অপেক্ষার প্রহর শেষ। মাঠে গড়িয়েছে “গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ”। দীর্ঘ চার বছর ধরে ফুটবল অনুরাগী রা অপেক্ষা করছিলো এই মুহূর্তের জন্য। ফুটবল বিশ্ব আবারো প্রস্তুত এই উন্মাদনার জ্বরে মেতে উঠতে। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচই অন্যরকম উত্তেজনা বহন করে। তবে তার মধ্যেও কিছু ম্যাচ থাকে, যেগুলোর উত্তাপ টের পাওয়া যায় অনেক আগে থেকেই। বিশ্বকাপ গ্রুপ বি তে উত্তেজনার পরশ আরও ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ফিফা বিশ্বকাপ এ জায়গা করে নেয়া ৩২ টি দলকে গ্রুপ ভিত্তিক ভাগ করা হয় মস্কোতে। সেই সুবাদে গ্রুপ বি তে জায়গা করে নেয় স্পেন, পর্তুগাল, মরোক্কো এবং ইরান। গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের পর থেকেই এই গ্রুপ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন যখন গ্রুপ পর্বেই মুখোমুখি, তখন কৌতুহল না থাকার কোন কারণই নেই। বড় ধরণের কোন অঘটন না ঘটলে পরবর্তী রাউন্ডে কারা যাবে, তা বলা খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন কে হবে, সেটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে এখনো।

পর্তুগালঃ পর্তুগালের নাম বললেই সবার আগে চলে আসবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর নাম। দলের সেরা তারকার পারফর্ম্যান্সের উপর নির্ভর করবে পর্তুগালের বিশ্বকাপ যাত্রা। ইউরোপ জয় করার পর, রোনালদো বাহিনীর চোখ এখন বিশ্বকাপের উপর। ২০১৬ ইউরো তে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা প্রমাণ করেছে যেকোন বড় শিরোপা জিতার জন্য তারা প্রস্তুত। ইউরো জয়ী সেই অভিজ্ঞ দলের বেশীরভাগ খেলোয়াড়ই অন্তর্ভুক্ত আছেন এই বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। পেপে ফন্টে দের নিয়ে গড়া দারুণ রক্ষণভাগ, কার্ভালহো-মৌতিনহোদের সৃজনশীল মাঝমাঠ এবং আক্রমণ ভাগে রোনালদো কে নিয়ে তৈরী পর্তুগাল দল নিঃসন্দেহে টুর্নামেন্টে ভালো কিছু করার ক্ষমতা রাখে।

মূল তারকাঃ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। বাছাইপর্বে করেছেন ১৫ গোল। আন্দ্রে সিলভাও ৯ গোল দিয়ে প্রমাণ করেছেন, দলের হাল ধরতে প্রস্তুত তিনিও। উইলিয়াম কারভালহো, মাঝমাঠে তার দায়িত্ব পালনের উপর দলের সাফল্য নির্ভর করবে অনেক খানি।
বাছাইপর্বে পার্ফমেন্সঃ ১০ ম্যাচের মধ্যে ৯ টিতেই জয়লাভ করে গ্রুপে সবার উপরে থেকে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছে পর্তুগাল।
ম্যাচঃ ১০
জয়ঃ ৯
ড্রঃ ০
পরাজয়ঃ ১
গোল দিয়েছেঃ ৩২
হজম করেছেঃ ০৪
কোচঃ ২০১৪ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দল কে গুছিয়ে নিয়েছেন দারুণভাবে। কিছুটা রক্ষণমনা এই কোচ দলের রক্ষণভাগ কে সাজিয়েছেন সুনিপুণভাবে। বাছাইপর্বে মাত্র ৪ গোল হজমই তার প্রমাণ।
স্পেনঃ ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বে রাজত্ব করার পর স্পেন যেনো কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছিলো। ২০১৪ বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ ইউরো তে ভরাডুবির পর কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কের বদলে দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়েছিলো লোপেতেগুইয়ের হাতে। দায়িত্ব নেয়ার পরই দলকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। স্পেন ও ফিরেছে ছন্দে। সর্বশেষ ১৮ ম্যাচ ধরে অপরাজিত থাকাই তার প্রমাণ। স্পেন ও পুরোপুরি প্রস্তুত আবারো বিশ্ব জয়ের জন্য।
গোলবার আগলাবেন ডেভিড ডে হায়া, রামোস-পিকের জমাট ডিফেন্স, ইনিয়েস্তা-ইস্কো দের নিয়ে করা মাঝমাঠ এবং স্ট্রাইকার হিসেবে দিয়েগো কস্তা। প্রতিটি সেক্টরেই বিশ্বসেরা খেলোয়াড় নিয়ে গড়া এই দলের প্রতি বাজি ধরা যায় চোখ বন্ধ করেই।

মূল তারকাঃ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং সৃজনশীল খেলোয়াড়, নিজের শেষ বিশ্বকাপ টাকে স্মরণীয় করে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবেন। গোলকিপার ডেভিড ডে হায়া এবং সার্জিও রামোসও হতে পারেন ম্যাচের নায়ক।
বাছাইপর্বঃ ফর্মের তুংগে থাকা স্পেন দল বাছাইপর্বেও উড়ছিলো। ১০ ম্যাচের মধ্যে ৯ টিতেই জয়, বাকি ম্যাচ টি ড্র। গোল করেছে ৩৬ টি হজম করে মাত্র ৩ টি।
ম্যাচঃ ১০
জয়ঃ ৯
ড্রঃ ১
পরাজয়ঃ ০
গোল দিয়েছেঃ ৩৬
হজম করেছেঃ ০৩
কোচঃ বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগে কোচ লোপেতেগুইকে দায়িত্বচ্যুত করা হয়। নতুন কোচ দলের সাথে কতোটা মানিয়ে নিতে পারে তা বুঝা যাবে প্রথম ম্যাচেই।
মরোক্কোঃ দীর্ঘ ২০ বছর পর বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে মরোক্কো। চমৎকার কিছু তরুণ খেলোয়াড় দের নিয়ে গড়া দলটি বিশ্বকে চমকে দিয়েছে তার মনোমুগ্ধকর খেলার মাধ্যমে। ইস্পাত কঠিন ডিফেন্স, সাথে দ্রুতগতির আক্রমণ এই নীতিতে খেলে আসা মরোক্কো প্রমাণ দিয়েছে তারা অবহেলা করার মতো দল নয়। স্পেন বা পর্তুগাল কে রুখে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

মূল তারকাঃ মেহেদী বেনাশিয়া, অভিজ্ঞ এই খেলোয়াড় রক্ষনভাগ আগলে রাখবেন। হাকিম জায়েখ, নাবিল দিরার রা তাদের ট্যালেন্ট দিয়ে ম্যাচ ঘুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
বাছাইপর্বঃ বাছাইপর্বে অপরাজিত থাকা এই দলটি ৬ ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছে ৩ টি তে, বাকি ৩ ম্যাচ ড্র। গোল দিয়েছে ১১ টি। এই ৬ ম্যাচে একটি গোলও হজম করেনি তারা।
ম্যাচঃ ৬
জয়ঃ ৩
ড্রঃ ৩
পরাজয়ঃ ০
গোল দিয়েছেঃ ১১
হজম করেছেঃ ০
কোচঃ কোচ হার্ভে রেনার্ডের পূর্ব সাফল্য চোখে পরার মতো। এর আগে জাম্বিয়া এবং আইভরি কোস্ট কে নিয়ে আফ্রিকান কাপ অফ ন্যাশন্স জিতেছিলেন তিনি। অভিজ্ঞ এই কোচ তার ট্যাক্টিক্স দিয়ে গ্রুপ পর্ব উতরে যান কিনা তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আর কিছুদিন।
ইরানঃ এটি ইরানের পঞ্চম বিশ্বকাপ। এশিয়া থেকে এবারের বিশ্বকাপে সর্বপ্রথম কোয়ালিফাই করে ইরান। গতো বিশ্বকাপে একটি ম্যাচও জিততে না পারা ইরান, এবার করতে চায় ভিন্ন কিছু। দেখাতে চায় নিজের যোগ্যতা।

মূল তারকাঃ সাদমান আজমাউন, ২২ বছর বয়সী এই তরুণ খেলোয়াড় ইতিমধ্যে জাতীয় দলের হয়ে করেছেন ২২ গোল। যেকোন সময় ঘুড়িয়ে দিতে পারেন ম্যাচের মোড়।
বাছাইপর্বঃ বাছাইপর্বের সবম্যাচে ম্যাচে অপরাজিত আছে ইরান। শেষ দশ ম্যাচে গোল হজম করেছে মাত্র দুটি।
ম্যাচঃ ১০
জয়ঃ ৬
ড্রঃ ৪
পরাজয়ঃ ০
গোল দিয়েছেঃ ১০
হজম করেছেঃ ০২
কোচঃ কার্লোস কুইরোজ, ২০১৪ তে দায়িত্ব নেয়ার পর দলকে গুছিয়েছেন নতুন ভাবে। বের করে এনেছেন অনেক উঠতি তারকা। ইরান কে তৈরী করেছেন একটি লড়াকু দল হিসেবে। ২০১৪ বিশ্বকাপের মতো জয় ছাড়া ফিরতে চান না তিনি।
গ্রুপের হট ফেবারিট দুই দল স্পেন এবং পর্তুগাল। দলীয় শক্তিমত্তা, সাম্প্রতিক ফর্ম, বড় টুর্নামেন্টে পারফমেন্স বিবেচনায় স্পেন কিছুটা এগিয়ে থাকলেও, কোচ পরিবর্তনের পর দুই দল এখন অবস্থান করছে একই উচ্চতায়। গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হবে এই দুই জায়ান্ট। অনেকের মতে গ্রুপের ভাগ্য এখানেই নির্ধারিত হয়ে যাবে। এই ম্যাচ যে জিতবে সেই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু বিশ্বকাপ মানেই নাটকীয়তা। মরোক্কোর জমাট ডিফেন্স যেকোন এক দলকে রুখে দিলেই গ্রুপের সমীকরণ পালটে যাবে। সাম্প্রতিক ফর্ম বিবেচনায় দুই দলকে আটকে দেয়ার সম্পুর্ণ ক্ষমতাই আছে মরোক্কোর। সেই সাথে ইরানের সাথে হোচট খেয়ে বাদও পড়ে যেতে পারে যে কেউ। তাই আপাতদৃষ্টি তে যতোটা সহজ মনে হচ্ছে, গ্রুপের হিসেব নিকেশ ততোটা সহজ নয়। গ্রুপ পর্ব পার করতে নিজের সেরাটা দিতে হবে সবাইকে। বাইরে থেকে দেখতে সহজ মনে হওয়া এই গ্রুপটিই ফুটবল বিশ্বকে সবচেয়ে বড় নাটকীয়তা উপহার দিতে পারে। তবে কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে স্পেন, গ্রুপ রানার্স আপ পর্তুগাল, তৃতীয় স্থান মরোক্কো এবং চতুর্থ ইরান। খাতা কলমের হিসাব আর বাস্তবতায় ফারাক কতোটুকু হয়, তা বুঝা যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই।
Reference:
Fifa.com
Whoscored.com