অটোমান সাম্রাজ্য, পুরো ইউরোপ জুড়ে ছড়ি ঘুরিয়েছে এই মহান মুসলিম রাজবংশ। তুরস্কের এই সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জীবনযাপন ছিল সেই সময়ে এক কথায় অনবদ্য। তবে অটোমান রাজ বংশে ছিল এক কঠিন আইন। যে আইনে সিংহাসনের জন্য ভাই, ভাইকে খুন করতে পারবে এবং সেটা বৈধ। অপর দিকে একজন অটোমান সুলতানের একাধিক খাস দাসী থাকত যারা সুলতানের সাথে থাকতেন এবং সন্তান জন্ম দিতেন। সেই কারণে প্রত্যেক মা চাইতেন তার নিজের সন্তানকে সিংহাসনে দেখতে। কিন্তু সবাই সেটা পারতেন না। সুলতানের উপর এবং প্রাসাদে যে সুলতানার প্রভাব থাকত বেশী সেই একমাত্র পারত। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যে একজন মাত্র নারী সুলতানের থেকেও বেশী ক্ষমতাধর হয়ে ছিলেন। তার ইশারায় সুলতান পরিবর্তন হতো, এত টাই ক্ষমতাধর নারী ছিলেন সেই নারী কোসেম। তিনি সুলতান প্রথম আহমেদের বিবাহিত স্ত্রী এবং সুলতান চতুর্থ মুরাদ এবং সুলতান ইব্রাহিমের মাতা।
কোসেম সুলতান জীবিত কালে অটোমান সাম্রাজ্যে ছয় জন সুলতান সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তার ক্ষমতা ছিল সুলতানের আয়ত্তের বাইরে।

Source: Pinterest
প্রাথমিক জীবন
আনুমানিক ১৫৮৯ সালে তিনোস দ্বীপে কোসেম সুলতান জন্মগ্রহণ করেন।
কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কোসেম ছিল গ্রিক বংশোদ্ভূত তিনোস দ্বীপের (পূর্ব নাম আনাসতাসিয়া) একজন ধর্মযাজকের মেয়ে। কিন্তু এই সূত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না অনেক ঐতিহাসিক।
কাভিদ বাইসুন নামক এক ঐতিহাসিক বলেন যে, মাত্র পনের বছর বয়সে তাকে বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ দাসী হিসবে ইস্তাম্বুলে এনে সুলতান প্রথম আহমেদের হারেম এ পাঠান। পরবর্তীতে মুসলিম হওয়ার পর তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মাহপেয়কার যার অর্থ চাঁদের মত মুখ যার এবং তার পরে সুলতান প্রথম আহমেদ তার নাম রাখেন কোসেম।
কোসেম থেকে হাসেকি সুলতান
অটোমান সুলতানদের হারেম পরিচালনার দায়িত্ব থাকত সুলতানাদের কাছে এবং হারেম পরিচালনার দায়িত্ব বংশানুক্রমে পরিবর্তিত হতো। কোসেম সুলতান আহমেদের খাসবাদী হওয়ার পর থেকে তার জীবন রাতারাতি বদলে যেতে থাকে। কোসেম খাসবাদী থাকার সময় হারেম এর কর্তৃত্ব ছিল সুলতানের দাদী সাফিয়ে সুলতানের হাতে। কিন্তু সাফিয়ে সুলতান ১৬০৪ সালে তার কর্তৃত্ব হারান এবং তিনি তার বাকি জীবন অন্য একটি প্রাসাদে কাটান। একই বছর সুলতান আহমেদের মা এবং ভ্যালিদে হান্দান সুলতান এর মৃত্যুর পর কোসেম সুলতানের নিকট সুযোগ আসে হারেম এর কর্তৃত্ব পাওয়ার।
সুলতান আহমেদ তাকে বিবাহ করলে তিনি হাসেকি সুলতান হিসেবে আখ্যা পান। কোসেম সুলতান অনেক গুলো সন্তান জন্ম দেন এবং হারেমের কর্তৃত্বও ছিল তার হাতে।
ইস্কি সারাহ প্রাসাদে নির্বাসন
সুলতান প্রথম আহমেদ মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা যাওয়ার কারণে কোসেম সুলতান তোপকাপি প্রাসাদে তার অবস্থান হারিয়ে ফেলেন এবং তাকে তোপকাপি প্রাসাদ হতে ইস্কি সারাহ প্রাসাদে থাকতে দেওয়া হয়। সুলতান প্রথম আহমেদ মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে প্রথমবারের মত সুলতানের ছেলে না বসে তার ভাই প্রথম মুস্তফা বসেন যিনি ছিলেন একজন পাগল প্রকৃতির মানুষ। খুব দ্রুত মুস্তফাকে সরিয়ে সুলতান বানানো হয় কোসেম সুলতানের সৎ ছেলে দ্বিতীয় ওসমান কে।

Source: Pinterest
যেহেতু কোসেম সুলতানের ছেলে সিংহাসনে বসতে পারেন নাই তাই অটোমান রাজ বংশের রীতি অনুযায়ী তাকে অন্য কোন জৌলুসহীন প্রাসাদে থাকতে হবে। কিন্তু কোসেম সুলতানকে খুব বেশী দিন পুরাতন বা ইস্কি প্রাসাদে থাকতে হয় নি। তার ছেলে চতুর্থ মুরাদ সিংহাসনে আরোহণ করার পর তিনি পুনরায় হাসেকি সুলতান পদবী ব্যবহার করতেন এবং তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে ১০০০ আর্চে করে খরচ দেয়া হতো। কোসেম সুলতানের মৃত্যুর পর হাসেকি সুলতান পদবীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ভ্যালিদে সুলতান
অটোমান সাম্রাজ্যে যেসব সুলতানার সন্তান সিংহাসনে আরোহণ করত তাদেরকে ভ্যালিদে সুলতান বলা হতো। ভ্যালিদে সুলতানের অধীনে হারেম গুলো পরিচালিত হতো। কোসেম সুলতানের ভ্যালিদে সুলতান হিসবে ক্ষমতা প্রাপ্তি প্রয়োগ মোট তিনটি ধাপে ছিল।
প্রথম ধাপ
সুলতান প্রথম আহমেদের মৃত্যুর পর কোসেম সুলতান যে অবস্থান হারান সেই অবস্থানে আবার ফিরে আসেন যখন তার ছেলে সুলতান চতুর্থ মুরাদ সিংহাসনে বসেন। সুলতান মুরাদ ১৬২৩ সালে সিংহাসনে বসার পর কোসেম সুলতান অটোমান সাম্রাজ্যের শীর্ষ অবস্থানে চলে আসেন। সুলতান চতুর্থ মুরাদ অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে কোসেম সুলতান নিজেকে শুধু ভ্যালিদে সুলতানে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি নিজেকে একজন রাজপ্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেন। সুলতান চতুর্থ মুরাদের ১৬২৩ সাল হতে ১৬৩২ সাল পর্যন্ত শাসনকালে কোসেম সুলতান পিছন থেকে সাম্রাজ্য চালাতেন। তিনি পর্দার আড়ালে থেকে রাজ সভায় অংশগ্রহণ করতেন। এমন কি ১৬৩২ সালের পর যখন তিনি রাজপ্রতিনিধি ছিলেন না তখনও।

কিন্তু কিছু বছরের মধ্যেই সাম্রাজ্যে অরাজকতা দেখা দেয়। পারস্যের সাফাবিদেরা ইরাক দখল করে নেয় এবং উত্তর আনাতোলিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। এসব দেখে জেনেসারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে উজিরে আযমকে মেরে ফেলেন। এটা দেখে সুলতান মুরাদ ভয় পেয়ে যান এবং তাকেও তার সৎ ভাই দ্বিতীয় উসমানের মত মেরে ফেলা হবে ভেবে ভয় পেয়ে সুলতান পদ থেকে সরে যান। সেই সময় থেকে কোসেম সুলতানের আসল শাসন শুরু হয়।
দ্বিতীয় ধাপ
কোসেম সুলতানের আরও একজন ছেলে ছিল যার নাম ছিল ইব্রাহিম। সুলতান মুরাদ তাকে মেরে ফেলার আদেশ দেন। কিন্তু সে সময় তাকে তার মা কোসেম সুলতান বাঁচান। সুলতান চতুর্থ মুরাদের পর ইব্রাহিম ছিলেন তাদের মৃতপ্রায় রাজবংশের শাহজাদা। মুরাদের মৃত্যুর পরও ইব্রাহিম ভাবতেন মুরাদ এখনও বেচে আছে এবং এটা হয়ত তার ফাঁদ। কিন্তু কোসেম সুলতান এবং উজিরে আযম মুরাদের লাশ দেখানোর পর ইব্রাহিম সিংহাসনে বসেন। কিন্তু ইব্রাহিম রাজ্য পরিচালনার জন্য মানসিক ভাবে অযোগ্য ছিল। এর ফলে আবার ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন কোসেম এবং তিনিই সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন আড়াল থেকে।
১৬৪৭ সালে কোসেম সুলতান এবং উজিরে আযম সালিহ পাশা ইব্রাহিমকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে ব্যর্থ হন কিন্তু তিনি তার আরেক সন্তানকে সিংহাসনে বসান।
এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর সালিহ পাশাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং কোসেম সুলতানকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার পরের বছর জেনেসারি এবং ওলামাগণ বিদ্রোহ শুরু করলে ইব্রাহিমকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং তোপকাপি প্রাসাদে বন্দি করা হয়। ইব্রাহিমের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে নতুন উজিরে আযম আদেশ স্থগিত করতে বলেন। কিন্তু ওলামাগণ ফতোয়া দেন যে “যদি দুইজন খলিফা থাকে তবে একজনকে মেরে ফেলো”। কোসেম সুলতান ইব্রাহিমের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেই সায় দেন। ১৯৪৮ সালে ইব্রাহিমকে মেরে ফেলা হয়।

Source: Wikipedia
তৃতীয় ধাপ
কোসেম সুলতান তার ৭ বছরের নাতি চতুর্থ মেহমেদকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে সরাসরি সাম্রাজ্য পরিচালনা করা শুরু করেন। তিনি নিজেকে পুনরায় রাজপ্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করে সাম্রাজ্যের সকল দায়িত্ব পালন করেন শিশু নাতিকে সামনে রেখে। চতুর্থ মেহমেদ সিংহাসনে বসার কারণে ভ্যালিদে সুলতান হন তুরহান সুলতান। কিন্তু কোসেম সুলতান ভ্যালিদে সুলতানের পদ ছেড়ে দেন নি।
মৃত্যু
তুরহান সুলতান কোসেম সুলতানের অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে চাইলেন। তুরহান সুলতান এর বয়স যখন মাত্র ১২ বছর তখন ক্রিমিয়ার খান তাকে উপহার হিসেবে তোপকাপি প্রাসাদে পাঠান। কোসেম সুলতান নিজে ইব্রাহিমের জন্য তুরহান সুলতানকে খাসদাসী হিসেবে পছন্দ করেন। কিন্তু তুরহান সুলতান বিনা রক্তপাতে নিজের পদ দখল করতে চাইলেন। তুরহান সুলতানের পক্ষে ছিল উজিরে আযম এবং কোসেম সুলতানের পক্ষে ছিল জেনেসারিরা। কোসেম সুলতান ভ্যালিদে সুলতান পদকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নিয়ে জেনেসারিদেরকে কোসেম সুলতানের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রভাব খাটান।
ক্ষমতার যুদ্ধে কোসেম সুলতান তার নাতি মেহমেদকে সরিয়ে আরেক জনকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তুরহানের আদেশে হোক বা অন্য কারো আদেশে হোক কোসেম সুলতান তার ব্যর্থ চেষ্টার তিন বছর পর খুন হন। মনে করা হয় তুরহান সুলতানই এই আদেশ দিয়েছিলেন। ১৬৫১ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের এই ক্ষমতাধর নারীর মৃত্যুর পর তাকে তার স্বামী প্রথম আহমেদের কবরের পাশে কবর দেয়া হয়।
অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই নারী সুলতান না হয়ে সুলতানের মত করে সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন যা অটোমান সাম্রাজ্যের ৮০০ বছরের ইতিহাসে আর কোন নারী এটি করতে পারেন নি। কোসেম সুলতানের এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য অটোমান নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত হয়ে আছেন।

Source: doyouknowturkey.com
কোসেম সুলতানের ৫ জন ছেলে ছিল তারা হচ্ছে-
১. শাহজাদা মেহমেদ
২. চতুর্থ মুরাদ
৩. শাহাজাদা কাশিম
৪. শাহজাদা সুলায়মান
৫. ইব্রাহিম
কোসেম সুলতানের ৪ জন মেয়ে ছিল, তারা হলেন-
১. আয়েশা সুলতান
২. ফাতেমা সুলতান
৩. গেভহারহান সুলতান
৪. হানজাদে সুলতান
চ্যারিটি
কোসেম সুলতান সাম্রাজ্যে সাধারণ মানুষ এবং শাসক শ্রেণী উভয়ের জন্য দান করেছেন। তিনি প্রতি জেল খানায় গিয়ে কিছু মানুষকে মুক্ত করে দিতেন। তিনি গরীব পরিবারে মেয়েদের দক্ষ করে তাদের বিয়ে দিতেন। তিনি ১৬৪০ সালে উস্কুদারে একটি মসজিদ ও স্কুল তৈরি করেন। তিনি ভ্যালিদে মাদরাসা তৈরি করেন, মানুষের জন্য পানির ঝরনা তৈরি করেছেন। তিনি ইস্তাম্বুলের বাইরেও পানির ঝরনা তৈরি করেছেন। তিনি মিশরের বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করেছেন, এবং মক্কার গরীব মানুষদের সাহায্য করেছেন।
কোসেম সুলতানের জীবন নিয়ে সিনেমা
১. ওসমান ভার্সেস সুলতান মুরাদ (মুভি ১৯৬২)
এই ছবিতে কোসেমের চরিত্রে মুহতেরেম নূর অভিনয় করেছেন।
২. চতুর্থ মুরাদ, টিভি সিরিজ
কোসেম চরিত্রে আয়তেন অভিনয় করেছেন।
৩. মুহতেশেম ইউজিয়েল: কোসেম টিভি সিরিজ টি বাংলাদেশে সুলতান সুলেমান কোসেম নামে দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে।
Comments are closed.