সৌন্দর্যমণ্ডিত তুরস্কের শ্রেষ্ঠ মসজিদ গুলো
ইস্তাম্বুল, তুরস্কের সবচেয়ে বৃহৎ শহর। যে শহরটির অলি-গলিতে রয়েছে অপূর্ব সৃষ্টি শৈলীর ইসলামী স্থাপত্য। ইসলামী স্থাপত্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মসজিদ। তুরস্কের একমাত্র ইস্তাম্বুলেই রয়েছে ৩০০০ এর বেশী মসজিদ। সারা বিশ্বের মসজিদ গুলোর মধ্যে তুরস্কের মসজিদ গুলো সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে। তুরস্কের অসাধারণ সব মসজিদই তৈরি হয়েছে উসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনামলে। অটোমান সুলতানেরা নিজেদের নামকে মানুষের মনে চিরদিন ঠাই দেওয়ার জন্য তৈরি করে অপূর্ব সব মসজিদ। ইস্তাম্বুলের মসজিদ গুলোই তুরস্কের স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে। কিছু মসজিদের স্থাপত্যকে আজও হার মানাতে পারেনি আজকের আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যাও। ইস্তাম্বুলের সকল মসজিদের মধ্যে কয়েকটি মসজিদ রয়েছে যেগুলো অন্য সকল মসজিদের থেকে অনন্য।
আজ সেই রকম কয়েকটি অনন্য মসজিদ এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরলাম আপনাদের নিকট।
সুলতান আহমেদ মসজিদ ( নীল মসজিদ)
সপ্তদশ শতকের এই সৌন্দর্যমন্ডিত মসজিদটি অটোমান স্থাপত্যের একটি নিদর্শন স্বরূপ। অটোমান সুলতানদের নির্মিত মসজিদ গুলোর মধ্যে এই মসজিদটি অন্য সবগুলোর থেকে আলাদা। এই মসজিদটির সৌন্দর্যের নিকট অন্য সকল মসজিদের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। এই মসজিদটি তুরস্কের বিখ্যাত হাগিয়া হোফিয়ার সম্মুখে অবস্থিত। নীল রঙের টাইলস দিয়ে মসজিদের দেয়ালকে সাজানোর ফলে মসজিদটি আরো বেশী সুন্দর হয়ে উঠছে। এই মসজিদটির ৬ টি মিনার এর কারণে সুলতান আহমেদ মসজিদটি অন্য মসজিদ গুলোর থেকে স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করেছে কারণ অন্য সব মসজিদের মিনার সাধারণত ৩ টি থেকে ৪ টি হয়ে থাকে।
সুলতান আহমেদ মসজিদটি সুলতান প্রথম আহমেদের শাসনকালে ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ এর মধ্যে নির্মিত। অন্য সকল মসজিদের মত এই মসজিদেও এর নির্মাতা সুলতান আহমেদের কবর রয়েছে, একটি মাদরাসা রয়েছে এবং একটি এতিমখানা রয়েছে। এই মসজিদ আজও মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুলতান আহমেদ মসজিদকে অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ ক্লাসিক্যাল স্থাপত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইস্তাম্বুল শহরে যেসব পর্যটক আসেন তাদের অন্যতম প্রিয় স্থান সুলতান আহমেদ মসজিদ।
সুলেমানিয়া মসজিদ
সুলতান সুলেমান ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের ১০ম এবং শ্রেষ্ঠ সুলতান। সুলতান সুলেমান তার রাজত্বকালে অটোমান সাম্রাজ্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। সেই সময়ে তার মুখোমুখি হওয়ার মত খুব কম রাজা -বাদশা- ই ছিলেন।
সুলতান সুলেমান তার নিজের নামে একটি মসজিদ নির্মাণ। অটোমান সাম্রাজ্যের খ্যাতিমান আর্কিটেক্ট মিমার সিনান এই মসজিদটি নিজ তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করেন। এই মসজিদটি ইস্তাম্বুলের দ্বিতীয় বৃহৎ মসজিদ এবং আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। এই অসাধারণ মসজিদটি ষোড়শ শতকে নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদে অটোমান স্থাপত্য এবং বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের দুটি দিক লক্ষ্য করা যায়। অটোমান স্থাপত্যের মত করে লম্বা, সরু মিনারের সাথে বাইজেন্টাইন স্থাপত্যের নিদর্শন হাগিয়া সোফিয়ার মত একটি বড় গম্বুজকে ছোট অর্ধ গম্বুজ দ্বার সাপোর্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সুলেমানিয়া মসজিদটি।
সুলেমানিয়া মসজিদ আজও মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং মসজিদে মাদ্রাসার পাশাপাশি একটি এতিমখানাও রয়েছে। সুলতান সুলেমান যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়ার পর তার দেহের কিছু অংশ এনে এই মসজিদে দাফন করা হয়, এছাড়া এই মসজিদে সুলতানের স্ত্রী হুররাম সুলতানের ও মিমার সিনানের কবর রয়েছে।
ইয়েনি কামি মসজিদ
সাফিয়ে সুলতান ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের একজন ভালিদ সুলতান অর্থাৎ সে ছিলেন সুলতানে মা। তিনি ছিলেন সুলতান তৃতীয় মুরাদের মা এবং অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর নারী। এই মসজিদটি সাফিয়ে সুলতানের নির্দেশে ১৫৯৭ সালে নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে মসজিদটির নির্মাণকাজ অর্ধেক পথে থেমে যায়। অর্ধেক নির্মিত এই মসজিদটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয় এবং ১৬৬০ সালে এক অগ্নিকান্ডে মসজিদটির বড় একটি অংশ নষ্ট হয়ে যায়।
তার পরের বছর, রাজ স্থাপত্যবিদ মুস্তফা আগা সুলতান চতুর্থ মেহমেত এর মা ভালিদে তুরহান সুলতানকে মসজিদের নির্মাণ কাজটি শেষ করার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে ১৬৬৩ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং তুরস্কের অন্যতম বিখ্যাত মসজিদ হিসেবে স্থান পেয়েছে।
মসজিদের ভিতরের ইন্টেরিয়রের কাজ অসাধারণ। মসজিদের দেয়ালে টাইলসের কাজটি, যা ইজনিক টাইলস নামে পরিচিত, সেই টাইলসের কাজ অটোমান পরিচয় বহন করে।
রুস্তম পাশা মসজিদ
রুস্তম পাশা ছিলেন সুলতান সুলেমানের উজিরে আযম এবং সুলতানের একমাত্র কন্যা মিহরিমাহ সুলতানের স্বামী। রাজ জামাতা এবং উজিরে আযম হওয়ার কারণে রুস্তম পাশার ছিল প্রচুর সম্পত্তি। রুস্তম পাশা তার এই অঢেল সম্পত্তি দিয়ে নিজ নামে একটি মসজিদ তৈরি করেন। এছাড়া রুস্তম পাশা তার নিজের সম্পত্তি অনেক মহৎ কাজে ব্যয় করেছেন। তিনি বিভিন্ন পাবলিক বিল্ডিং এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠান করে গেছেন।
রুস্তম পাশা মসজিদের নির্মাণ ১৫৬১ সালে শুরু হয় এবং ১৫৬৩ সালে শেষ হয়। রুস্তম পাশা মসজিদের ইজনিক টাইলসের ডেকোরেশন ইস্তাম্বুলের সকল মসজিদের মধ্যে সেরা। রুস্তম পাশা মসজিদের ইজনিক টাইলসের অপূর্ব বিন্যাস এর কারণে এটি মানুষের অন্যতম পছন্দের মসজিদ। রুস্তম পাশা মসজিদের ইজনিক টাইলস এর ব্যবহার প্রায় সকল অটোমান স্থাপত্যে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই ইজনিক টাইলসের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কিত।
শেহজাদে মসজিদ
শেহজাদে মসজিদ হচ্ছে সুলতান প্রথম সুলেমানে অনুমোদিত মসজিদ। সুলতান সুলেমানের দ্বিতীয় এবং হুররাম সুলতানের বড় ছেলে শেহজাদে মেহমেত এর স্মৃতি স্বরূপ এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। শেহজাদে মেহমেত গুটি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৫৪৩ সালে মারা যান। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সুলতানের নির্দেশে রাজ স্থাপত্যবিদ মিমার সিনান নিজের প্রথম স্থাপত্য তৈরি করেন। ১৫৪৮ সালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। স্থাপত্য ঐতিহাসিকেরা এই মসজিদটিকে মিমার সিনানের প্রথম মাস্টারপিস হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন কারণ মিমান সিনান তার পরবর্তী স্থাপত্য গুলোকে আরো বেশী উন্নত করেন। তার তৈরি স্থাপত্য গুলো দেখলেই বোঝা যায় যে তিনি তার কৌশলের কিভাবে পরিবর্তন করেছেন। তিনি কলামগুলোকে মোটা করেছেন।
অন্য সকল মসজিদ হতে এই মসজিদকে ভিন্ন ভাবে ডেকোরেশন করা হয়। যেমন মসজিদের দুটি মিনারের মধ্যে জ্যামিতিক ভাবে পোড়ামাটির ভাস্কর্য আঁকা আছে।
হাগিয়া সোফিয়া
হাগিয়া সোফিয়া তার গম্বুজের কারণে আলাদা ভাবে পরিচিতি পায়। হাগিয়া সোফিয়াকে বাইজেন্টাইন স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এবং এই স্থাপত্যকে স্থাপত্যবিদ্যার পরিবর্তনের নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৩৬০ সালে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) এ গ্রিকদের ক্যাথেড্রাল ছিল কিন্তু অটোমানরা কনস্টান্টিনোপল বিজয় করার পর ১৪৫৩ সালে এটিকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এটি মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর তুরস্ক যখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত হয় তখন এটিকে যাদুঘর বানানো হয়।
এক হাজার বছরের মধ্যে এটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যাথেড্রাল। বর্তমান দালানটি সত্যিকার অর্থে খ্রিস্টান চার্চ হিসেবে ৫৩২ সালে নির্মাণ করা হয়। হাগিয়া সোফিয়াকে ডিজাইন করেন গ্রিসের মিলেটাস এর বিজ্ঞানী ইসিডর এবং ট্রালেস এর অ্যান্থেমিয়াস।
এই বিশাল শৈল্পিক কাঠামোটির ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়েছে সুন্দর সুন্দর মার্বেল এবং মোজাইক পাথর দ্বারা। হাগিয়া সোফিয়াকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে।
তথ্যসূত্র: www.globetreks.com