এলিট বা স্পেশাল ফোর্স হচ্ছে কোনো দেশের সবচেয়ে দক্ষ, অত্যাধুনিক ও সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মিলিটারি ইউনিট যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কোনো ধরণের সামরিক মিশন পরিচালনা করার যোগ্যতা রাখে। হলিউড মুভির কল্যাণে কমবেশি সবারই এলিট বা স্পেশাল ফোর্স সম্পর্কে ধারণা রয়েছে। সামরিক ভাবে শক্তিশালী প্রতিটি দেশের নিজস্ব স্পেশাল ফোর্স রয়েছে। এই স্পেশাল ফোর্স গুলো একই সাথে কোন দেশের সামরিক শক্তির পরিচায়ক এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে দেশের হয়ে বিভিন্ন বিপজ্জনক মিশন পরিচালনা করতে সদা প্রস্তুত থাকে। যে কোনো দুর্গম প্রাকৃতিক পরিবেশে তারা মানিয়ে নিতে পারে এবং স্বচ্ছন্দে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এমনকি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে নিঃশব্দে তারা তাদের মিশন সম্পন্ন করে বেরিয়ে যেতে পারে।
বিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই বিভিন্ন স্পেশাল ফোর্সের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় থেকে দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য এরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এবং তখন থেকেই যে কোনো যুদ্ধের ইতিহাসে এই এলিট ফোর্স গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও অনন্য কর্মপদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে যে কোনো কাজে তারা সিদ্ধহস্ত। আজকে আমরা জানব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সেরা দশ এলিট ফোর্স সম্পর্কে-
ইন্ডিয়ান মেরিন কমান্ডো (Indian Marine Commandos-MARCOS)
মেরিন কমান্ডো ফোর্স বা মারকোস হচ্ছে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর একটি স্পেশাল এলিট অপারেশন ইউনিট। অত্যাধুনিক অস্ত্র সজ্জিত নৌ-বাহিনীর এই দলটি জলযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী এবং দাবী করা হয় যে জলযুদ্ধে আমেরিকার নেভি সীল এর পরে মারকোস ই একমাত্র ইউনিট যারা জলভাগে সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ করতে পারে। প্রাথমিক ভাবে এর সদস্যরা আমেরিকান নেভি সীল এর আদলে ও পরবর্তীতে ব্রিটিশ SAS ও বাধ্যতামূলক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে। মারকোস এর সদস্যরা শুধু শারীরিক প্রশিক্ষণ নয়, এরা একই সাথে মানসিক ও ইমোশনাল প্রশিক্ষণও পেয়ে থাকে যার ফলে তারা পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর স্পেশাল ফোর্স হিসেবে পরিচিত। মারকোস কর্তৃক অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পরিচালিত কয়েকটি অপারেশন এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: কার্গিল যুদ্ধ, অপারেশন লীচ, অপারেশন সোয়ান ইত্যাদি।
স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ, পাকিস্তান (Special Services Group-SSG)
স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ– এস এস জি বা ব্ল্যাক স্টর্ক্স নামে পরিচিত পাকিস্তানী এই স্পেশাল ফোর্সটি গঠিত হয় ১৯৫৬ সালে। পৃথিবীর সেরা স্পেশাল ফোর্স গুলোর একটি হওয়ার পাশাপাশি যে কোনো বিপদে অত্যন্ত সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য এদের সুনাম রয়েছে। এস এস জি এর প্রশিক্ষণ তালিকায় রয়েছে ১২ ঘণ্টায় টানা ৩৬ মাইল মার্চ করা বা ৫০ মিনিটে ফুল গিয়ারে টানা ৫ মাইল দৌড়ানো ইত্যাদি। এস এস জি এর উল্লেখযোগ্য অপারেশন এর মাঝে রয়েছে ঐতিহাসিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, হাইজ্যাককৃত প্যান-আমেরিকান ফ্লাইট ৭৩ উদ্ধার ইত্যাদি। এছাড়া এদের একটি উল্লেখযোগ্য সফল অপারেশন ছিলো আফগানিস্তানের ছিনতাইকৃত একটি স্কুল বাসের বাচ্চাদের উদ্ধার যা করতে এস এস জি এর সময় লেগেছিলো মাত্র ২০ সেকেন্ড। হ্যাঁ, মাত্র ২০ সেকেন্ডেই তিন জন সন্ত্রাসবাদীকে মেরে তারা স্কুল বাসটিকে উদ্ধার করে।
ইকো কোবরা, অস্ট্রিয়া (EKo Cobra)
ইকো কোবরা অস্ট্রিয়ার প্রধান সন্ত্রাস বিরোধী স্পেশাল ট্যাকটিক্যাল ইউনিট যা ১৯৭৮ সালে গঠিত হয়। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরাইলী ক্রীড়াবিদদের উপর হামলার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ এই স্পেশাল ফোর্স গঠিত হয়। খুব বেশি জনপরিচিতি না থাকলেও বিভিন্ন সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে এরা খুব তৎপর। পৃথিবীর অন্যান্য স্পেশাল ফোর্সের মত ইকো কোবরার সদস্যদেরও কঠোর প্রশিক্ষণ এর ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ইকো কোবরার অন্যতম একটি সফল অপারেশন ছিলো ১৯৯৬ সালে গ্রাজ-কার্লো কারাগার থেকে জিম্মি উদ্ধার করা। অনেক বিমান ছিনতাই রুখতে সিদ্ধহস্ত এই দলটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্পেশাল ফোর্স। বলা হয় যে এরাই পৃথিবীর একমাত্র সন্ত্রাস-বিরোধী দল যারা উড়ন্ত অবস্থায় সন্ত্রাসীদের বিমান ছিনতাই প্রক্রিয়া ব্যর্থ করে দিতে পারে।
জি আই জি এন, ফ্রান্স (GIGN)
দা ন্যাশনাল জেনডারমেরী ইন্টারভেনশন গ্রুপ বা সংক্ষেপে জি আই জি এন ফ্রান্সের স্বশস্ত্র বাহিনীর একটি স্পেশাল ফোর্স। অস্ট্রিয়ান ইকো কোবরার মতো জি আই জি এন ও ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলম্পিকে আক্রমণ এর পর গঠিত হয়। ফ্রান্স সহ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সন্ত্রাস দমন, জিম্মি উদ্ধারসহ বিভিন্ন সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এর সদস্যরা উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। জি আই জি এন এর সবচেয়ে নির্ভীক অপারেশন ছিলো ১৯৭৯ সালে চরমপন্থী বিদ্রোহীদের কবল থেকে মদীনার মসজিদ-উল-হারাম পুনরুদ্ধার। সৌদি ফোর্সের সাথে জি আই জি এন যোগ দেয় কিন্তু মসজিদের ভেতর অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় তিন জন জি আই জি এন কমান্ড সাময়িক সময়ের জন্য ইসলাম গ্রহন করেও অপারেশন পরিচালনা করে।
দা কানাডিয়ান জয়েন্ট ফোর্স টাস্ক ২ (The Canadian Joint Force Task 2- JFT2)
কানাডিয়ান স্পেশাল ফোর্স জে এফ টি টু গঠিত হয় ১৯৯৩ সালে এবং এটি পৃথিবীর অন্যান্য স্পেশাল ফোর্স গুলোর তুলনায় নব্য গঠিত একটি ফোর্স। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এরা নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। অপারেশন চলাকালীন সময় এরা এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা করে যে কানাডার প্রধানমন্ত্রীও আভাস পায়নি যে জে এফ টি টু আফগানিস্তান অপারেশনে সম্পৃক্ত।
ডেলটা ফোর্স, যুক্তরাষ্ট্র (Delta Force)
ব্রিটিশ SAS এর আদলে ১৯৯৭ সালে গঠিত ডেলটা ফোর্স এর সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে ইউ এস মিলিটারি গ্রুপের বিভিন্ন শাখা থেকে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের নিকট থেকে হুমকি পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে সবচেয়ে দক্ষ সেনা সদস্যদের নিয়ে এই স্পেশাল ফোর্সটি গঠন করে। ডেলটা ফোর্সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সদস্যরা অত্যন্ত দক্ষ শুটার। যে কোনো হুমকি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে এরা নির্বিঘ্নে অপারেশন পরিচালনা করতে পারে।
দা ইসরায়েলী শায়েতেত ১৩ (The IsraelI Shayetet 13)
শায়েতেত ১৩ নামে পরিচিত ইসরায়েলী মিলিটারি দলটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্পেশাল ফোর্স। ইসরায়েল এ আরো তিনটি এলিট ফোর্স রয়েছে কিন্তু সন্ত্রাস দমনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শায়েতেত ১৩ এদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিলো “স্প্রিং অব ইয়ুথ”। যারা ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলী ক্রীড়াবিদদের আক্রমণ করে প্রতিশোধ স্বরূপ এই অপারেশন এ তারা সেই ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ এর সদস্যদের আক্রমণ করে।
দা রাশিয়ান আলফা গ্রুপ (The Russian Alpha Group)
পৃথিবীর সেরা এলিট ফোর্স গুলোর মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান যে প্রথম সারিতে আসবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আলফা নামে পরিচিত রাশিয়ান এই এলিট ফোর্সটি পৃথিবীর অন্যতম হিংস্র একটি ফোর্স। সত্তর এর দশকের মাঝামাঝি আলফার কার্যক্রম শুরু হলেও আফগানিস্তানে অপারেশন পরিচালনার মধ্য দিয়ে এটি পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। ভয়ংকর প্রতিহিংসা পরায়ণতা ও হৃদয়হীন ভাবে প্রতি পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এদের পরিচিতি রয়েছে। ২০০২ সালে মস্কো থিয়েটারে জিম্মিদের উদ্ধারকালে জঙ্গিদের প্রতিহত করতে রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার ও এর ফলে ১২৯ জন জিম্মির মৃত্যুর ফলে আলফা গ্রুপ তীব্র নিন্দার সম্মুখীন হয়।
দা আমেরিকান নেভি সীল ( The American Navy SEALs)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সীল পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা একটি স্পেশাল ফোর্স। ইউ এস নৌ-বাহিনীর পুরুষ সদস্যদের নিয়ে এই ফোর্সটি গঠিত। জল, স্থল এমনকি আকাশ পথের যুদ্ধেও এরা সমান পারদর্শী এবং এক কথায় বলতে গেলে অতুলনীয়। অনন্য আক্রমণ পরিকল্পনা, উচ্চ প্রযুক্তি, উন্নত প্রশিক্ষণ সহ তাদের দখলে সবকিছু রয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে তাদের সম্পৃক্ততা ছিলো। ওসামা বিন লাদেন হত্যায় সি আই এ এর সাথে তারা পূর্ণ সহযোগিতায় ছিলো।
এস এ এস, যুক্তরাজ্য (Special Air Service-SAS)
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঠিত ব্রিটিশ এস এ এস এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর সেরা এলিট ফোর্স। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্পেশাল ফোর্স গুলো এর আদলে গঠিত। প্রথমে এই দলটি টেরিটোরিয়াল আর্মির একটি অংশ থাকলেও ১৯৪১ সালে এটি আলাদা হয়ে যায়। এই দলে যোগ দিতে চাইলে সুঠাম শারীরিক গঠন অপরিহার্য কারণ প্রার্থীদের প্রচণ্ড শারীরিক প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পরবর্তী পর্যায়ে শুরু হয় তাদের বিভিন্ন সার্ভাইভাল ট্রেনিং যা তাদের যে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। আধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্রের ব্যবহার, ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস থেকে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ ও নিজেদের দক্ষতা সব মিলিয়ে এরা অতুলনীয় ও অপ্রতিরোধ্য।
তথ্যসুত্রঃ
১. therichest.com
২. topteny.com