়ায় বানানো হয়েছিল যাতে সেই জায়গা থেকে শহরের সর্বাধিক দৃশ্যমানতা পাওয়া যায়। সবার প্রথমে নির্মাণ করা হয়েছিল আঙ্গিনার সাথে আবদ্ধ একটি পাথরের প্ল্যাটফর্ম এবং এই প্ল্যাটফর্মের শীর্ষে যাওয়ার জন্যে ছিল পাথরের সিংহ দ্বারা বাধাই করা সিঁড়ি। আঙ্গিনার বাইরের দেয়ালের পাশে স্থাপিত ছিল বিভিন্ন দেব-দেবীদের অনেকগুলো মূর্তি, আর প্রতিটি কোণায় ছিল যোদ্ধাদের মূর্তি। প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্রে ছিল মূল সমাধি। পুরো ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল ইট দিয়ে এবং ইটের কাঠামোর উপর দেয়া হয়েছিল প্রোকোনেসিয়ান মার্বেল পাথরের আবরণ, যার ফলে সমাধিটা চমৎকার এক রূপ ধারণ করে। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সমাধিস্তম্ভটি দেখতে এতটাই নান্দনিক এক স্থাপনায় পরিণত হয়েছিল যে, সিডোনের অ্যান্টিপেটোর এই স্থাপনাকে প্রাচীন বিশ্বের সপ্ত আশ্চর্যের মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

Source: British Museum
মসোলিয়ামের এক-তৃতীয়াংশ ছিল বর্গাকৃতির, ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া ব্লকগুলোতে ছিল কারুকাজ করা ভাস্কর্য। এই কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল গ্রীক থিয়েটারের কিছু দৃশ্য, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সেন্টোরোমাকি (লাপিথ এবং সেন্টরদের যুদ্ধ) এবং আমাজনমাকি (গ্রীক এবং আমাজনদের যুদ্ধ) । বাকি এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে ছিল ৩৬ টি বিশেষ ভাবে তৈরি কলাম, প্রতি দিকে ১০ টি করে বসানো। প্রতিটি কলামের মাঝে ছিল একটি করে ভাস্কর্য এবং কলামের পিছনে ছিল ভাস্কর্যের ছাদ বহনকারী নিরেট ব্লক। এই ভবনটির সর্বশেষ এক-তৃতীয়াংশ ছিল ২৪ টি ধাপ যুক্ত পিরামিড, যার চূড়ায় ছিল ৪ টি ঘোড়া-টানা রথের উপর সওয়ার মাউসোলাস এবং আর্টেমিসিয়ার একটি ভাস্কর্য।

বেশ কয়েক দশক পর যখন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর বিজয় হেকাটোমনিড সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়, তারও হাজার বছর পর্যন্ত সমাধিস্তম্ভটি অক্ষত ছিল। ১৩ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে গম্বুজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রথের পাথরগুলো মাটিতে খসে পরে। ১৫ শতকের প্রথমদিকে কেবল মূল কাঠামোটি ভিত্তিটাই চেনা যেত। একই শতকের শেষের দিকে এবং ১৫২২ সালে, গুজব বলে, তুর্কি আক্রমণের সময় বোড্রাম দুর্গের দেয়াল শক্তিশালী করার কাজে সাধু জনের নাইটগণ এই সমাধি স্তম্ভের পাথর ব্যবহার করে। উপরন্তু, ভাস্কর্যগুলোকে গুঁড়িয়ে প্লাস্টার তৈরির চুনে পরিণত করা হয়েছিল, যদিও কয়েকটি ভাল ভাল ভাস্কর্য উদ্ধার করে বোড্রাম দুর্গে জড়ো করে রাখা হয়। এদের মধ্য কিছু ভাস্কর্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামের জন্য ব্রিটিশ অ্যাম্বাসেডর কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়।

হ্যালিকারনেসাসের এই মসোলিয়ামের ধ্বংসাবশেষ এর অবস্থান পরবর্তীকালে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যায় এবং ১৯ শতকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কর্মরত চার্লস টমাস নিউটন কর্তৃক এটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয়। তিনি তার সন্ধানে সফল হয়েছিলেন এবং তার আবিষ্কৃত স্থানগুলোর মধ্যে ছিল কয়েকটি দেয়ালের কিছু অংশ, সিঁড়ি এবং ভিত্তিটির তিনটি কোণা। একই সাথে, নিউটন আরো আবিষ্কার করেন কারুকাজকৃত ব্লকের অংশবিশেষ যেগুলো দিয়ে ভবনটির দেয়াল সজ্জিত ছিল, ধাপ যুক্ত ছাদের অংশ, ছাদের উপরে থাকা রথের ভাস্কর্যের একটি ভাঙ্গা চাকা এবং আরো দুইটি ভাস্কর্য যেগুলোকে ধরে নেয়া হয় রথ ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে। আবিষ্কৃত এই বিষয়গুলোকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেগুলো এখনও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে; যদিও তুর্কি কর্তৃপক্ষ এখনও আবিষ্কৃত ইতিহাসের অংশগুলো প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই অংশগুলোই প্রাচীন বিশ্বের এক বিস্ময়ের শেষ অবশিষ্টাংশ, যে বিস্ময় পুরো পৃথিবীর আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কারণ হয়েছিল।
oral levofloxacin 500mg purchase levaquin