ফুটবল বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে যত সব অজানা তথ্য
ফুটবলার এবং ফুটবলপ্রেমী সবার কাছেই ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ট্রফি অন্যান্য ট্রফির তুলনায় একটি ভিন্ন মাত্রার নান্দনিক শিল্প। ফুটবলের সর্বসেরা এই ট্রফির সমৃদ্ধ রূপকথা আর পৌরাণিকতা ক্রীড়াবিদদের অতিমানবীয় কীর্তির ক্ষেত্রে সর্বদা অনুপ্রাণিত করে। ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফির বুৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল? এটির নির্মাতা কে? এটির আসল ইতিহাসটিই বাকি?
জুলে রিমে কাপ
জুলে রিমে কাপ (প্রকৃত অর্থে যার নাম দেয়া হয়েছিল ইংরেজিতে ‘ভিক্টরি’) ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ীদের প্রদান করা হত। ফিফা ইতিহাসের ৩য় প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে ১৯২৯ সালে প্রথম কোন আন্তঃদেশীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজনের পক্ষে ভোট প্রদান করেছিলেন। তার এক বছর পরই তিনি বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে হাতে ট্রফি তুলে দিতে সমর্থ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জুলে রিমের স্মরণেই এই ট্রফির নামকরণ করা হয় জুলে রিমে কাপ।
ফ্রেঞ্চ ভাস্কর আবেল লেফলয়োর দ্বারা ডিজাইন করা এই ট্রফিতে প্রাচীন গ্রীক পুরাণের বিজয়ের দেবীকে চিত্রায়িত করা হয়েছিল যাকে কিনা একটি দশ কোণা বিশিষ্ট কাপ হাতে দেখা যায়। এই অনন্য শিল্পটির ওজন ছিল ৩.৮ কেজি, এটি সোনায় মোড়ানো রুপা দিয়ে তৈরি ছিল এবং লাপিস লাযুলির ভীতের উপর দাঁড় করানো ছিল। তাই এই ট্রফি ‘সোনালি দেবী’ বলে একটি ডাকনামেও লোকমুখে সুপরিচিত ছিল।
কাপটির নিচের দিকের সোনালি ফলকের চারদিকে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বিশ্বকাপজয়ী দেশগুলোর নাম খোদাই করা হয়েছিল। দেশগুলো ছিল: উরুগুয়ে (১৯৩০, ১৯৫০), ইতালি (১৯৩৪, ১৯৩৮), জার্মানি (১৯৫৪), ইংল্যান্ড (১৯৬৬) এবং ব্রাজিল (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০)। ১৯৭০ সালের জুনে মেক্সিকোতে তাদের ৩য় ফিফা বিশ্বকাপ জয়ের দরুন ব্রাজিল দল তৎকালীন ফিফা নিয়মানুসারে জুলে রিমে কাপ আজীবনের মত নিজ দেশে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
জুলে রিমের নামে এই কাপটির নামকরণ অনেকটাই যুক্তিযুক্ত ছিল কারণ ফিফার ইতিহাসের ৩য় এই প্রেসিডেন্ট ১৯২১ সাল থেকে প্রায় ৩৩ বছর যাবত নিজের দায়িত্ব সসম্মানে পালন করে গিয়েছিলেন। প্রথম আন্তঃদেশীয় ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্য বিশ্ব জুলে রিমের কাছেই সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবে। তিনিই বিভিন্ন দেশের উচ্চ সরকারী কর্মকর্তা, ফুটবল সংস্থা এবং জাতীয় দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরি করে এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়ভার নেন যা ছিল তখনকার সময়ে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে ৪ বছর অন্তর বিশ্বকাপ আয়োজন এবং ফিফা সংস্থাটিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে তিনি সারা পৃথিবীতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। যখন জুলে রিমে অবসর নেন তখন ফিফার মোট সদস্য দাঁড়ায় ৫৬ টি দেশ যা ১৯২০ সালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ।
তিনটি চুরি এবং একটি কুকুর
১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপেই জুলে রিমে কাপ যাত্রীবাহী জাহাজ ‘এসএস কন্তে ভারদে’ তে করে আটলান্টিক ওপারের উরুগুয়ে পরিভ্রমণ করে। ১৯৩৮ সালে যখন সারা পৃথিবীতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের আভাস ছড়িয়ে পড়ে তখন কাপটি ছিল সেই বছরের বিশ্বকাপ জয়ী ইতালির কাছে। তৎকালীন ইটালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট অটোরিনো বারাসি তখন কাপটিকে এমনভাবে লুকিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেন যাতে করে সবার মনে হয় এটি চুরি হয়ে গেছে। তিনি গোপনে ব্যাংক ভল্ট থেকে কাপটি সরিয়ে ফেলেন এবং নিজ বেডের নিচের জুতার বাক্সে রেখে দেন যাতে করে নাৎসি বাহিনী এটিকে কোনভাবেই খুঁজে না পায়। কাপটি সেবার ঠিক মতই সংরক্ষিত হয়েছিল এবং আশ্চর্যবশত হলেও সত্যি যে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপটিতে চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে এই কাপটির মাধ্যমেই পুরস্কৃত করা হয়।
১৯৬৬ সালের ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আর মাত্র ৪ মাস বাকি! ওয়েস্ট মিনিস্টার সেন্ট্রাল হলে ২৪ ঘণ্টার কড়া পাহারার পরেও ২০ মার্চ, ১৯৬৬ সালে জুলে রিমে কাপ ২য় বারের মত চুরি হয় যা সারা পৃথিবীতে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল। লন্ডনের পুলিশ বাহিনী চোরের খোঁজে তখনকার সময়ে ১৫,০০০ পাউন্ডের পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল।
বিশ্বকাপের আগে জুলে রিমে কাপ উদ্ধার করা যাবে না এই ভয়ে ইংরেজরা তড়িঘড়ি করে আরেকটি রেপ্লিকা কাপ তৈরি করার ব্যবস্থা করে। ‘পিকলস’’ নামের একটি কুকুর সেবার ইংল্যান্ডের মান ইজ্জত বাঁচাতে অবদান রাখে। পিকলস কাপটিকে দক্ষিণ লন্ডনের এক বাগানের ঝোপ থেকে সংবাদপত্রে মোড়ানো অবস্থায় এটিকে খুঁজে পায়। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর পিকলস কুকুরের মালিক ডেভিড করবেটকে একটি গালা ডিনারে নিমন্ত্রণ করা হয় এবং পুরস্কার স্বরূপ ৬০০০ পাউন্ড দেওয়া হয়। অন্যদিকে ক্ষুদে তারকা কুকুর পুরস্কার হিসেবে পায় আজীবন ডগ ফুডের যোগান। ১৯৯৭ সালে ইংরেজরা নিরাপত্তার ব্যাপারটি মাথায় রেখে ২৫৪,৫০০ পাউন্ডের বিনিময়ে নিলামের মাধ্যমে ফিফাকে সেই রেপ্লিকা কাপটি বিক্রি করে দেয়।
অন্যদিকে ১৯৭০ সালে আসল কাপটি ব্রাজিলে স্থানান্তরিত হয় কিন্তু কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে আবার হতবাক করা সংবাদ নিয়ে আসে ‘সোনালী গ্রীক দেবী’। কিছু অসৎ প্রকৃতির মানুষ ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের ডিসপ্লে কেবিনেট থেকে এটিকে চুরি করে। চুরির জন্য ৪ জন মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও কাপটিকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্রাজিলিয়ানরা তাই জুলে রিমে কাপের আরেকটি রেপ্লিকা জন্য অর্ডার করে।এখন পর্যন্ত কেউ জানে না যে সেই আসল কাপটির মূলত কি হয়েছিল। লোকমুখে এমন শোনা যায় যে এটিকে গলিয়ে বিক্রি করা হয়েছে অথবা কোন ধনকুবেরের ব্যক্তিগত কালেকশনে এটির ঠাই হয়েছে।
নতুন ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি
ব্রাজিলকে জুলে রিমে কাপ আজীবনের জন্য দিয়ে দেওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপের জন্য ফিফাকে একটি নতুন ট্রফি নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালে সাত দেশের ভাস্করদের থেকে মোট ৫৩ টি ডিজাইন উত্থাপন করা হয়েছিল। সিল্ভিও গাজ্জানিগা যিনি কিনা এই বিশ্বকাপ ট্রফির কারিগর নিজেই ২ টি ডিজাইন জমা করেছিলেন। তবে তার প্রথম ডিজাইনটিই গৃহীত হয়।
পূর্বসূরির তুলনায় নতুন ট্রফিটি ছিল তুলনামূলকভাবে ভারি, ৫ কেজি ওজনের ১৮ ক্যারট সোনা দিয়ে তৈরি। ট্রফিটির মোট ওজন ছিল ৬.১৪২ কেজি এবং উচ্চতা ৩৬.৮ সেন্টিমিটার। ট্রফির ভীতটির ব্যাস ১৩ সেন্টিমিটার যেটি কিনা দুই স্তরের ম্যালাসাইট (অলঙ্কারে ব্যবহৃত সবুজ পাথর) দ্বারা আবৃত। এই দুই স্তর সবুজ ফুটবল মাঠকে সম্বোধন করে থাকে। কাপের উপরের দিকে দুইটি মনুষ্য মূর্তি দেখা যায় যারা গোলাকার পৃথিবী স্বরূপ বস্তুকে ধরে রেখেছে।
“দুইজন খেলোয়াড় তাদের বাহুগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিজয় উল্লাস ও আনন্দঘন মুহূর্তকে চিত্রিত করে’, গাজ্জানিগা ব্যাখ্যা করেন। “উপরের গোলাকার বস্তুটি মহাদেশগুলোর ছবিকে প্রতিফলিত করে। গোলাকার বস্তুটি ফুটবলকেও সম্বোধন করে। দুই প্রতিবিম্বাকার খেলোয়াড়দের মধ্যের লাইনগুলো ক্রীড়াশক্তিকে প্রকাশ করে। লাইনগুলো ভীত থেকে শুরু হয়ে পুরো কাপটিতে আঁকাবাঁকা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে”।
ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফির ভীতটি দুইটি সবুজ ম্যালাসাইটের আবরণে আবদ্ধ। এই দুইটি আবরণকে একটি সোনালী স্তর পৃথক করেছে যেখানে ইংরেজিতে ‘FIFA WORLD CUP’ কথাটি স্পষ্ট করে খোদাই করা আছে। পুরো ট্রফিটি একটি সোনালী প্লেটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কাপের নিচের দিকে বিশ্বকাপ জেতা দেশগুলোর নাম তাদের নিজ দেশের ভাষায় খোদাই করা আছে। যেমন: “1974 Deutschland” অথবা “1994 Brazil”।
নামগুলো গোলাকার সারিতে লেখা আছে এবং ভবিষ্যৎ চ্যাম্পিয়নদের নামের জন্যও আলাদা জায়গা আছে।
কোথায় সংগৃহীত হয় এই ট্রফি
২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন দেশের কাছে এই ট্রফিটি থাকতো পরবর্তী বিশ্বকাপ মূল পর্বের ড্র না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু এখন আর এমনটি করা হয় না। বর্তমান ফিফার নিয়মানুযায়ী, প্রতি বিশ্বকাপের জয়ী দল একটি সোনার আবরণে মোড়ানো ব্রোঞ্জের রেপ্লিকা পুরস্কার হিসেবে পেয়ে থাকে।
আসল ফুটবল ট্রফিটি ২০১৬ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখের ফিফা ওয়ার্ল্ড ফুটবল মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। তাছাড়া এটি শুধু কোকাকোলার সৌজন্যে বিশ্ব ট্রফি পরিভ্রমণে সামিল হয়ে থাকে। ২০০৬ সালে প্রথম বিশ্ব ট্যুরে বের হয় বিশ্বকাপ ট্রফি।
ফিফা বিশ্বকাপের পৃথিবী পরিভ্রমণ
২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপের আগে ট্রফি ট্যুরটি ছিল ৩ মাস লম্বা। ট্রফিটি মোট ২৯ টি দেশ ভ্রমণ করে। অন্যদিকে ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের আগে এটি ৮৪ টি দেশে ১৩৯,০০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে যার ৫০ টিই ছিল আফ্রিকা মহাদেশের দেশ।
ব্রাজিল বিশ্বকাপের আগে ৯০ টি দেশে বিশ্বকাপ ট্রফিকে স্বাগতম জানানো হয়। ট্যুরটি শুরু হয় রিও ডি জেনেরোতে এবং ২৬৭ দিন পর এটি শেষ হয়।
রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে অবশ্য আগের মাইলফলককে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। ২২ জানুয়ারি, ২০১৮ তে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ট্রফি ট্যুরে মোট ৫১ টি দেশ প্রদক্ষিণ করে এই ট্রফি। ১ মে তে ট্রফিটি রাশিয়া পৌছায় এবং ৯ টি স্বাগতিক শহরে এটি প্রদর্শিত হয়।