ন্যাটো: একটি বহুজাতিক সামরিক সংগঠন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব ছিল সন্দেহ, অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার যুগ। দেশে-দেশে, মহাদেশে-মহাদেশে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দুই পরাশক্তির বিশ্বব্যাপী আধিপত্য। একদিকে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র যে কোন মূল্যে প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়নকে থামাতে বদ্ধ পরিকর ছিল। আর তারই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে গড়ে উঠে ন্যাটো ( নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে ইউরোপের নিরাপত্তা বাস্তবায়ন করা। কোল্ড ওয়ারের স্ট্রাটেজির অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল ন্যাটো । ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হলেও সংগঠনটি এখনো তার আধিপত্য বজায় রেখেছে। ব্রাসেলসে এর সদরদপ্তর অবস্থিত। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর কিছুটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে জোটটি।
ন্যাটো সৃষ্টির পটভূমিঃ
১৯৪৫ সালে যুদ্ধের পরই যে বিশ্ব দুই ব্লকে ভাগ হয়ে যায় তার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল একটা সামরিক জোট তৈরি করা। যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতকে দমানোর জন্য পশ্চিম ইউরোপকে কাজে লাগানোর একটা রূপরেখা তৈরি করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্র ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ছিল তখন অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ভঙ্গুর। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকেই কিছু একটা করার উদ্যোগ নিতে হয়। এরমধ্যেই ১৯৪৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নেত দেশগুলো রাশিয়াকে কেন্দ্র করে শাসন পরিচালনা শুরু করে যা “আয়রন কারটেইল” নামে পরিচিত। এসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ইউরোপীয় অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে মার্শাল প্লানের মাধ্যমে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা প্রেরণ করে যাতে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনয়ন সম্ভব হয়। এর পাশাপাশি ব্রাসেল ট্রিটির মাধ্যমে সামরিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে ন্যাটো প্রতিষ্ঠার মূল কাজ আগাতে থাকে।
ন্যাটো গঠন ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল ১২ টি দেশের সমন্বয়ে এই নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি (যা ওয়াশিংটন ট্রিটি নামেও পরিচিত) বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে স্বাক্ষরিত হয়। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ সমূহের স্বাধীন অখণ্ডতা বজায় রাখা ছিল এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। চুক্তির পঞ্চম আর্টিকেলে সংগঠনটির মূলনীতিতে বলা আছে যে,” ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় সংগঠনটির কোন সদস্য দেশ বা দেশসমূহের অন্য কোন দেশ সামরিক হামলা করলে তা সংগঠনের সকল সদস্যের উপর হামলা হিসবে বিবেচিত হবে। আর যদি এমন হামলা হয় তাহলে জাতিসংঘ চার্টারের ৫১ নং আর্টিকেল অনুযায়ী একক অথবা সংঘবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবেলা করা হবে। প্রয়োজনে সামরিক হামলাও চালানো হবে এবং উত্তর আটলান্টিক এর দেশসমূহের নিরাপত্তা বজায় রাখা হবে।”
এছাড়াও গণতন্ত্র বাস্তবায়ন ও ইউরোপ ও আমেরিকা তথা বিশ্ব নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠনটি কাজ শুরু করে। ইউরোপের সকল দেশের জন্য সংগঠনটি উন্মুক্ত রাখা হয়।
১৯৫০ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র হুশিয়ারি সংকেত পেয়ে যায়। এবার যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে থানানোর জন্য কন্ট্রেইনমেন্ট পলিসি নিয়ে সামনে আসে। এরপর আস্তে আস্তে যুক্তরাষ্ট্র পিছন থেকে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটিকে সংগঠনের রূপ দান করে। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ডেলিগেশন চলতে থাকে। এবং ন্যাটো এভাবেই একটি সংগঠন হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
ন্যাটোর উদ্দেশ্য
ন্যাটো কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়।
প্রথমত, ন্যাটো সদস্য দেশ সমূহের অখণ্ডতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে পুতিনের নেতৃত্বে ক্রিমিয়া দখল ইউরোপীয় দেশসমূহকে আবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ন্যাটো ৪০০০ সংখ্যা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে ইউক্রেন রক্ষাও এখন ন্যাটোর একটা অন্যতম কাজ বটে।
দ্বিতীয়ত, ছোট দেশগুলোকে রাশিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা। যেমন আইসল্যান্ড এর মতো তিন লক্ষাধিক মানুষের দেশও ন্যাটো ভুক্ত দেশ।
তৃতীয়ত, সমাজতন্ত্র মতবাদকে ঠেকানও ছিল ন্যাটোর অন্যতম উদ্দেশ্য। কেননা এক দেশে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে গেলে পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহেও সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
চতুর্থত, ন্যাটো সদস্য দেশ সমূহের মধ্যে সমস্যা দেখা দিলে তা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধা করা।
পঞ্চম, সহযোগিতার মাধ্যমে সদস্য দেশ সমূহের মধ্যে সম্পর্কন্নোয়ন করা।
ষষ্ঠত, দেশের সার্বভৌমত্ব ঠিক রেখে সকল দেশ একক হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।
ন্যাটো সদস্যঃ
বর্তমানে ন্যাটো সদস্য সংখ্যা ২৮। ১২টি দেশের মধ্য দিয়ে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তুরস্কের মতো দেশও ন্যাটোর পূর্ণ সদস্য হতে উদগ্রীব। ইউরোপীয় বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, নরওয়ে সহ ইউরোপর বাইরের উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে প্রথম ন্যাটো গঠন করে এবং চুক্তি সই করে। যদিও গ্রিস ও তুরস্কও ১৯৫২ সালে এই ট্রিটিতে সই করে সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮২ সালে ন্যাটোর সাথে যুক্ত হয় স্পেন। এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়লে এর প্রাক্তন সদস্য যারা ওয়ারর্শ পাক্টের অন্তর্ভুক্ত ছিল তারাও ন্যাটোতে যোগ দিতে শুরু করে। প্রথমেই ১৯৯৯ সালে এগিয়ে আসে পোলান্ড, হাঙ্গেরি ও চেক রিপাবলিক। ২০০৪ সালে যোগ দেয় আরো কয়েকটি দেশ। তন্মধ্যে ছিল বুলগেরিয়া, এস্তনিয়া,লটেভিয়া,রোমানিয়া,স্লোভাকিয়া ও স্লোভানিয়ার মতো সদ্য স্বাধীনতালাভকারী দেশ সমূহ। ২০০৯ সালে যুক্ত হয় ক্রোয়েশিয়া ও আলবেনিয়া। আর ২০১৭ সালে সর্বশেষ সদস্য হিসেবে যুক্ত হয় মন্টিনেগ্রো। খুব সম্প্রতি ফ্রান্সও আবার ন্যাটোতে ফিরে আসে।
ন্যাটোর সাম্প্রতিক কার্যক্রমঃ
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর মনে করা হয়েছিল যে ন্যাটোর আর দরকার নেই। কিন্তু ন্যাটো আবার নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠনকে ঢেলে সাজানো হয়। ১৯৯১ সালে গড়ে উঠে নর্থ আটলান্টিক কো-অপারেশন কাউন্সিল যার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের নিরাপত্তা বজায় রাখা। ১৯৯৪ সালে বহুজাতিক সৈন্যদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় পার্টনারশিপ ফর পিস। ১৯৯৫ সালে প্রথম বসনিয়া হার্জেগোভিনায় সার্বদের বিরুদ্ধে ন্যাটো আক্রমণ করে এবং শান্তিচুক্তির পথে ধাবিত করে। ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ায় বড় ধরণের হামলা করে ন্যাটো ও মুসলিম দেশ কসাভো স্বাধীন হয়। এখানে ন্যাটো শান্তিরক্ষী মিশন প্রেরণ করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলা হলে ন্যাটো আবার মাঠে নামে। ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে ন্যাটো তালেবান লাদেন সরকারকে পতনের উদ্দ্যেশ্যে হামলা করে যা এখনো চলমান। এরপর সর্বশেষ ২০১১ সালে গাদ্দাফি সরকারকে পতনের জন্য ন্যাটো আরেক দফা আক্রমণ চালায়। রাশিয়াকে কেন্দ্র করে ন্যাটো আবারো সংগঠিত হতে শুরু করছে কিন্তু ট্রাম্প কতটা এতে ভূমিকা রাখতে পারবে তা এখন দেখার বিষয়।
buy rybelsus generic – glucovance order desmopressin sale