হয়তো শুনে অবাক হবেন আজ প্রায় ২০০ বছর ধরে ইংরেজ সরকার ১৮১১ সালে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের মধ্যকার যুদ্ধে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে লড়ার নিমিত্তে তৎকালীন জার্মানের ইহুদী এক পরিবারের কাছ হতে ধার করা অর্থ সাম্প্রতিক ২০১৫ সাল অবধি পরিশোধ করে আসছে। নাম জানতে চান কে সেই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক পরিবার ? কি তাঁদের ইতিহাস ? কেনোই বা ইংরেজ সরকার আজও তাঁদের কাছে কর্জ পরিশোধ করছে ?
তবে ফিরে যাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন অর্থের সমার্থক শব্দ হিসেবে কেউ যদি বলতো রথচাইল্ড পরিবার তবে একটুও বাড়তি হবে না কারণ এ পরিবারের উৎপত্তি যার হাতে তিনি ছিলেন একজন ইহুদী বংশোদ্ভূত জার্মানী ব্যাংকার এবং রথসচাইল্ড ব্যাংকিং ডাইনেস্টির প্রতিষ্ঠাতা, যাকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাটা পিতাও বলা হয়ে থাকে। যিনি ছিলেন ফোর্বস ম্যাগাজিনের সর্বকালের ২০ জন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৭ নম্বর স্থানে। জন্ম তার ১৭৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী মাসে জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্টে। তাঁর নাম “মায়ের আমশ্চেল রথসচাইল্ড”। তিনি ব্যবসায়িক মূলধন সরবরাহ, রেলওয়ে, সুয়েজ খাল নির্মানের জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। যার অর্থসম্পত্তির অর্থমূল্য প্রায় ৩০০ বিলিয়নের কাছাকাছি।
পিতা ‘আমশ্চেল মসেস রথসচাইল্ড’ ছিলেন পণ্য কেনাবেচা এবং মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসা এবং ছিলেন হেসে’র রাজপুত্র ওয়েলহেলমে’র নিজস্ব সংগ্রহীতব্য মুদ্রার সরবরাহকারী। তখনকার যুগে ইহুদীদের বৈধগতভাবে ছোটস্থানে বসবাস করা লাগতো খ্রিস্টানদের হতে দূরত্ব বজায় রেখে, এমনকি তারা খ্রিস্টানদের ছুটিরদিনে, রবিবারেও তাদের গ্রামে থাকার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিল না।
আটজন সন্তানসহ তারা ছিলেন একই পরিবারের ৩০ জন সদস্যের একটা বড় পরিবার যাদের দোকানের উপর বিদ্যমান ছিল মাত্র ৩.৪ মিটার পুরত্বের একটা দেয়ালসমেত। তার মাতাপিতার মৃত্যু হয় মাত্র ১২ বছর বয়সেই। তার মাতাপিতার ইচ্ছে ছিল তাঁদের ছেলে একজন শ্রেষ্ঠ তোরাহ মাস্টার (রাব্বি) হবেন ইহুদী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে। ১৩ বছর বয়সে সে সিদ্ধান্ত নেয় হ্যানওভারে একটি ব্যাংকিং ফার্মে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদানে এবং খুব অল্পসময়েই সে ব্যাংকিং সেক্টরের অভ্যন্তরীণ সবকিছু রপ্ত করে নেয়।
হয়তো পরে অন্য আর্টিকেলে ‘মায়ের আমশ্চেল রথসচাইল্ড’ সম্পর্কে জানা যাবে তবে এর আগে জানা যাক তার ছেলে ‘নাথান রথসচাইল্ড’ এর সাফল্যগাঁথা সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য। নাথান ছিলেন আমশ্চেল দম্পত্তির চতুর্থ পুত্র যে পরবর্তীতে বড় সাফল্য লাভ করে তারই কূট বুদ্ধিমত্তার দাপটে। কেনো কূট বুদ্ধিমত্তা বলা হয়েছে তা নিচের বর্ণনাতেই বুঝা যাবে।
তখনকার যুগে রথসচাইল্ড এন্টারপ্রাইজই ছিল প্রথম ব্যাংক যা দেশের সীমানা অতিক্রম করে পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। নাথান ছিলেন সম্মুখভাগে, যিনি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ছড়িয়ে দেয়ার অগ্রদূত। নাথান একজন মধ্যস্থতাকারী অর্থখাতের রুপে দেখা দেয় যা ইউরোপের রাজাদের হয়ে খরিদে, জাতীয় ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার এবং দেশের অবকাঠামোতে অর্থায়ন যেমন রেলপথ যা শিল্পবিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছিলো।
১৭৯৮ সাল…।। মায়ের রথসচাইল্ডের সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাধর এবং কর্মঠ ছিলো নাথান মায়ের রথসচাইল্ড। মাত্র ২১ বছর বয়সে ফ্রাঙ্কফুর্ট ছেড়ে পাড়ি জমান ম্যানচেস্টার। পিতা মায়ের আমশ্চেল রথসচাইল্ড প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্বেও খুব সাধারণভাবে নাথান ইংল্যান্ডে স্থানান্থর হয়ে মাত্র ২০ হাজার ডলার মূলধন নিয়ে একটা বুননশিল্প কেনাবেচার ব্যবসা স্থাপন করে যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১.৯ মিলিয়ন ডলারের সমান। পাশাপাশি ২৭ বছর বয়সে সে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে স্টক কেনাবেচা শুরু করলো। ইতিমধ্যে সে একটি ব্যাংক স্থাপন করে যার নাম ছিল N.M Rothschild & Sons. Ltd. নামে। ফার্মটি দেশটির চলমান ৭ টি পুরাতন ব্যাংকের অন্যতম যা আজও রথসচাইল্ড পরিবার কর্তৃক পরিচালিত যার ২০১৪ সালের শেষের দিকে নীট লাভের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ডলার যা অন্যান্য রথসচাইল্ড ব্যাংকের মতোই পুরো ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত। N.M Rothschild & Sons. Ltd. সরকারকে অর্থায়ন করতো যুদ্ধকালীন সময়ে।
তার দুরন্তর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পায় ১৮১১ সালে নেপোলিয়নের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। তাঁর প্রতিষ্ঠান সে সময়কালে ব্রিটিশ সরকারকে বিভিন্ন প্রকার আর্থিক সহায়তা এবং ভর্তূকি প্রদানে সহায়তা করতো যা ব্রিটিশ সরকার তাঁদের সাহায্যকারী মিত্রদের পাঠাতো এবং ব্রিটিশ সেনাদলের ফান্ডের কাজে ব্যবহৃত করত। বলতে গেলে একপাক্ষিক ব্রিটিশ যুদ্ধের সহায়তায় সাহায্য করতো নাথানের প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু মজার বিষয় হলো একইসাথে সে প্রতিপক্ষ দল নেপোলিয়নকেও অর্থ সহায়তা প্রদান শুরু করলো গোপনে যেহেতু ফ্রান্সেরও তাদের সৈণ্যদের অর্থপ্রদানের নিমিত্তে অর্থের খুব প্রয়োজন ছিলো। নাথান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুপাক্ষিক যুদ্ধকে তার ব্যবসা সম্প্রসারণের সম্বল হিসেবে ব্যবহার করতে লাগলো। তার মুল উদ্দেশ্য ছিলো দু পক্ষকে অর্থের যোগান দিয়ে দু পক্ষ হতেই সুবিধা গ্রহণ করা।
দিন ছিল জুলাই মাসের ১৮ তারিখ, ১৮১৫ সাল। ইংরেজ সরকারের নিজস্ব এজেন্ট কুরিয়ার জানালো যে নেপোলিয়ন Waterloo তে পরাজিত হতে যাচ্ছেন। তবে ইংরেজ সরকার নেপোলিয়নের পরাজিত হওয়ার খবর অবিশ্বাস্য মনে করে উড়িয়ে দিয়ে কুরিয়ার সংবাদ প্রত্যাখ্যান করলো এবং এটাকে মিথ্যে সংবাদ বলে অভিহিত করলো। এহেন মুহূর্তে, ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ ভয়াবহতার সম্মুখীন দেখে রথসচাইল্ড তাদের সকল বন্ড বিক্রি করতে আরম্ভ করলো এবং সবার কাছে এটা বিশ্বাসযোগ্য করতে আরম্ভ করালো যে নেপোলিয়ন যুদ্ধে জিতেছেন এবং খুব শীঘ্রই ইংরেজ সরকারের বন্ডের মূল্যহীন হয়ে পড়বে তাই বেঁচে দেয়াই শ্রেয়। যেহেতু রথচাইল্ড প্রতিষ্ঠানের বিশ্বস্ত এবং সম্মানী বিনিয়োগকারী হিসেবে সুনাম ছিলো তাই ইংরেজরা সহজেই তার কথা শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যার ফলাফল গণহারে বন্ড বিক্রি করা শুরু করে যার ফলে নিমেষেই লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে এক বিরাট ধ্বস নামিয়ে আনে। ঠিক যেনো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল নাথান এবং খুব দ্রুত তার নির্দেশে রথসচাইল্ড এজেন্টরা খুব কম মূল্যে বেঁচে দেয়া সেসব বন্ড সংগ্রহ করে নেয় এবং ইংরেজ সরকার যুদ্ধক্ষেত্রের সত্যতা জানার আগেই রথসচাইল্ড প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ডের সেন্ট্রাল ব্যাংক, “ ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড “ এর কর্তৃত্ব দখলে নিয়ে নেয়।
বলাবাহুল্য যে তার এ কাজের দরুন বহু মানুষের কষ্টে সঞ্চিত অর্থ এবং জীবিকা বিসর্জন দিতে হয়েছিলো অনিচ্ছাসত্ত্বেও। যতোদিনে ইংল্যান্ডের শাসকেরা ঘটনার সত্যতা বুঝতে পেরেছিলো ততোদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। নিরুপায় হয়ে জার্মানের “রেড শিল্ড” (রথসচাইল্ড) এর হাতে সবকিছু হস্তান্তর করতে তারা বাধ্য ছিলো যেহেতু কারো কাছে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণই ছিলো না নাথানের এহেন কর্মকান্ডের।
তারই ঠিক দুইদিন পরে ওয়েলিংটন দূত নিশ্চিত করে নেপলিয়নের পরাজয়ের কথা কিন্তু ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ড স্টক এক্সচেঞ্জ পুরোপুরি নাথানের দখলে চলে এসেছিলো। আরো মজার বিষয় হলো, ২০১৫ সাল অবধি আজও ইংরেজ সরকার রথসচাইল্ড পরিবারকে অর্থ পরিশোধ করছে যা নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে ধার করা হয়েছিলো। হ্যা, আজ প্রায় ২০০ বছর ধরে সে কর্জ আজও পরিশোধ করতে হচ্ছে ইংল্যান্ড সরকারের।
নাথান তৎকালীন সময়ের কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরই একটি বাণী ছিলো,
“ Buy on the sounds of cannons, sell on the sound of trumpets. ”
যদিও নাথান তার জীবনকালে ইহুদী সম্প্রদায়ের জন্যে অনুদান দিয়েছিলেন। পরে তার পরিবার অনুদান কার্যক্রম ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডের অন্যান্য জনপদের মাঝেও বিস্তৃত করেন। বর্তমানে তাঁদের অধীনে প্রায় ৩০ টি ফাউন্ডেশন চলমান যার মধ্যে পাবলিক লাইব্রেরী, এতিমখানা, হসপিটাল, বৃদ্ধাশ্রম, শিক্ষার নিমিত্তে গড়া স্পেশাল ফান্ড যার মধ্যে লন্ডনে অবস্থিত “ The Jew’s Free School “ অন্যতম। তাছাড়াও অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স এবং ইসরায়েলেও ছড়িয়ে পড়েছে তাদের এই ব্যবস্থা।
নাথানকে দোষী সাব্যস্ত করতে যদিও আইন খুঁজে প্রমাণ যা ছিলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাই তিনি স্থান করে নিয়েছিলেন ফোর্বস ম্যাগাজিনের অন্যতম সেরা ব্যবসায়ীদের স্থানে। ব্যবসায়িক ভাষায় তিনি ছিলেন সফল কিংবদন্তীদের তালিকায়। তিনি ছিলেন একাধারে একজন দাতা, সফল ব্যবসায়ী এবং তৎকালীন দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন ব্যক্তি।
দিনটি ছিলো ২৮ জুলাই ১৮৩৬ সাল যেদিন নাথান মায়ের রথসচাইল্ড মৃত্যুবরণ করেন তবে এর আগেই পৃথিবীর বুকে রথসচাইল্ড পরিবারের যে ভিত্তিটা গেঁথে দিয়ে যান তা আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিদশকে এসেও।
পরবর্তী পর্বের জন্য চোখ রাখুন………
Source:
https://www.investopedia.com/updates/history-rothschild-family/
https://www.investopedia.com/updates/history-rothschild-family/
https://www.snopes.com/rothschild-family-wealth/