ইতিহাস সেই সব মহামানবদের নিয়ে রচিত হয় যারা ইতিহাসে নিজেদের কর্মের সাক্ষর রেখে গেছেন স্বীয়কর্ম গুণে ৷ তেমনি এক মহামানবের জন্ম হয়েছিলো অটোম্যান সাম্রাজ্যে ৷ যিনি একটানা ৪৬ বছর (১৫২০-১৫৬৬) অটোম্যান সাম্রাজ্য (উসমানীয় খিলাফত) শাসন করেছেন। যিনি সময়ের পিছনে হাঁটেননি, সময় যেন তাঁর পিছু নিয়েছে। ইতিহাসবেত্তারা যাকে ‘গ্রেট’ এবং ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেেব আখ্যায়িত করেছন ৷ যিনি একাই তিনটি মহাদেেশর (এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা) বিশাল অংশ শাসন করেছেন ৷ তিনি আর কেউ নন, অটোম্যান সাম্রাজ্যের (উসমানীয় খিলাফত) এক প্রতাপশালী শাসক সুলতান সুলেমান ৷

টিভি ধারাবাহিকে সুলতান সুলেমান:
ইতিহাসের তিন মহাদেশ কাঁপানো সেই মহানায়ক আজকের যুগেও কাঁপিয়ে তুলছেন টেলিভিশনের পর্দা ! বর্তমান পৃথিবীতে কয়েকটি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের মাঝে ‘সুলতান সুলেমান’ অন্যতম ৷ বিশ্বের প্রায় ৫২ টি দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে এই টিভি সিরিয়ালটি প্রচারিত হয় ৷ ধারনা করা হয় প্রায় একশত ভাষায় ডাবিং করা হয়েছে এই টিভি সিরিয়ালটি ৷ সর্বপ্রথম তুরস্কের ‘শো টিভি’তে নাটকটির সম্প্রচার শুরু হয় কিন্তু পরবর্তীতে তুরস্কের ‘স্টার টিভি’তে এর নিয়মিত প্রচার হয় ধারাবাহিক ইতিহাস আশ্রয়ী নাটক হিসেবে ৷ বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেল দীপ্ত টিভি ২০১৫ সালের শেষের দিকে এই ধারাবাহিকটি বাংলা ভাষায় ডাবিং করে সম্প্রচার শুরু করে। ইতিহাসে সুলতান সুলেমানের জীবনের পরিধি ব্যাপক বিস্মৃত হলেও নাটকটি মূলত নির্মিত হয়েছে উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসক সুলেমান -১ এবং তার প্রিয়তম স্ত্রী খুররেম বা হুররেম সুলতানের( তুর্কি ভাষায় ‘খ’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করা হয়, এজন্য খুররেম কে হুররেম বলা হয়) জীবনগাঁথার উপর ভিত্তি করে, যিনি পূর্বে সুলায়মানের কৃতদাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর প্রধান স্ত্রী বা সুলতানা হিসেবে সম্মানিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
টিভি ধারাবাহিকটি রচনা করেন যৌথভাবে মেরাল ওকেয়, ইয়িল্মায শাহিন ৷ নাটকটি পরিচালনা করেন মোট চার জন পরিচালক যথাক্রমে ইয়াগমুর তাইলান, দুরুল তাইলান, মার্ত বাইকাল, ইয়াগিজ আল্প আকাইদিন ৷ এ টিভি ধারাবাহিকটির প্রধান প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন খালিদ এরগেঞ্চ, মারিয়াম উজারলি, ভাহিদে পারচিন, নুর ফেত্তাহগ্লু, ওকান ইয়ালাবিক ও নেবাহাত চেহ্রে ৷ এছাড়াও কম্পোজার হিসেবে নাটকটিতে কাজ করেছেন ফাখির আতাকগ্লু, আইতেকিন আতাস এবং সোনার আকালিন ৷ ধারাবাহিকটি সর্বমোট চার সিজনে ১৩৯ পর্বে শেষ হয় ৷ এই টিভি ধারাবাহিকটি প্রযোজনা করেছেন তাইমুর সাভসি ৷ নাটকটির প্রধান চরিত্র সুলতান সুলেমানের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা হালিত(খালিদ) এরগেঞ্চ ৷
মারিয়াম উজারলি অভিনয় করেন হুররেম সুলতানের ভূমিকায় ৷ অভিনেত্রী নেবাহাত চেহরে অভিনয় করেছেন সুলায়মানের মা হাফসা সুলতানের ভূমিকায়।

নাটকের দৃশ্যপট:
মাত্র ২৬ বছর বয়সে সুলতান সুলেমান( খালিদ এরগেঞ্চ ) অটোম্যান সাম্রাজ্য তথা উসমানীয় খিলাফতের সিংহাসনে আরোহণ করেন ৷ সিংহাসনে বসেই তিনি প্রথম ঘোষণা করেন মহামতি আলেক্সান্ডারের থেকে অধিক শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি অটোম্যান জাতিকে পুরো বিশ্বে একটি অপরাজেয় জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন। তাঁর দীর্ঘ ৪৬ বছরের শাসনকালে পুরো বিশ্বে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে একজন বিচক্ষণ ও প্রতাপশালী সামরিক শাসক হিসেবে ৷তিনি তাঁর সঙ্গী ইব্রাহিম পাশাকে ( ওকান ইয়ালাবিক ) সাথে নিয়ে বিভিন্ন যুদ্ধে দক্ষতার সাথে বিজয় লাভ করেন। তিনি ইব্রাহিমকে সামরিক যুদ্ধে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সম্মানিত করেন এবং তিনি ইব্রাহিমকে তাঁর একান্ত সঙ্গী ও ভাই এর মর্যাদাও দেন ৷ মূলত ধারাবাহিকটিতে সুলতান সুলেমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দক্ষতা, বিচক্ষণতার প্রদর্শন করা হয়েছে ৷ ইব্রাহিম পাশাকে রাষ্ট্রের উজির হিসেবে নিয়োগ দেয়া , সমস্ত সাম্রাজ্যে আইনের কঠোর শাসন জারি করা, বৈদেশিক কূটনৈতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, এবং রণাঙ্গনের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুতকরণ, এই সব কিছুই করা হয় রোমান সাম্রাজ্য ও অটোম্যান সাম্রাজ্যের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে ৷

মূলত ধারাবাহিকটিতে ঐতিহাসিক পটভূমির নানান ঘটনাসমূহকে পাশ কাটিয়ে সম্রাট পরিবারের সদস্যদের পারস্পারিক সম্পর্ক, প্রেম, বিরহ এবং দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সুলতানের স্ত্রী হুররেম সুলতান ( মারিয়াম উজারলি ) এবং সুলতানের বয়োজ্যেষ্ঠ পুত্রের মাতা মাহিদেরভান সুলতানের ( নুর ফেত্তাখগ্লু ) শত্রুতাকে ঘিরে বিভিন্ন ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে এবং সুলেমানের মা আয়শা হাফসা সুলতানের ( নেবাহাত চেহরে ) ভূমিকা এবং সুলতানের সন্তান গর্ভে ধারণ করে সুলতানের প্রিয়পাত্র হওয়ার মাধ্যমে মহলে হুররেম সুলতানের অবস্থান উচ্চ আসনে আসীন করা, এবং পরবর্তীতে সন্তান জন্মের পর সেই অবস্থান হতে পতন এবং সেই পূর্বের অবস্থায় নিপাতিত হওয়া, সুলতানের ভগ্নি হেতিজা সুলতানের ( সেলমা এরগেচ ) সঙ্গে ইব্রাহিম পাশার প্রেমের সম্পর্ক , এবং আরও নানান সম্পর্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোই মূলত ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিকে ৷
যেসব দেশে প্রচারিত হয় ধারাবাহিক সুলতান সুলেমান:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন: তুরস্ক,আফগানিস্তান,আলবেনিয়া,আজারবাইজান,বাংলাদেশ,বুলগেরিয়া,চিলি,চীন,ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র,মিশর,এস্তোনিয়া,ফ্রান্স,গ্রিস,জর্জিয়া,হাঙ্গেরি,ইন্দোনেশিয়া,ইরান,ইসরায়েল,ইতালি,কাজাখিস্তান,কিরগিজিস্তান,কসোভো,লিথুয়ানিয়া,ম্যাসেডোনিয়া,মরক্কো,মন্টিনেগ্রো,পাকিস্তান,পোল্যান্ড,রোমানিয়া,রাশিয়া,সার্বিয়া,স্লোভাকিয়া,স্লোভেনিয়া,স্পেন,তিউনিসিয়া,ইউক্রেন,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম সহ বায়ান্নটির অধিক দেশের ২০ কোটি দর্শক উপভোগ করে এই টিভি সিরিজটি ৷ বাংলাদেশেও এই টিভি ধারাবাহিকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ৷ এটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দীপ্ত টিভিতে ২০১৫ সালের ১৮ই নভেম্বর থেকে বাংলা ভাষায় ডাবিং করে সুলতান সুলেমান নামে সপ্তাহে ৬দিনই সম্প্রচার শুরু করে। সম্প্রচারের একমাস পরই এটি দর্শকদের টিআরপি ভোটে বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠানমালার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে এবং নান রকম সমালোচনা ও বিরোধিতা সত্যেও তার দুই সপ্তাহ পর ২০১৬-এর দ্বিতীয় সপ্তাহে এটি সকল অনুষ্ঠানকে পেছনে ফেলে দর্শক জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থান দখল করে নেয়।
সমালোচনার মুখে টিভি ধারাবাহিক সুলতান সুলেমান:
তুরস্কে প্রথম ধারাবাহিকটি প্রচারের পর নানান দিক থেকে এর সমালোচনা শুরু হয়, দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এর নেতৃবৃন্দ, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী সংস্থা গুলোও এই নাটকের সমালোচনা করেন ৷ তারা অভিযোগ করেন এই নাটকে তাদের ইতিহাসের মহান নেতাকে বিতর্কিত ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ৷ ধারাবাহিকটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতা, মানহানিকর, ব্যক্তিগত গোপন বিষয়কে বিতর্কিত ভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ করা হয় ৷ তুরস্কের সর্বোচ্চ বেতার ও টেলিভিশন পরিষদ আরটিইউকে দাবি করে তাদের কাছে এই ধারাবাহিকটির বিরুদ্ধে ৭০ হাজারের বেশি অভিযোগ এসেছে ৷ এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিকটির সাথে সংশ্লিষ্টদের আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সতর্ক করেন ৷ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোয়ান(রেসেপ তায়িপ এরদোয়ান) ধারাবাহিকটির বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেন ৷ তাঁর মতে এই ধারাবাহিকের মাধ্যমে তুরস্কের বর্তমান প্রজন্ম তথা তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের ইতিহাসকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার একটি প্রচেষ্টা করা হয়েছে ৷ তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল একে পার্টির একজন সংসদ সদস্য ওকতায় সারাল “সুলতান সুলেমান” সিরিজে ঐতিহাসিক ব্যক্তিগণকে ভুলভাবে তুলে ধরার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবার হুমকি দেন। বিভিন্ন সংগঠন ধারাবাহিকটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্টুডিওর সামনে বিক্ষোভ করেন কিন্তু এতো কিছুর পরও নাটকটি তুরস্ক সহ সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ৷
সুলতানের পারিবারিক জীবন:
সুলতান সুলেমানের চার জন স্ত্রী ছিলো, এবং আট জন পুত্র সন্তান ও দুই জন কন্যা সন্তান ছিলো ৷ চার জন স্ত্রীর নাম যথাক্রমে মাহিজিবরান, খুররম(হুররম), গুলফাম ও ফুলেন ৷ আট জন পুত্রের নাম হলো সেলিম-২, বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোস্তাফা ৷ এছাড়াও তাঁর দুই মেয়ের নাম হচ্ছে মিহরিমান ও রেজায়ি ৷

সুলতান সুলেমানের প্রাথমিক জীবন:
সুলতান সুলেমান জন্ম গ্রহণ করেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তাঁর পিতা সুলতান সেলিম-১ এবং মা হাফছা সুলতান সন্তানকে যোগ্যতার হিসেবে গড়ে তুলতে পুত্রের চরিত্র গঠন ও যথাযথ শিক্ষা অর্জনের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন। সুলতানের দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার গুরু, দাদীর হাতেই সুলেমানের হাতেখড়ি এবং তিনিই সুলতানের প্রথম শিক্ষক। দাদীর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে সুলতান মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁর দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর নিকট যান তখন তাঁর দাদা ইস্তাম্বুলে থাকতেন ৷ ইস্তাম্বুলেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয় ৷ জগৎ বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন সুলতানের ওস্তাদদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর কাছেই সুলেমান বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন ৷ তাঁর অর্জিত জ্ঞানের বিষয়গুলো ছিলো ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল ইত্যাদি ৷
রাজ্য শাসনের দায়িত্বে সুলতান সুলেমান:
সুলতান সুলেমান মাত্র ১৫ বছর বয়সে সরকি প্রদেশের গর্ভনর নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও উক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় ৷ সুলতান সেলিম-১ ক্ষমতায় বসেন ১৫১২ সালে, ভাইদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জয়ী হয়েই তিনি ক্ষমতায় বসে ছিলেন ৷ তখনই তিনি তাঁর পুত্র সুলেমানকে ইস্তাম্বুলে আসার জন্য বলেন এবং সুলেমানের চাচাদের সাথে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর দায়িত্ব তাঁর হাতে দেন, তখন সুলেমান সরুহান প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন ৷ সুলেমানের পিতা সুলতান সেলিম-১ এর মৃত্যুর পর ১৫২০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান বা খলিফা মনোনীত হন ৷ সুলেমানের সিংহাসনে আরোহণের বিষয়টি ইতিহাসে খুবই বিরল কারণ, সুলতান হবার জন্য তাঁর নামটি প্রস্তাব করা হয় জনসাধারণ থেকে শুরু করে রাজমহলের মন্ত্রী, প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ সহ সকল শ্রেণির লোকজনদের কাছ থেকে ৷ এমন কোন লোক ছিলো না যে সুলেমানের সুলতান হবার বিষয়টির প্রস্তাবের বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন ৷ সর্বসম্মতিক্রমে ও বিতর্কহীন ভাবে শাসক নির্বাচনের এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব কমই আছে ৷ সবাই সুলতানকে চিনতো একজন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী ও ধার্মিক মানুষ হিসেবে ৷ তিনি সবসময় তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন ৷ তিনি জানতেন জনগণ তাঁকে সম্মানের সাথে মান্য করেন এবং তাঁর আনুগত্য করেন, একারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুলতান সুলেমান ছিলেন খুব দৃঢ়চেতা ৷ তিনি খুব প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন তাঁর প্রতিটি বক্তব্য ছিলো শিক্ষণীয় ও নির্দেশনামূলক। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতেন খুব বিচক্ষণতার সাথে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে এবং বিপর্যয়ের সময় কখনো ধৈর্য হারাতেন না।
সুলতান সুলেমানের মৃত্যু:
সুলতান সুলেমান ১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে অভিযান পরিচালনার সময় হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরে নিজ তাঁবুতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু ছিলো স্বাভাবিক, মূলত বার্ধক্যজনিত কারণেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ৷ মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিস্থল করা হয় অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল তথা বর্তমান ইস্তাম্বুলে ৷ তাঁর সমাধিস্থলের পাশেই তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণ করা হয় বিখ্যাত সুলেমানী মসজিদ ৷ যদিও তার কবর তুরস্কে কিন্তু প্রচলিত আছে যে সুলতানের হৃৎপিণ্ডটি হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরের আঙ্গুর ফলের বাগানে কবর দেয়া হয়েছিল। যদিও এই তথ্যের সত্যতার কোন ভিত্তি নেই তবুও গবেষকগণ সুলতানের হৃৎপিণ্ডের খোঁজে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ৷

আইন-প্রণেতা সুলতান সুলেমান:
আইন-প্রণেতা হিসেবে সুলতান সুলেমানের খ্যাতি বিশ্বজোড়া ৷ তাঁর আইন প্রণয়নের দক্ষতার জন্য তাঁকে ‘কানুনি’ বলা হয় ৷ তাঁর বাস্তব সম্মত আইন প্রণয়নের কারণেই তিনশত বছর ঐ আইন প্রয়োগের চর্চা ছিলো ৷ ইউরোপের আইনসমূহ তাঁর আইনগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তৈরি করা ৷ রাণী এলিজাবেথ এর সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্বর্ণযুগ পার করেছিলো তেমনি সুলতান সুলেমানের সময়ও অটোম্যান সাম্রাজ্য এক সোনালী সময় পার করেছে যার আলোয় আলোকিত ছিল তিনটি মহাদেশের বিশাল অঞ্চল ৷
মানব দরদী শাসক সুলতান সুলেমান:
সুলতান সুলেমান একজন প্রজা দরদী শাসক ছিলেন, সাধারণ জনগণের ভাল মন্দের কথা সব সময় চিন্তা করতেন ৷ তাঁর হৃদয়ে নিষ্ঠুরতার কোন স্থান ছিলো না ৷ একবার মিশরে খাজনা আদায়ের হার বৃদ্ধির তথ্য পেয়ে সুলতান খোঁজ নিয়ে দেখলেন যে সেই অঞ্চলের গভর্নর অতিরিক্ত খাজনা আদায় করেছেন তাঁর প্রজাদের নিকট থেকে ৷ তখন তিনি দ্রুততার সাথে সেই গভর্নর পরিবর্তন করেছিলেন ৷
প্রেমিক সুলতান সুলেমান:
সুলতান সুলেমান সাম্রাজ্য শাসনে কঠোর হলেও তাঁর হৃদয় প্রেমে পরিপূর্ণ ছিলও ৷
সুলতান সুলেমান তার “মুহিব্বি” নামক ছদ্মনাম ব্যবহার করে তাঁর স্ত্রী হুররেম সুলতানের জন্য কবিতা লিখতেন ৷ তাঁর লিখিত কবিতার বঙ্গানুবাদের কিছু লাইন উল্লেখ করা হলো:
“আমার গুল্ম, আমার মিষ্টি, আমার গোলাপ, এ জগতে একমাত্র সেই আমাকে কোন দুঃখ দেয় নি…
আমার ইস্তাম্বুল, আমার কারামান, আমার আনাতোলিয়ার পৃথিবী
আমার বাদাকশান, আমার বাগদাদ আর খোরাসান
আমার সুকেশী রমণী, আমার হেলানো ভুরুর প্রণয়, আমার দুষ্টুমিভরা চোখের প্রেম…
আমি সর্বদা তোমার গুণ গাইবো
আমি, এই ভগ্ন হৃদয়ের প্রেমিক, অশ্রুভরা চোখের মুহিব্বি (প্রেমিক), আমিই তো সুখী ৷”
সুলতান সুলেমান অটোম্যান সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর কয়েকশ বছর পরও অটোম্যান সাম্রাজ্যে টিকে ছিলো ৷ সর্বশেষ ১৯২১ সালে বিলুপ্ত হয় অটোম্যান সাম্রাজ্য তথা তুর্কী খেলাফত ব্যবস্থা ৷ কিন্তু, ইতিহাসের সেই মহানায়ক সুলতান সুলেমানকে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির করার মাধ্যমে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ইতিহাস সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে ৷ যা বাস্তবের ইতিহাসের মতোই দখল করে নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শকের হৃদয় ৷
তথ্যসূত্রঃ
১. www.theguideistanbul.com
২. www.dailynayadiganta.com
৩. www.prothomalo.com