জেনে নিন বিশ্বের ৯টি বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে
স্মৃতিস্তম্ভ এমন এক কাঠামো যা স্পষ্টতই কোন এক বিশেষ ব্যক্তির স্মরণে, ইতিহাসের বিশেষ কোন ঘটনার সাক্ষী অথবা কেবলই ঐতিহাসিক স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবে সৃষ্ট । পৃথিবী বিখ্যাত এই স্মৃতিস্তম্ভগুলোর কথা কারোরই অজানা নয়। তবে এমন কিছু স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে যার মধ্যে কিছু নিদর্শন কম বিখ্যাত এবং যেগুলোর ব্যাপারে সকলের জানাও নেই। এই প্রত্যেকটি নিদর্শন কোন না কোন সংস্কৃতির পরিচয় বাহক, কোন বিশেষ অর্থবাহক অথবা কোন যুগের, স্থানের, বিশ্বাসের, দেশের অথবা কোন শহরের প্রতিনিধি। পৃথিবীর এমনই ৯ টি বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল-
তাজমহল
ভারতের উত্তর প্রদেশর আগ্রায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন “রাজপ্রাসাদ এর মুকুট” খ্যাত তাজমহল মূলত সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি এক সমাধি স্তম্ভ। তাজমহলের বাম পাশে “মিহমান খানা” বা সমাবেশ হল আর ডান দিকে তাজমহল মসজিদ রয়েছে এবং এই দুই ভবন দেখতে অনেকটা একই রকম। মুঘল সম্রাট শাহজাহান এর তৃতীয় বেগম মমতাজ মহল এর স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তাজমহল গড়া।
সারা বিশ্বে তাজমহল “ভারতে মুসলিম শিল্পের অলঙ্কার” হিসেবে পরিচিত এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যবাহী শিল্প নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। প্রায় ৫৫২ একর জায়গার উপর তাজমহলের রাজত্ব যার ৩৮ হেক্টর জায়গার উপর তাজমহল এবং বাকি ১৮৩ হেক্টর জায়গা জুড়ে তাজ রক্ষাকারী বন। পৃথিবী বিখ্যাত এই নিদর্শন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য সমূহের মধ্যে অন্যতম এক আশ্চর্য।
মিশরীয় পিরামিড
২০০৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, মিশরে এই পর্যন্ত ১৩৮ টি পিরামিডের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যার বেশিরভাগই তৈরি করা হয়েছে প্রাচীন রাজ্য ও মধ্য রাজ্যের সময়কার ফারাও এবং তাদের রানীদের সমাধি হিসেবে। প্রথম দিকে যে পিরামিডগুলো খুঁজে পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই মেম্ফিস এর উত্তর-পশ্চিমে সাক্কারায় অবস্থিত।
প্রাচীন পিরামিডগুলোর মধ্যে সবথেকে পুরনো পিরামিড রাজা জোসের এর পিরামিড (নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব ২৬৩০-খ্রিষ্টপূর্ব ২৬১১) যা নির্মাণ করা হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক মিশরের ৩য় বছরে। এই পিরামিড এবং আশেপাশের স্থাপনাগুলোর নকশাকার ছিলেন স্থপতি ইমহোটেপ আর পৃথিবীর সবথেকে পুরনো স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন হিসেবে এই পিরমিডই বিবেচিত।
চীনের মহাপ্রাচীর
চীনের মহাপ্রাচীর পাথর, পোড়া মাটি, ইট, কাঠ , এবং অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি প্রাচীরের দীর্ঘ সারি। এই প্রাচীর চীনের উত্তর সীমান্তে স্থাপন করা হয় তৎকালীন সম্রাট ও সাম্রাজ্য প্রতিরক্ষা এবং পরশক্তির অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে। এই প্রাচীরের কিছু অংশের নির্মাণকাজ খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতক থেকেই শুরু হয়।
পরে সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে তা আরো দীর্ঘ, বিশাল এবং শক্তিশালী করে নির্মাণ করা হয়। তবে ২২০-২০৬ খ্রিষ্টপূর্বের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের প্রথম সম্রাট কিন শী হুয়াং এর অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই বেশি বিখ্যাত। তবে সেই প্রাচীরের খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। প্রথম সম্রাটের শাসনামলের পরে অনেকবার এই প্রাচীর পুনর্নির্মিত, রক্ষিত এবং বর্ধিত করা হয়েছে। বর্তমানে প্রাচীরের যতটুকু অংশ অবশিষ্ট আছে তা মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত।
অংকর থম ( বড় শহর)
৩কিমি প্রাচীরে ঘেরা পরিখাবেষ্টিত একটি রাজকীয় শহর অংকর থম ছিল অংকরিয়ান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ রাজধানী । ১১৮১ সালে আক্রমণকারী চাম এর কবল থেকে রাজা অষ্টম জয়বর্মণ অংকরিয়ান রাজধানী মুক্ত করেন এবং স্থাপনা অভিযানের মাধ্যমে অংকর থামে নতুন রাজধানী স্থাপন করলেন। তিনি বিদ্যমান অবকাঠামো বাফুওন এবং ফিমেনাকাস এর চারপাশে আবধ্য বড় শহর স্থাপন করেন।
সাথে যুক্ত করেন প্রাচীর/পরিখা এবং অংকর এর কিছু বিশাল মন্দির, যার মধ্যে অন্যতম ছিল শহরের মাঝখানে অবস্থিত রাজ মন্দির বায়ন। অংকর রাজ্যে প্রবেশ করার জন্যে মোট ৫ টি প্রবেশদ্বার আছে এবং প্রত্যেকটি প্রবেশদ্বার দিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এ প্রবেশ করা যায়। প্রত্যেকটি প্রবেশমুখের উপরে ৪ টি বিশাল আকৃতির মুখ খোদাই করা। সাধারনত দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে পর্যটকবৃন্দ তাদের সফর শুরু করে।
এক্রপলিস পর্বত
এথেন্স এর এক্রপলিস পর্বত যা “পবিত্র পাথর” হিসেবে পরিচিত, শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং পৃথিবীর বহুল পরিচিত স্মৃতিস্তম্ভ গুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের পরিচয়বাহক এই পর্বত ।
একই সাথে খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে শিল্পের যে সম্প্রসার ঘটেছিল তারও প্রতিনিধিত্ব করে এই পর্বত । পেরিক্লিস এর স্বর্ণ যুগে এই পর্বতের উপরে সেই সময়ে নির্মিত বেশ কিছু শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতাকে আদর্শ সভ্যতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছিল।
ন্যাশনাল চিয়াং কাই-শেক স্মারক ভবন
চীনের তাইপেই শহরে অবস্থিত ন্যাশনাল চিয়াং কাই-শেক স্মারক ভবন পৃথিবীর বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম এক নিদর্শন। দর্শনার্থীদের আগ্রহের বিষয়বস্তু এই ভবন নির্মিত হয়েছে জেনারেল ইসিমো চিয়াং কাই-শেক এর স্মরণে যিনি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রী।
মেমরিয়াল হল স্কোয়ার এর পূর্বে অবস্থিত এই ভবন সুসজ্জিত পার্ক দিয়ে ঘেরা। এই ভবনের উত্তরে ন্যাশনাল থিয়েটার এবং দক্ষিণে ন্যাশনাল কনসার্ট হল অবস্থিত।
পোটালা প্যালেস
চীনের তিব্বতের লাহসা অঞ্চলে অবস্থিত পোটালা প্যালেস । এর নামকরণ করা হয়েছে পোটালাকা পর্বতের নামানুসারে, পৌরাণিক কাহিনী মতে যে পর্বতে বাস করত চেনরেসিগ বা আভালকিতেসভারা । ১৯৫৯ সালে ১৪ তম দালাই লামা ভারতের ধরমশালায় পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই পোটালা প্যালেস দালাই লামার প্রধান বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত।
১৬৪৫ সালে আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা কঞ্চং ছফেল এর পরামর্শে মহান ৫ম দালাই লামা লোজাং গাতসো পোটালা প্যালেস এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কঞ্চং এর মতে, দ্রেপুং ও শেরা মঠ এবং পুরনো লাহসা শহরের মাঝখানে হওয়ার কারণে স্থানটি সরকারি কার্যক্রমের কেন্দ্র হওয়ার জন্যে উপযুক্ত ছিল। ধারণা করা হয় যে, এই প্যালেস এর স্থানে অতীতে এক দুর্গ ছিল যা পরিচিত ছিল সাদা অথবা লাল দুর্গ নামে এবং নির্মাণ করেছিলেন সংসেন গাম্পো । বর্তমানে পোটালা প্যালেস জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পৃথিবীকে আলোকিত করা স্বাধীনতা
পৃথিবী আলোকিত করা স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ছিল ফ্রান্স এর পক্ষ থেকে আমেরিকার কাছে বন্ধুত্বের উপঢৌকন । এই ভাস্কর্য সারা বিশ্বের কাছে সার্বজনীন স্বাধীনতা এবং গনতন্ত্রের প্রতীক।
১৮৮৬ সালের ২৮ অক্টোবরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি উৎসর্গীকৃত হয়, জাতীয় নিদর্শন হিসেবে ঘোষিত হয় ১৯২৪ সালে এবং শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯৮৬ সালের ৪ জুলাই তারিখে পুনঃস্থাপন করা হয়।
সুলতান আহমেদ এর মসজিদ
অটোমান শাসনামলে (১৪৫৩সাল-১৯২৩সাল) তুর্কীর সর্ববৃহৎ শহর এবং রাজধানী ইস্তাম্বুলের এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ সুলতান আহমেদ এর মসজিদ। বহুল আলোচিত এই স্থাপনা তার নীল টাইলস এর দেয়াল এবং অভ্যন্তরীণ সাজের কারণে নীল মসজিদ হিসেবে পরিচিত।
সুলতান ১ম আহমেদ এর আমলে ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের মধ্যে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। অন্যান্য মসজিদের মত এই মসজিদেও একটি মাদ্রাসা, একটি অনাথাশ্রম এবং নির্মাতার কবর আছে। বর্তমানে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হবার পাশাপাশি দর্শনার্থীদের কাছেও এই মসজিদ বিখ্যাত।