গত কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের বিভিন্ন বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলসমূহের নানারকম কর্মসূচি ও উৎসব উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে গেল বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তি। নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই প্রথম মার্ক্সীয় আদর্শের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রের উত্থান এবং ঠিক শতাব্দীর শেষের দিকেই আকস্মিকভাবে এর পতন পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে রয়েছে। প্রশ্ন চলেই আসে যে, এত দ্রুত পৃথিবীতে সমজাতন্ত্র ছড়িয়ে গিয়েও কেন এর জন্মস্থান রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পথন ঘটল? আর এই পতনই পৃথিবী থেকেই সমাজতন্ত্র বিলুপ্তের ইংগিত দেয়। যদিও পৃথিবী থেকে এখনো সমাজতন্ত্র সম্পূর্ণ মুছে যায়নি।

চীন, কিউবা, লাওস, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম সহ কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনো বিদ্যমান রয়েছে তবে তা সমাজতন্ত্রের আদলে ভিন্ন রূপে। যাহোক সমাজতন্ত্রের একটু তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কথা বলা যাক। মার্ক্স ও তার বন্ধুবর এঞ্জেলস মিলেই মূলত এই তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন। মার্ক্সের দাস ক্যাপিটাল প্রথম ১৮৬৭ সালে এর একাংশ প্রকশিত হয় যা কিনা সমাজতন্ত্রের বাইবেল নামে খ্যাত। তিঁনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিল্পব দেখে মজুর তথা প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হন। পুঁজিবাদের উত্থানকে তিঁনি সমাজতন্ত্রের ভিত্তিভূমি গড়ে দেয়ার জন্য আবশ্যক বলে মনে করেন এবং বৈজ্ঞানিকভাবে দেখান যে একসময় সমাজের সর্বহারা মানুষ পুঁজিপাতিদের তাড়িয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। এবং তিনি এমন এক সমাজের প্রতি ইংগিত দেন যে সমাজ হবে সমগ্র পৃথিবীময় এবং শ্রেণী শোষণহীন রাষ্ট্রীয় সীমানা বিহীন। সমাজের সবাই হবে সুখ দুঃখ ভালো মন্দের সমান অংশীদার। অর্থাৎ প্রাগৈহাসিক সমাজের মতো শিকারি ও শিকার সংগ্রহকারী দুজনই সমান ভোগ কর।

এবার আসা যাক বলশেভিক বিল্পবের দিকে। লেনিন নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের পণ্ডিত ছিলেন। পাশাপাশি তিনি একজন বিশাল নেতাগুণচীত ব্যক্তিত্বও ছিলেন। এই মহানপুরুষের হাত ধরেই এই ধরণীর বুকে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তিনি ১৯১৭-১৯২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে রাশিয়াকে মোটামুটি সুসংহত করেন। তিনি প্রথমে ক্ষমতায় আরোহণ করেই টের পেলেন যে মার্ক্সের নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠন করা অসম্ভব প্রায়। এখান থেকেই শুরু মার্ক্সবাদের চ্যুতি। যেখানে মার্ক্সাস চেয়েছিলেন শ্রেণিহীন এক সমাজ সেখানে সরকার থেকেই সমাজের মধ্যে তৈরী করা হল একটি এলিট শ্রেণি। তারা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ। তারা সাধারণ মানুষের শিক্ষক বলে বিবেচিত হতো। ফলে দেখা গেল যে মার্ক্সের সেই সমাজভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটি উপেক্ষিত রয়ে গেলো। প্রান্তিক মানুষজনেরও আর প্রতিনিধিত্ব থাকলো না। এলিট শ্রেণিই সাধারণের রক্ষক ও সিদ্ধান্ত প্রণেতায় পরিণত হলো। দিনদিন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংগ্রহ কমে যাচ্ছিল। আর প্রান্তিক মজুর শ্রেণি তো ছিল সবথেকে পিছিয়ে। এরপর দেখা গেল যে, প্রান্তিক মজুর শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করার আর কেউই রইলো না। এই এলিট শ্রেণিই সব ঠিক করে দিচ্ছিল। অর্থাৎ যাদের স্বার্থে এত বিপ্লব এত কিছু, তাদের বাদ দিয়েই সব চলছিলো।

লেনিন কিছুটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও স্টালিন ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত। অনেকটা পাগলা ষাঁড়ের মতোই ছিল তার শাসন পরিচালনার রীতি। সর্বময়ক্ষমতা অল্প কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। জনজীবনে স্বাধীনতা বলতে কিছুই আর বাকি রইলো না। স্টালিন পরিণত হলে সর্বাত্মকবাদী স্বৈরাচারের প্রতিমূর্তিতে। ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেটি কিনা ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিতকরণের অন্যতম হাতিয়ার। বইটিতে দেখানো হয়েছিল যে, কিভাবে জারের গোয়েন্দারা জনজীবন স্থবির করে দিয়েছিলো ; পুলিশি নজরদারির বাইরে কেউ ছিলনা এবং কাজে যাবার জন্য কি মর্মমভাবেই না জার শাসকরা জনগণকে বাধ্য করতো। স্টালিনের সময়কালও ছিল সেই জার শাসনের আরেক প্রতিচ্ছবি। সিক্রেট পুলিসের নজরদারীতে বন্দী হয়ে গিয়েছিলো রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ড। শহরায়নের নামে বাধ্য করা হয়েছিল গ্রামীণ জনগণকে শহরে থাকার জন্য। ১৯২৯ সাম্পূর্ণ অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এরপর খোলা হয়েছিলো শ্রমিক বন্দিশালা, যেখানে চলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে সীমাহীন বর্বরতা। এমনও সময় ছিল যখন প্রায় দশ মিলিয়ন মনুষকে এসব বন্দীশালাগুলোতে জোর করে কাজ করানো হত। সরকারকে নিয়ে কোন কথা বললেই তাকে এসব বন্দীশালায় আমৃত্যু আটকে রাখা হতো। সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন নিয়ম ছিল যে, যারা শুধু কাজ করতে পারবে তারাই খাদ্যা পাবে। মার্ক্সের যে ধনী দরিদ্র, সামর্থ্যবান, অক্ষম সবার জন্য যে সমান সুযোগ সুবিধার কথা বলা হয়েছিল তা শুধু কল্পনাতেই রয়ে গেল।

বিশেষ বিশেষ শ্রেণির জন্য গড়ে উঠেছিলো বিশেষ বিশেষ সুযোগ সুবিধা আর এলিট শ্রেণির জন্য তো সবই ছিল অবাধ যা অনেকটাই পুঁজিবাদের অনুকরণ বলা চলে। একটা জোকস না বললেই নয়। একবার স্টালিন তার মাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার শীতকালীন অবকাশ জাপন কেন্দ্র দেখাচ্ছিল,আবার গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প দেখাচ্ছিল। তার মা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কমিউনিস্ট কমরেডরা এগুলোর কথা জানে কিনা? স্টালিন নীরব থেকেছিলেন। শাসক শোষকের ভেদাভেদ যে দূরভীত হবার কথা ছিল তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। দেখা যাচ্ছে শ্রেণি ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের নামে স্বয়ং সরকারই সমাজে বৈষম্য তৈরি করে দিয়েছিল। যা মার্ক্স কখনো ভুলেও প্রত্যাশা করেননি।

লেনিন তাঁর বিখ্যাত বই “সাম্রাজ্যবাদ শোষণের সর্বচ্চ স্তর” বইতে পুঁজবাদকে তুলোধোনা করেন কিন্তু দেখা গেল যে এই যে,এই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নই একসময় সাম্রাজ্যবাদীতার দিকে ধাবিত হতে থাকলো। ইউরোপীয় দেশগুলোকে গ্রাস করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে স্বাধীন করার নামে সোভিয়েত মডেলের সমাজতন্ত্র পাচার করার একটা চেষ্টা চালায়। ন্যামের অধিবেশনে নেহেরু যথার্থই বলেছিলেন যে,”সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকা, দুজনেই এক ডালের দুই ফল।” দিনশেষে দেখা গেল যে, সবাই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। সময়ে সময়ে একেকজন শাসক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্রু করে ক্ষমতায় আসেন আর চালাতে থাকেন সীমাহীন স্বৈরাচারী ক্ষমতা। আর এভাবেই সমাজতন্ত্রের নামে যে স্বৈরাতন্ত্র রাশিয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নব্বুইয়ের দশকের শুরুর দিকে এসে ভেঙ্গে পড়ে। অনেক আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও গর্বাচেভ যেই সংস্কারে হাত দিলেন তাতেই এর সমাপ্তি ঘটে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে হয়ে যায় আরেকটি বিল্পব যা হচ্ছে সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন।

অনেকে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতনপকে মার্ক্সবাদের পতন হিসেবে দেখেন। এটা ঠিক নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনোই সত্যিকারের মার্ক্সবাদের অনুসরণ করেনি বরং নিজেরা ভুলভাবে মার্কবাদের ইচ্ছেমত ছুড়ি কাচি লাগিয়ে নগ্নভাবে সংস্করণ করেন। আর এর ফলেই শতাব্দীর পার হবার আগেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। অনেকে পশ্চিমা তাই রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতনকে এই পৃথিবী থেকে মার্ক্সাবাদের পতন হিসেবেই চিহ্নিত করেন। ব্রেজনেসকি বলেন যে, গত শতাব্দীর কিছু যদি ইতিহাসে যায়গা পায় তাহলে তা হল সমজাতন্ত্রে উত্থান ও পতন। ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা তার বিখ্যাত বই “দ্যা ইন্ড অফ হিস্ট্রি এন্ড দ্যা লাস্ট ম্যান“(১৯৯২) দেখান যে, “সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের সাথে সাথে সমাজতন্ত্রের কোন আর ভিত্তিই নেই এবং এটি মানুষের চাহিদা পুরোপুরি পূরণে ব্যর্থ। পুঁজিবাদই যথেষ্ট,আমরা ইতিহাসের শেষ স্তরে পৃথিবীতে চলে এসেছে। আর কোন বিপ্লবের প্রয়োজন নেই।পুঁজিবাদই সকলের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট।” ফুকিয়ামা যতই পুঁজিবাদের তোষামোদ করুকনা কেন এটি যে বর্তমানে সমাজে প্রকট অসমতা ও বিভাজন তৈরি করছে তা দৃশ্যমান। ধনি দরিদ্রের মধ্যে বিভাজন দিনদিন ক্রমশ বেড়েই চলছে। উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনই এর প্রকৃত উদহারণ। সুতরাং এটা হলফ করে বলার সুযোগ নেই যে,পুঁজিবাদই একমাত্র ও সর্বশেষ সমাধান। এই পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়,সবই পরিবর্তনশীল। হয়ত নতুন কোন মতাদর্শই আবার পুঁজিবাদকে হটিয়ে যায়গা করে নিবে। এটাই ইতিহাসে মূল্যায়ন, পুরানকে নতুনের জন্য যায়গা করে দিতে হয়। এটাই পরিবর্তনের ধারা।
রেফারেন্সঃ
১, আইডিওলজি ; ম্যাকিডিলস
২, বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর; তারেক সামসুর রেহমান
৩,উইকিপিডিয়া.কম
Eralsdiaroro microzide side effect skaxife