ট্যাকটিক্যাল এনালাইসিসঃ জার্মানি কি পারবে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে?
প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে জার্মানি এর পারফরম্যান্স দেখে অনেকেই হয়ত ভাবছে এইবার হয়তবা তারা ফেভারিট নয়। কিন্তু অতীত ইতিহাস ঘাটলে বুঝা যায়, জার্মানি সবসময় প্রতিপক্ষকে এই রকম মায়াজালে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। তাদের খেলাটা শুরু হয় টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পর পর। বলার অপেক্ষা রাখে না, এইবারও তারা ফাইনাল জিতলে যোগ্যতর দল হিসেবেই জিতবে।
তৎকালীন ম্যাচগুলোর মধ্যে একমাত্র স্পেনের বিপক্ষে ম্যাচেই লো তার মূল একাদশ খেলায় (রিউস, নয়ার বাদে)। বাকী দলগুলোর সাথে সে মূলত খেলোয়াড় যাছাই বাছাই করতে খেলায়। এর একটা মুল কারণ হতে পারে জার্মানীর স্পেন দূভার্গ্য কিংবা এই বিশ্বকাপে তারা হয়ত স্পেনকেই সব থেকে বেশি সমীহ করছে।
লো’র এনালাইসিসের জন্য তাই আমি মুলত স্পেন বনাম জার্মানীর খেলায় বেছে নিয়েছি। লো ‘১৪ তে বিশ্বকাপ জিতেছিল ৪-৩-৩ তে যেইটা ডিফেন্স করার সময় হয়ে যায় সলিড ৪-৪-২। তবে দল ভেদে ম্যাচ চলাকালীন কখনো এইটা ৪-১-৪-১ কিংবা ৪-২-৩-১ অথবা ৪-২-১-৩ও হয়ে যায়। আর ‘১৪ এর পর ৩ ব্যাক ম্যান সিস্টেম চালু হওয়ায় লো তার জার্মান দলকে এই সিস্টেমে ও খেলাতে দেখা যায় কখনো ৩-৫-১-১ কখনো ৩-৪-৩। তবে যে সিস্টেমই সে ব্যবহার করুক না কেন অস্বাভাবিক ভাবে সে ডিফেন্স এবং এটাক ব্যালান্সড রাখতে সক্ষম হয়। তার মানে দাঁড়াল, স্পেন কিংবা ব্রাজিলের মত লোর কোন ফিক্সড সিস্টেম নেই। আধুনিক ফুটবল যে সিস্টেমে চলবে লো তার প্লেয়ারদের সেই সিস্টেমেই খেলাবে।
ব্রাজিল কিংবা স্পেনের মত লোরও কিছু প্রিন্সিপাল আছে। ফরমেশন যাই হোক না কেন, খেলোয়াড়দের সেই প্রিন্সিপাল গুলো মেনে চলতে হবে। স্পেন দলের মুল অস্ত্র যদি হয় হাই প্রেস, তবে লো’র জামার্নীর হল কাউন্টার প্রেস। বিশ্বকাপে অনেক দলকেই দেখা যাবে কাউন্টার প্রেস করতে। কিন্তু আপনি যদি কাউকে অনুসরণ করতে চান কাউন্টার প্রেসের জন্য। সেইটা হবে জার্মানী। কেন সেইটা ব্যাখ্যা করছি এখনি।
কাউন্টার প্রেস বলতে বুঝায়, আপনি যখন বল পজেশন হারাবেন তখন সাথে সাথে প্রেস করা যাতে বল আবার উইন করা যায়। কাউন্টার প্রেসকে মডিফাই করে গেগেইন প্রেসিং এ নিয়ে যাওয়া ক্লপের থেকে জেনে আসি কাউন্টার প্রেস বলতে আসলে কি বুঝায়, “কাউন্টার প্রেস হচ্ছে প্লে-মেকিং করার জন্য সব থেকে উপযুক্ত সিস্টেম। আপনার বল জিতার সম্ভবনা তখনি বেশি যখন আপনি বল হারাবেন। এর কারণ হল, বল পেয়ে প্রতিপক্ষ কিছুটা সময় নিবে কাকে পাস দিবে, বাকীরা তাকে ঘিরে অরগানাইজড হতে চাইবে। আর এই সব সিদ্ধান্ত নিতে তার যে মিলি সেকেন্ড লাগে এই সময়ের মধ্যে যদি আপনি সঠিকভাবে প্রেশার এপ্লাই করতে পারেন আপনার বল জিতার সম্ভবনা বেড়ে যাবে।”
তার কথার উপর ভিত্তি করে তাহলে চলুন দেখে আসি একটি সঠিক কাউন্টার প্রেস সিস্টেম কেমন হতে পারে?
১। পজিশন সম্পর্কে অবশ্যি আপনার ধারণা থাকতে হবে।
২। পিচ হাই আপ করাটা জরুরী। তাতে কোন কারণে প্রেস ব্রেক হয়ে গেলেও আপনার কিপার থাকবে বল ক্লিয়ার করার জন্য। এইজন্য কিপারকে অবশ্যি সুইপার কিপার হতে হবে।
৩। রিএকশন খুব ফার্স্ট হওয়া জরুরি। বল হারানোর সাথে সাথে কাছে থাকা প্লেয়ারকে অবশ্যি প্রেস করতে হবে।
৪। দলের সবাইকে একসাথে প্রেস করতে হবে। কোন ভাবে যাতে কোন প্লেয়ার আনমার্ক অবস্থায় না থাকে। হায়েনা যেভাবে আক্রমণ করে সেভাবে সবাইকে একসাথে প্রেস করতে হবে।
৫। ট্র্যাপ সৃষ্টি করতে হবে। এমনভাবে প্রেস করতে হবে, যাতে প্রতিপক্ষ শুধু একটি অপশনই পাই পাস দেওয়ার। তাতে যে কেউ ইন্টারসেপ্ট করতে পারবে খুব দ্রুত।
৬। বল না জিতা পর্যন্ত ১-৫ বারবার রিপিট করতে হবে।
লোর জার্মানী প্রতিপক্ষের প্লেয়ারদের ৫ মিটারের মধ্যে প্রেস করতে থাকে। এতে যেইটা হয় প্রতিপক্ষের সামনে পাসিং লাইন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিপক্ষ বারবার বল পিছনে প্লে করতে বাধ্য হয়। আর এইভাবে বল ছাড়াই জার্মানী প্রতিপক্ষকে ফাইনাল থার্ডে পিন করতে সক্ষম হয়।
তারমানে দেখা যাচ্ছে, কাউন্টার প্রেস করতে আপনার প্রচুর স্টামিনা প্রয়োজন। আর এই দিক দিয়েই জার্মানরা হল সব থেকে এগিয়ে। জার্মানরা জাতিগত ভাবে পরিশ্রমী আর অরগনাইজড। ৯০ মিনিট নয় বরং ১৮০ মিনিট প্রেস করবে আপনাকে এই মানসিকতা নিয়ে তারা মাঠে নামে। তাই লো’র কাউন্টার প্রেস ট্যাকটিস জার্মানদের সাথে খাপে খাপ মিলে যায়। একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে জার্মানরা এখন পজেশনাল ফুটবল খেলে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, তারা পজেশন অবস্থায় যতটা না সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে তার থেকে বেশি সৃষ্টি করে কাউন্টার প্রেসিং এর মাধ্যমে। এমনকি ব্রাজিলকে ৭-১ গোল দেওয়া ম্যাচেই খেয়াল করলে দেখা যাবে, তারা কাউন্টার প্রেসে কতটা ভয়ানক ছিল। যদি ভুল না করে থাকি ৫টার মত গোল হয়েছিল শুধু কাউন্টার প্রেস করেই।
এইবার আসি কাউন্টার প্রেস করার সুবিধে গুলো কি কি?
১। প্রতিপক্ষের অর্ধে বল জিতা যায়। এবং কুইক ট্রাঞ্জিশনের মাধ্যমে যে কোন সময়ে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়
২। কাউন্টার এটাক অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ তৎক্ষণাৎ প্রেশার সৃষ্টি করা হয় প্লেয়ারের উপর। তাই তার স্পেস এবং সময় দুইটাই থাকে খুব অল্প। ডিশিসান মেকিং হতে হবে অনেক ফার্স্ট এবং একটা ভুল পাসে গোল খাওয়ার পসিবিলিটিও হাই। বরং কাউন্টার প্রেস না করলে কাউন্টার এটাক করা যায় সহজে। তাই মোটামুটি বলা যায়, কাউন্টার এটাকের বিপরীতে কার্যকর হল কাউন্টার প্রেসিং সিস্টেম।
নিচের ছবিটি লক্ষ্য করুন, দেখুন জার্মানীর কাউন্টার প্রেস কিভাবে প্রতিপক্ষের কাউন্টার এটাক সিস্টেম ধ্বংস করে দেয়।
আগে বলেছিলাম, লো, ৪-৩-৩ তে তার দলকে সাজায় এবং ডিফেন্স করার সময় সেইটা ৪-৪-২ হয়ে যায়। কিন্তু যদি জার্মানী পিছিয়ে থাকে লো ৪-৩-৩ তেই খেলিয়ে যায় তার দলকে হাই প্রেসের সাথে। মুলত ওজিলের কাজ থাকে নেমে এসে ডিফেন্স থেকে বল রিসিভ করা। ওজিল অনেকটা ফ্রী রোল হিসেবেই খেলে। তার কাজ এটাক বিল্ড আপ করা। কোন টিমমেইট যদি প্রেশারে থাকে তার জন্য পাসিং অপশন সৃষ্টি করা পাশাপাশি তার একটা বড় গুণ সে প্রেশার এবজর্ব করতে পারে। জার্মান সিস্টেমে ওজিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার। সে শুধু প্রেশার এবজর্ব করে না । স্পেস এক্সপ্লয়েটও করতে পারে। তাকে প্রেস করা হলে সে বল পাস করে সঙ্গে সঙ্গে প্রেসকৃত প্লেয়ারের পিছনের স্পেসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে।
লোর আরেকটি অন্যতম ট্যাকটিস হল লং বল। আধুনিক ফুটবলে এসে লং বল ট্যাকটিসটা একটু ভিন্নতা এসেছে। এই লং বল ট্যাকটিসে একজন থাকে ফলস রিসিভার হিসেবে যাকে আধুনিক ফুটবল সংজ্ঞায়িত করে স্টেশন হিসেবে। তাকে টার্গেট করে বল প্রদান করা হয়। আর প্রতিপক্ষ পাবে বলটা সে রিসিভ করবে। মজার ব্যাপার হল, বলটা সে রিসিভ না করে বরং এক পাসে ফ্রি স্পেসে ছেড়ে দে। এতে যেইটা হয় যে বা যারা তাকে প্রেস করছিল মুহুর্তের মধ্যে তাদের পিছনে ফেলে আসা স্পেসকে এক্সপ্লয়েট করতে আপ্রে প্রতিপক্ষ। ব্রাজিল পৌউলিনহোকে দিয়ে মাঝে মাঝে এই ট্যাকটিস কাজে লাগাতে চাই। তবে সব থেকে ভাল ভাবে এই কাজটি করতে পারে জার্মানরা। এই ট্যাকটিসের সব থেকে বড় সুবিধে হল, প্রতিপক্ষ আপনাকে হাই প্রেস করলে আপনি খুব সহজে লং বলে দিয়ে স্টেশন বানিয়ে প্রতিপক্ষের স্পেস এক্সপ্লয়েট করতে পারবেন।
এছাড়া লো মাঝে মাঝে সুইচ প্লে করতে ও পছন্দ করে। ফ্রন্ট ৩ নিজেদের মধ্যে বারবার পজিশন ইন্টারচেঞ্জ করতে থাকে এর ফলে তাদের ম্যান মার্ক করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া রিউস, টিমো গতি এবং পাসিং কম্বিনেশন যে কোন দলের ডিফেন্স লাইনকে ভুগাবে।
এইবার আসা যাক, তাদের ডিফেন্সিভ অরগানাইজেনশনে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, বাকী ফেভারিট দলগুলোর মধ্যে একমাত্র জার্মানীর ডিফেন্সই সব থেকে বেশি দূর্বল। তাদের প্রথম দূর্বলতা, তাদের ডিফেন্সের সাথে মিডের গ্যাপ। যেহেতু তারা কাউন্টার প্রেস করতে অভ্যস্ত পুরো মাঠে এইটা পিচের বিভিন্ন জায়গায় স্পেস ছড়িয়ে দে। এই সুবিধেটা তখন নিতে পারে প্রতিপক্ষের বিটুইন দ্যা লাইনের প্লেয়ারগুলো।
আর এইটা থামানোর জন্যি মুলত তাদের ৪-২-৩-১ সিস্টেম যেখানে একজন সিএম সিডিএম হিসেবে খেলবে আর এই কাজটি করে ক্রুস। খেদিরা আর ক্রুসের এই সময় কাজ হল বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা স্পেস কভার দেওয়া। তারা বল ছাড়া অবস্থায় যেহেতু হাই প্রেস করতে থাকে এতে যেমন তাদের এটাকিং প্রান্তে সুবিধে হয় তেমনি অসুবিধেও আছে। কাউন্টার প্রেস কিংবা হাই প্রেস সিস্টেমটা কার্যকরী হয় পিচের উপরে করলে এখন যেহেতু জার্মানী বল ছাড়া পিচের যে কোন অবস্থায় হাই প্রেস করে থাকে। ধরে নিলাম, তারা তাদের ডিফেন্স লাইনে বলটা উইন করল। এবং কুইক ট্রানজিশনে গোল দিতে চাইল। যেহেতু ক্রুস এবং খেদিরা তুলনামুলক স্লো। তখন যেইতা দেখা যায় তা হল, পিচের মিডের সাথে আক্রমণভাগের কোন কানেকশন থাকে না। মুলত জার্মানি কাউন্টার প্রেস জার্মানীকেই তখন ডিসঅরগানাইজড করে দে। ফ্রন্ট প্লেয়াররা খুব সহজে প্রথমত আইসোলেটেড হয়ে যায়। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার সবার পজিশনে যাওয়ার আগে যদি প্রতিপক্ষ বল উইন করে ফেলে। কারণ এইবার আর কাউন্টার প্রেস করার সুযোগ নেই। যেহেতু মিড আর এটাকের মধ্যে ব্যবধানটা অনেক বড়। তাই খুব সহজে প্রতিপক্ষ বল পজেশন পেয়ে যায় এবং যথেষ্ট সময় ও স্পেস পাই সঠিক পাস দেওয়ার। ব্রাজিল, স্পেন দুইটি দলই এইভাবেই জার্মানীকে এক্সপ্লয়েট করেছে। দেখার বিষয় লো বিশ্বকাপে কিভাবে এই বিষয়টা ট্যাকল করে।
তাদের আরেকটি দূর্বল জায়গা হল তাদের লেফট ব্যাক হেক্টর। অস্ট্রিয়ার সাথে ম্যাচে দেখা গিয়েছে, তাকে প্রেস করা হলে খুব তাড়াতাড়ি সে নার্ভাস হয়ে পড়ে। প্রতিপক্ষরা অবশ্যি জার্মানীর এই দূর্বলতা লক্ষ্য করে থাকবে।তবে, লো চাইলে এইটাকে খুব সহজে প্রতিপক্ষের ট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে তাদের লং বল ট্যাকটিস দিয়ে।
জার্মানীর আরেকটা শক্তিশালী দিক হল তাদের সেট পিস এবং লং রেঞ্জ এবিলিটি। ক্রুসের ভিশন , হুমেলসের হেডিং গত বিশ্বকাপের সম্পূর্ণ প্যাকেজ ছিল এইটা। জার্মানী বিভিন্ন ট্যাকটিকস ব্যবহার করে সেট পিসে। এইবারের বিশ্বকাপে তাই দেখা যেতে নতুন কোন ট্যাকটিকস।
আরেকটি জিনিস এই জার্মান দলকে এগিয়ে রাখবে তা হল অভিজ্ঞতা। এই জার্মান দলের ৮ জনেরই গতবার ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। বিহ্বকাপের মত মঞ্চগুলোতে অভিজ্ঞতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেইটা বোধ হয় নতুন করে বলার কিছু নেই।
সব শেষে বিশ্বকাপের আগে লোর ইন্টারভিউ কিছু চুম্বক অংশ এইখানে তুলে ধরা যাক। “টানা ২ টা বিশ্বকাপ জিতা খুবই কঠিন কাজ। প্রতিপক্ষরা নিজেদের ইম্প্রুভড করেছে। খেলা হয়েছে আরো গতি সম্পন্ন। কোচ হিসেবে আমার দায়িত্ব, আধুনিক ফুটবল কোন দিকে সেই খোজ খবর রাখা। আর আমার খেলোয়াড়দের এমনভাবে তৈরী করা যাতে তারা সব পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। ভার্সেটাইলিটিই হচ্ছে আধুনিক ফুটবলের মূল অস্ত্র। “