ডুবো শহর হেরাক্লিয়ন – সাগর তলে হারিয়ে যাওয়া মিশেল সভ্যতার প্রাচীন স্বাক্ষর

1

এ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া প্রতিটি প্রাচীন শহর এক একটি সভ্যতার চিহ্ন বহন করে। কিন্তু সম্প্রতি প্রত্নতাত্মিকেরা সমুদ্রের নিচে এমন একটি শহর খুঁজে পেয়েছেন যেখানে একটি নয়, বরং একই সাথে মিশরীয় এবং গ্রীক সভ্যতার চিহ্ন আছে। শহরটির নাম হেরাক্লিয়ন। এর আরেক নাম থনিস। কথিত আছে, একবার গ্রীক দেবতা হেরাক্লেস এই শহরটি পায়ে ভ্রমন করেছিলেন। সেই থেকেই এর নাম হয় হেরাক্লিয়ন। ধারনা করা হয় ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে বরফ গলার কারনে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যায়। যার ফলে সমুদ্রের করাল গ্রাসে সলীল সমাধী ঘটে এই প্রাচীন শহরটির ।

ডুবো শহর হেরাক্লিয়ন
Source: Διάφορα – Οδηγίες προς τους ναυτιλλομένους

ভূমধ্যসাগরের তলদেশে অনুসন্ধানকালে প্রথমেই বেরিয়ে এলো এক প্রকান্ড মুর্তি।অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রত্নতাত্মিকরা নিশ্চিত হলেন এটি দেবতা হ্যাপির মুর্তি। হ্যাপি ছিলেন নীলনদের বন্যার দেবতা। একইসাথে সেখানে পাওয়া গেছে আরো দুইশোর বেশি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, হায়ারোগ্লিফিক শিলালিপি, ধাতব ও ফারাও রাজাদের স্বর্ণালঙ্কার। সব পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে পুরাতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত হয়েছেন তলিয়ে যাওয়া শহরটি হেরাক্লিওন বা থনিস। যে শহরে মিশেল ঘটেছিল গ্রীক ও মিশরীয় সভ্যতার। গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস আনুমানিক ৬০-৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তার বিখ্যাত বই ‘Bibliotheca historica’ তে এই হেরাক্লিওন শহর সম্পর্কে বলে গেছেন। প্রত্নতাত্মিকেরা বলেছেন বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন সভ্যতায় সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে। কিন্তু রানি আর্সিনো দ্বিতীয়’র এই মূর্তির সাজ পোশাকে গ্রীক ও মিশরীয় সভ্যতার যে পরিষ্কার নমুনা দেখতে পাওয়া গেছে তা আগে কখনো দেখা যায় নি। ১৯৯৬ সালে মিশরের পুরাতত্ত্ব মন্ত্রণালয়ের সাথে হারানো এ হেরাক্লিয়ন শহর অনুসন্ধানে মূল ভূমিকা রাখেন, ইউরোপীয়ান ইন্সটিটিউট অব আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজির পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক গডিও।

ডুবো শহর হেরাক্লিয়ন
ইউরোপীয়ান ইন্সটিটিউট অব আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজির পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক
Source: www.historicmysteries.com

হেরাক্লিয়নের দেবতা হ্যাপিঃ

প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাসে নীল নদ এবং দেবতা হ্যাপির গুরুত্ব ছিল অত্যাধিক। মিশরীয়দের জলের দেবতা ছিল হ্যাপি। অধিবাসিগণ হ্যাপির পূজা  করত তাকে খুশি করার জন্য আর তাকে খুশি করতে পারলেই সেখানে প্লাবন আসত। নতুন ফসল ফলত। তারা বিশ্বাস করতো দেবতা হ্যাপি বন্যা নিয়ন্ত্রন করে। মিশরীয় এবং গ্রীকদের কাছে বন্যা ছিল অতীব গূরত্বপূর্ন একটি ব্যাপার। কেননা তাদের নীলনদের পলি গঠিত সমভূমি ছিল কৃষিনির্ভর। আর তাদের প্রকৃতি নির্ভর কৃষিতে বন্যার গূরত্ব ছিল অপরিসীম। হেরাক্লিয়ন শহরের অধিবাসীদের মূল জীবিকা ছিল কৃষি নির্ভর, ফলে দেবতা হ্যাপি আস্তে আস্তে হেরাক্লিয়নের প্রধান  দেবতায় পরিনত হয়। মিশরে এখনো একটি উপকথা প্রচলিত আছে যে, প্রথমে দেবতা হ্যাপির স্বর্গের যে বাসস্থান আছে, সেখানে প্লাবন আসে এবং তিনি সেই প্লাবনকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীতে আসেন এখানকার মৃত মৃত্তিকাকে জীবিত করার জন্য। প্লাবন আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীগন নদীর পাড়ে সমবেতভাবে প্রার্থনা করতো এবং নদীতে বিভিন্ন ধরনের শস্য, জীব-জন্তু উৎসর্গ করতো যাতে দেবতা হ্যাপি তাদের অল্প বন্যা দিয়ে ফসল নষ্ট না করেন এবং বেশি বন্যা দিয়ে তাদের বাসস্থান ভাসিয়ে না নেন। এভাবেই হেরাক্লিয়ন শহর এবং এর অধিবাসীদের জীবনের সাথে দেবতা হ্যাপি ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকতো।

ব্যবসায়িক বন্দরনগরী হেরাক্লিয়নঃ

হেরোডোটাস শহর নক্রাটিসের বর্ননা দিতে গিয়ে উঠে এসেছে হেরাক্লিয়ন বন্দরের নাম। যার ফলে এই প্রাচীন হেরাক্লিয়ন শহরের জ্বলজ্বলে ইতিহাস আরো সত্যতা পেয়েছে। হেরোডোটাস এর দেয়া সূত্র মতে নক্রাটিস শহরের ঘটনা খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ অব্দের। 

ডুবো শহর হেরাক্লিয়ন
Source: Alien UFO Sightings

ফারাও আপ্রিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল আমেসিস। আমেসিসকে দমন করতে গিয়ে আপ্রিস পরাজিত হয়েছিলেন। আমেসিসকে সাহায্য করেছিল গ্রিক সৈন্যরা। তিনি তাদের মেম্ফিসে নিজের পাহারাদার রেখেছিলেন। আমেসিসের প্রতি গ্রিকদের পক্ষপাতিত্ব ছিল। বিনিময়ে আমেসিস গ্রিকদের একটি শহর দিয়েছিলেন। নাম নক্রাটিস। অবশ্য সম্প্রতি নক্রাটিস শহরটি প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পেয়েছেন। নক্রাটিস শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬২৫ অব্দে। গ্রিকরা উপহার পান খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ অব্দে। শহরটিতে গ্রিক আর মিসরীয়দের সঙ্গে ফিনিশীয়রাও বসবাস করত। প্রায় ১৬ হাজার মানুষ ছিল শহরটিতে। হেরা, অ্যাপোলো, আফ্রোদিতির অনেক মন্দির ছিল এখানে, তবে বেশি ছিল মিসরীয় দেবতা আমুন রায়ের। এমন মন্দিরও ছিল, যার সামনের পথের দুই ধারে ছিল স্ফিংসের মূর্তি। নক্রাটিস ছিল গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। 

মিশর এবং গ্রীসের মধ্যে যে ব্যবসা বানিজ্যের ধারাটি প্রবাহিত ছিল, তার মাঝে হেরাক্লিয়ন এবং নক্রাটিস বেশ গূরত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতো। কারন হেরাক্লিয়ন এবং নক্রাটিসে বসেই গ্রীকরা তাদের ব্যবসা এবং বিনিময় কার্য করতো। গ্রিকরা তো বটেই, হেরাক্লিয়ন বন্দরে জাহাজ ভেড়াত ফিনিশীয়রা, সাইপ্রিয়টরা, লেভান্তিয়রাও। সেখানে মিসরীয়রা শস্য, প্যাপিরাস, সুগন্ধি, লিনেন দিত আর গ্রিকরা দিত রৌপ্য, কাঠ বা জলপাইয়ের তেল। এভাবেই হেরাক্লিয়ন একসময় ব্যবসা-বানিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। 

ডুবো শহর হেরাক্লিয়ন
Source: Alien UFO Sightings

ইন্সটিটিউট অব আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজি পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক গডিও বলেন যে, পানির নিচে থাকায়, এগুলো খুব একটা নষ্ট হয়নি। আমার কাছে মনে হয় পানির নিচে যা আছে, তার মাত্র পাঁচ শতাংশ খনন করতে পেরেছি আমরা 

 প্রাচীন এ হেরাক্লিওন শহরের মাত্র পাঁচ শতাংশ দেখেই আমরা ধারনা করতে পারি তখনকার প্রাচুর্যময় এ প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে। হেরাক্লিয়ন শহরের সময়ে সেখানে polytheism বা বহুশ্বেরবাদের প্রচলন ছিল, এর অসংখ্য বিভিন্নধরনের পূজনীয় মূর্তি তার স্বাক্ষর বহন করে। আস্তে আস্তে সম্পূর্ন শহরটি খনন করতে পারলে বেরিয়ে আসবে এর আরো মূল্যবান প্রত্নতাত্মিক সম্পদ এবং তথ্য, যার দ্বারা হয়তো পাল্টে যেতে পারে মানব ইতিহাসের সকল ধারনা, আমাদের সামনে উন্মোচন হতে পারে এক রহস্যময় জ্ঞানসমুদ্রের দ্বার। 

তথ্যসূত্রঃ

Wikipedia

https://www.historicmysteries.com/heracleion-sunken-egyptian-city/

http://www.ancientegyptonline.co.uk/hapi.html

Leave A Reply
1 Comment
  1. Bsoblg says

    pill prandin – order repaglinide pills order jardiance 10mg sale

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More