মাদাম তুসো জাদুঘর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তিদের মোমের মূর্তির একটি সংগ্রহশালা। শুধু লন্ডন নয়, বর্তমানে বিশ্বের অনেক গুলো বড় শহরে এই জাদুঘরের শাখা রয়েছে। মেরি তুসো নামে একজন ফরাসী ভাস্কর এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা। মাদাম তুসো জাদুঘরটি লন্ডনের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। ইতিহাস বিখ্যাত সব লোকজন ও জনপ্রিয় চিত্র তারকাদের মোমের মূর্তি এই জাদুঘরে প্রদর্শিত রয়েছে।
মেরি তুসোর পরিচিতি ও মাদাম তুসো প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর মেরি তুসো ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে মেরি গ্রোসোলজ নামে জন্ম গ্রহণ করেন। মেরি তুসোর জন্মের দুই মাস পূর্বে এক যুদ্ধে তার বাবা জোসেফ গ্রোসোলজ মারা যান। ছয় বছর বয়সে মেরি তুসো তার মা অ্যানা- মেরি ওয়াল্ডার এর সাথে সুইজারল্যান্ড এ পাড়ি জমান। তার মা সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে ডাঃ ফিলিপ কর্টিয়াস নামক একজন চিকিৎসকের বাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজ করতেন। চিকিৎসক হওয়ার পাশাপাশি ফিলিপ কর্টিয়াস মোমের ভাস্কর্য তৈরিতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার কাছ থেকেই মেরি তুসো মোমের ভাস্কর্য তৈরির সমস্ত কলা-কৌশল রপ্ত করেন।
১৭৭৭ সালে মেরি তুসো তার প্রথম মোমের ভাস্কর্য তৈরি করেন এবং এ জন্য বেছে নেন ভলতেয়ার কে। এছাড়াও ঐ সময়ের অন্যান্য জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি জঁ জ্যাক রুশো ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এর মূর্তি তৈরি করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ভার্সিলিজ প্রাসাদে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইস এর বোন মাদাম এলিজাবেথ এর গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হন। ফরাসী বিপ্লব এর সময় তাকে তিন মাস কারাবন্দী থাকতে হয় এবং বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় একজন প্রভাবশালী বন্ধুর হস্তক্ষেপে মুক্তি পান। এছাড়া ফরাসী বিপ্লব এর সময় তিনি বিপ্লবে জড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের ভাস্কর্য তৈরি করেন।
১৭৯৪ সালে ডাঃ ফিলিপ কর্টিয়াস এর মৃত্যুর পর মেরি তুসো তার বিশাল মোমের ভাস্কর্যের সংগ্রহশালার উত্তরাধিকারী হন। ১৭৯৫ সালে তিনি ফ্রাঁসোয়া তুসো নামে একজন কে বিয়ে করেন এবং এর পর থেকে তিনি মাদম তুসো নামে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তী ৩৩ বছর মোমের মূর্তির প্রদর্শনীর জন্য তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৮০২ সালে ম্যাজিক লন্ঠন ও ফ্যান্টাসম্যাগরিয়া (এক ধরণের মূর্তি প্রদর্শন শিল্প) এর পথিকৃৎ পল ফিলিডোর এর নিকট থেকে তিনি লন্ডনের লাইসিম থিয়েটারে তার মোমের মূর্তি প্রদর্শনের আমন্ত্রণ পান। কিন্তু পল ফিলিডোর আর্থিকভাবে অসচ্ছল মাদাম তুসোর লভ্যাংশের অর্ধেক নিয়ে নেন।
নেপোলিয়নের যুদ্ধের কারণে তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসতে পারছিলেন না। তাই তিনি তার সংগ্রহে থাকা মোমের ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর জন্য গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড ঘুরে বেড়ান। ১৮৩১ সালে তিনি বেকার স্ট্রীট, কিং স্ট্রীট ও ডোরসেট স্ট্রীট এর পশ্চিমে অবস্থিত বেকার স্ট্রীট বাজারের উপরতলা ভাড়া নেন। ১৮৩৬ সালে এটাই মাদাম তুসোর স্থায়ী নিবাসে পরিণত হয়।
১৯৩৫ সালে মাদাম তুসো বেকার স্ট্রীটে তার প্রথম জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। তার জাদুঘরের একটি প্রধান আকর্ষণ ছিলো “চেম্বার অব হররস্”বা “ভৌতিক কক্ষ”। এই নামটি ১৮৪৫ সালে “পাঞ্চ ম্যাগাজিন” এ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু মেরি তুসোর দাবি যে এই নামটি তার নিজের দেয়া এবং ১৮৪৩ সালে তার জাদুঘরের বিজ্ঞাপনে তিনি এই নাম ব্যবহার করেছেন। “ভৌতিক কক্ষ” নামক প্রদর্শনীর এই অংশটিতে ফরাসী বিপ্লবে ক্ষতিগ্রস্ত ও নতুন তৈরিকৃত খুনি ও অন্যান্য অপরাধীদের মূর্তি স্থান পায়। এছাড়া তার প্রদর্শনীতে লর্ড নেলসন ও স্যার ওয়াল্টার স্কট সহ অনেক বিখ্যাত লোকের মূর্তি স্থান পায়।
মেরি তুসোর পরবর্তী প্রজন্ম, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জাদুঘর ও মালিকানা বদল
মাদাম তুসোর নিজের হাতে তৈরি কিছু ভাস্কর্য এখনো টিকে আছে। তার নিজের হাতে তৈরি প্রায় ৪০০ ভাস্কর্য ছিলো। কিন্তু ১৯২৫ সালে অগ্নিকান্ডে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৪১ সালে জার্মান কর্তৃক বোমা নিক্ষেপে পুরনো অনেক ভাস্কর্য নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে অনেক গুলো ভাস্কর্য পুনঃনির্মাণ করা হয় যা জাদুঘরের ইতিহাস বিভাগে প্রদর্শিত রয়েছে। এই বিভাগের ভাস্কর্য গুলো মূলত মাদাম তুসোর সময়কার জনপ্রিয় মুখ ও তার মৃত্যুকালে অসমাপ্ত থাকা কাজ সমূহ। ১৮৪২ সালে তিনি নিজের একটি প্রতিকৃতি তৈরি করেন যা তার জাদুঘরের প্রবেশ দ্বারে প্রদর্শিত রয়েছে। এছাড়া মাদাম তুসো জাদুঘরের বার্লিন শাখায় সংরক্ষিত এডলফ হিটলারের মূর্তিটি ৪১ বছর বয়সী একজন জার্মান ব্যক্তি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ, ক্রীড়াবিদ, তারকাদের সাথে এই স্বৈরশাসকের মূর্তি স্থাপন করার প্রতিবাদে, দুইজন রক্ষীর চোখ এড়িয়ে ঐ ব্যক্তি হিটলারের মূর্তিটি নষ্ট করার চেষ্টা করে।
১৮৮৩ সালে জায়গা স্বল্পতা ও বর্ধিত ব্যয় এর কারণে মাদাম তুসোর নাতি জোসেফ র্যান্ডল জাদুঘরটি এর বর্তমান ঠিকানা ম্যারিলিবোন স্ট্রীট এ স্থানান্তর করেন। ১৮৮৪ সালের ১৪ই জুলাই নতুন প্রদর্শনী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ও এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে বর্ধিত ব্যয় ও পারিবারিক শেয়ার হোল্ডারদের মতানৈক্যের কারণে ১৮৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এডউইন জোশিয়া পয়জার এর নেতৃত্বে এক দল ব্যবসায়ীর নিকট মাদাম তুসো জাদুঘর বিক্রয় করে দেয়া হয়।
২০০৫ সালে দুবাই এর একটি কোম্পানির নিকট ১.৫ বিলিয়ন ডলারে মাদাম তুসোর জাদুঘর পুনরায় বিক্রয় করে দেয়া হয়। এরপর ২০০৭ সালে দুবাই এর কোম্পানির নিকট থেকে ব্ল্যাকস্টোন নামক একটি কোম্পানি ১.৯ বিলিয়ন ডলারে মাদাম তুসো জাদুঘর কিনে নেয় এবং ব্ল্যাকস্টোনের অঙ্গ সংগঠন মারলিন এন্টারটেইনম্যান্ট মাদাম তুসোর কার্য পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১৭ই জুলাই জাদুঘরের অর্থায়নের জন্য এর শেয়ার নিক ল্যাসল্যো নামক একজন ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীর নিকট ফেরত যোগ্য চুক্তিতে বিক্রয় করা হয় যা ৩৫ বছর পর চুক্তি নবায়ন করা যাবে বা অর্থ ফেরতের মাধ্যমে মালিকানা ফেরত পাওয়া যাবে।
মাদাম তুসো জাদুঘরের বর্তমান অবস্থা, এর শাখা সমূহ ও উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য সমূহ:
মাদাম তুসোর জাদুঘরটি পর্যটকদের নিকট লন্ডনের প্রধান আকর্ষণ। বর্তমানে জাদুঘরে প্রদর্শিত মূর্তি গুলোর মাঝে রয়েছে ঐতিহাসিক ও রাজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ, চিত্র তারকা, ক্রীড়াবিদ ও কুখ্যাত সব খুনিরা।
বিশ্বব্যাপী দর্শকদের চাহিদা বিবেচনা করে বিশ্বের অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরে মাদাম তুসো জাদুঘরের শাখা নির্মাণ করা হয়েছে। বিদেশে জাদুঘরের প্রথম শাখাটি তৈরি করা হয় নেদারল্যান্ড এর আমস্টারডাম এ ১৯৭০ সালে। এরপর ইউরোপ ছাড়াও এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বড় শহরে এর শাখা নির্মাণ করা হয়। ভারতে এর প্রথম শাখা স্থাপন করা হয় ১লা ডিসেম্বর, ২০১৭ এ নিউ দিল্লিতে। এখানে ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, ম্যারি কম সহ প্রায় ৫০ টি মোমের মূর্তি স্থান পায়।
semaglutide 14mg generic – buy generic desmopressin desmopressin over the counter