১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লব বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বিপ্লব হিসেবে পরিচিত।দীর্ঘ দিনের অপ্রাপ্তি, ক্ষোভ, দারিদ্র্য আর বঞ্চনার স্বীকার সুবিধা বঞ্চিত সাধারণ কৃষক ও মজুর শ্রেনী একত্র হয়ে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার তৎকালীন শাসক জার নিকোলাস ২ এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এই বিপ্লবের সূচনা হয়। আর শেষটা হয় বামপন্থি বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে নতুন কমিউনিস্ট সরকার ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ গঠনের মাধ্যমে।

রাশিয়ান জারঃ
রুশ বিপ্লবের পূর্বে ১২৬ মিলিয়ন জনগন ও ১৯৪ টি জাতিগোষ্ঠী নিয়ে বাল্টিক সাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সুবিস্তৃত ভূখন্ড রাশিয়া কয়েক শতাব্দী ধরে জার নামক ক্ষমতাশালী একনায়কতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হত। আর জারদের হাতেই সমগ্র ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকত। একজন জার একই সাথে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, অধিকাংশ ভূমির মালিকানা এমনকি চার্চের নিয়ন্ত্রন ও নিজের হাতে রাখতেন। বিপ্লবের সময় রাশিয়ার জার ছিলেন ১৮৯৪ সালে ক্ষমতায় আরোহন করা নিকোলাস-২ ।

রুশ বিপ্লবের আগ পর্যন্ত রাশিয়ায় কৃষক এবং মজুরদের জীবন খুবই দুর্বিসহ ছিল। তারা হাড়ভাঙ্গা কঠিন শ্রম ও খাটুনির বিনিময়ে খুবই সামান্য মজুরি পেত কখনোবা তা থেকেও তাদের বঞ্চিত হতে হত। ধনিক শ্রেনীরা এসকল শ্রমিক-মজুরদের সাথে কৃতদাসের মতো ব্যবহার করত এবং তাদের অধিকার বলতে কোন কিছু ছিলনা যা ছিল তা পশুদের তুল্যই বলা চলে। অপর দিকে ধনিক ও সম্ভ্রান্ত শ্রেনীর জীবন যাপন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা শ্রমিক-মজুরদের তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে নিজেরা আয়েশী ও জাঁকজমকপূর্ন জীবন যাপন করত।
রক্তাক্ত রবিবারঃ
শতাব্দী ধরে চলে আসা এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে ২২ শে জানুয়ারী, ১৯০৫ সালে। সে দিন দলে দলে কৃষক-শ্রমিক-মজুরেরা হাতে হাত মিলিয়ে নিরাপদ কাজের পরিবেশ ও শ্রমের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে শান্তিপূর্ন প্রতিবাদ করতে করতে জারের প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু সৈরাচার জার নিকোলাস-২ এর নির্দেশে সেনাবাহিনী ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীতে আন্দোলনরত সাধারণ শ্রমিকদের বুকে গুলি চালায় যাতে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয় ও অনেক প্রান হানির ঘটনা ঘটে। এই নির্মম নৃশংস ঘটনা ইতিহাসে রক্তাক্ত রবিবার হিসেবে পরিচিত।

এই নৃশংস ঘটনার পূর্বে জার নিকোলাস-২ ছিলেন কৃষক-শ্রমিকদের পূজনীয় শ্রদ্ধার পাত্র। তারা জার এর ব্যাপারে অনেক উচ্চ ধারনা পোষন করত; তাদের ধারনা ছিল জার তাদেরই পক্ষে আর তাদের এই দূর্বিশহ অবস্থার জন্য জার নয় বরং সরকার দায়ী। কিন্তু এই রক্তাক্ত রবিবারের ঘটনা তাদের মনের বদ্ধমূল ধারনায় চিড় ধরায় । জারের ভালোমানুষির মুখোশের আড়ালে থাকা পৈশাচিক রুপ তাদের সামনে ধরা পড়ে যায় এবং তারা তার বিরুদ্ধে ক্রোধে ফেটে পড়ে। আস্তে আস্তে এই ক্রোধ দানা বেঁধে বিপ্লবের রুপ নিতে থাকে আর এই বিপ্লবের দাবানল ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধঃ
১৯১৪ সালে শুরু হওয়া বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করে ফলে বহু সংখ্যক সৈন্যের প্রাণহানির ঘটনায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যার অপ্রতুলতা দেখা দিতে থাকে। তাই সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বাধ্যতামূলক ভাবেব্যপক সংখ্যক সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক ও মজুর শ্রেনীকে কোন প্রকার প্রশিক্ষণ ও পারদর্শীতা ছাড়াই রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে ভর্তি করানো হয় জোর করে। যদিও এ প্রক্রিয়ার ভর্তি করানোর কারনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে বহুসংখ্যক সৈন্য ছিল কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক সৈন্যকে জুতা, খাবার এমনকি অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে হয়।

পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে যুদ্ধে প্রায় ২০ লাখ রাশিয়ান সৈন্য প্রাণ হারায় এবং আরও প্রায় ৫০ লাখ সৈন্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। রাশিয়ার সাধারণ জনগন বিনা কারনে তাদের সৈন্যদের এভাবে হত্যা হতে দেখে আবারো জারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং তাদের যুবসমাজকে জোর পূর্বক যুদ্ধে পাঠিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে হত্যা করার অভিযোগে জারকে অভিযুক্ত করতে থাকে।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবঃ
১৯১৭ সালের শুরুর দিকে রাশিয়ার মানুষজন প্রথম বিপ্লবে নামে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-মজুর একত্র হয়ে অবরোধের ডাক দিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিপ্লবের সূচনা হয়। অনেক মজুর অবরোধের মধ্যে শান্তিপূর্ন সমাধানের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক আলোচনাতেও অংশগ্রহন করতে থাকে। যখন শান্তিপূর্ন সমাধানের পথে জার বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন তারা বাধ্য হয়ে দাঙ্গা শুরু করে। জার নিকোলাস-২ এবারও তার অনুগত সেনাবাহিনীকে এই বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাশিয়ার সাধারণ কৃষক-মজুর পরিবার থেকে উঠে আসা সেনাবাহিনীর সদস্যরা এবার ঘুরে দাঁড়ায়। তারা সাধারণ কৃষক-শ্রমিক-মজুরদের ন্যায্য দাবীর মুখে তাদের বুকে গুলি চালাতে অস্বীকার করে এবং অত্যাচারী জারের বিরুদ্ধেই তাদের অস্ত্র উঁচু করে।

বিপ্লবের দাবানল চারিদিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে যা পৌঁছে যেতে থাকে সেনাবাহিনীর ব্যারাক থেকে ব্যারাকে। কয়েকদিন ধরে চলমান দাঙ্গা সংঘাতের মুখে একসময় শতবর্ষ ধরে আজ্ঞাবাহী সেনাবাহিনী ই জারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় এবং জারকে ক্ষমতা ছেড়ে করে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করে। নবগঠিত সরকারদুটি রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনে পরিচালিত হতে থাকে। দল দুটি হলো পেত্রোগার্দ সোভিয়েত ( শ্রমিক-মজুর ও সেনাবাহিনীর দ্বারা গঠিত) এবং শর্তাধীন সরকার ( জার ছাড়া চলমান সরকারের অন্য সব কর্মকর্তা দ্বারা গঠিত)।

বলশেভিক বিপ্লবঃ
পরবর্তী কয়েক মাস সমঝোতার ভিত্তিতে পেত্রোগার্দ সোভিয়েত ও শর্তাধীন সরকার রাশিয়া শাসন করতে থাকে। পেত্রোগার্দ সোভিয়েতের প্রধান বিরোধী দল ছিল বলশেভিক যার নেতা ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিয়চ লেনিন। যিনি বিশ্বাস করতেন যে নতুন রাশিয়ার সরকার মার্ক্সিস্ট (কম্যুনিস্ট) হওয়া উচিৎ। তাই একই বছর অর্থাৎ ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি বিপ্লবের ঘটনা ঘটে রাশিয়াতে যার মাধ্যমে ভ্লাদিমির লেনিন সমগ্র রাশিয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন এবং লেনিনের এই অক্টোবরের বিপ্লবই ইতিহাসে বলশেভিক বিপ্লব নামে পরিচিত। বলশেভিক বিপ্লবের ফলে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়া পৃথিবীতে প্রথম কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ফলাফলঃ
১। এই বিপ্লবের পর রাশিয়ার নতুন সরকার জার্মানির সাথে ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে প্রথমবিশ্বযুদ্ধ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সরে আসে।
২।দেশের অর্থনীতি পূনর্গঠনে মনোযোগী হয়ে ওঠে এবং সকল কলকারখানা সরকারী নিয়ন্ত্রনে নিয়ে শতবর্ষের গ্রামীন রুগ্ন রুশ অর্থনীতিকে শিল্পোন্নত করে তুলতে থাকে।
২। জমিদারদের হাত থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে তা সাধারণ কৃষকদের মাঝে বন্টন করে ।
৩। নারীরা সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের সমান অধিকার লাভ করে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধর্মের অযাচিত হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করে।

রুশ বিপ্লবের কিছু চমকপ্রদ তথ্যঃ
* এই বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় ৩০৩ বছর পরে জারদের পতন ঘটে।
* ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের সময় লেলিন রাশিয়াতেই ছিলেন না তিনি দেশে ফেরেন এপ্রিলে।
* যদিও বিপ্লবটি সাধারন প্রচলিত আমাদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্চ মাসের ৮ তারিখে শুরু হয়েছিল কিন্তু রাশিয়ায় প্রচলিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা ছিল ফেব্রুয়ারী মাসের ২৩ তারিখ।
* কখনো কখনো লেনিনের ক্ষমতা গ্রহনের সময়ের হিসেব অনুযায়ী বলশেভিক বিপ্লবকে অক্টোবর বিপ্লব ও বলা হয়ে থাকে।
* বলশেভিক বিপ্লবের মূল নেতৃত্বে ছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন, জোসেফ স্ট্যালিন এবং লিওন ট্রটস্কি। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন ক্ষমতা গ্রহন করেন এবং জোরপূর্বক ভাবে ট্রটস্কিকে সরিয়ে দেন।
* জুলাই ১৭, ১৯১৮ সালের পর জার নিকোলাস-২ এবং তার সম্পূর্ন পরিবারকে নির্বাসিত করা হয়।