স্বাগতিকঃ
টানা দুবার ইউরোপ বিশ্বকাপ হওয়ার দরুন ‘৬২এর বিশ্বকাপ এর জন্য আমেরিকা মহাদেশ হুমকি হয়ে দাড়ায় এক প্রকার। সেবারও যদি ইউরোপ স্বাগতিক হত তাহলে হয়তবা আরও একবার বর্জন এর ঘটনা দেখা যেত।
চিলির ফুটবল ফেডারেশন কমিটি, কার্লোস ডিটবার্ন এবং জুয়ান পিন্টো ডরান এর নেতৃত্বে , অনেক দেশ ভ্রমণ করেন এবং বিভিং দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে নিজেদের অবস্থান, টুর্নামেন্ট আয়োজন করার ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করতে থাকেন আর্জেন্টিনার উচ্চতর ক্রীড়া অবকাঠামো এর প্রতি সম্মান রেখেই। ফিফা কংগ্রেস ১৯৫৬ সালের ১লা জুন পর্তুগালের লিসবনে মিলিত হয়। সেই দিন, আর্জেন্টিনার প্রার্থীর প্রতিনিধিত্বকারী রাউল কলম্বো, তার ভাষণে বলেন “আমরা বিশ্বকাপ শুরু করতে পারব আগামীকাল।” পরের দিন, ডিটহুড চিলির প্রার্থিতা সমর্থন করে চারটি আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করেন: চিলির ফিফা-সংগঠিত সম্মেলন এবং প্রতিযোগিতায়, স্পোর্টস জলবায়ু, জাতি এবং ধর্মের সহনশীলতা এবং দেশের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার ওপর ক্রমাগত অংশগ্রহণ। উপরন্তু, ডেটবার্গের ফিফা বিধিনিষেধসমূহের ধারা ২ কে উত্থাপন করেন। চিলি, আর্জেন্টিনার ১১ভোট এর বিপরীতে ৩২ ভোট এ জয়লাভ করে। তেরজন সদস্য ভোটদান থেকে বিরত থাকেন।
ভেন্যুঃ
আটটি ভিন্ন ভিন্ন শহরে আটটি স্টেডিয়াম বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য নির্বাচন করা হয়। সান্তিয়াগো, ভিনা দেল মার, র্যাঙ্কাগুয়া, আরিকা, তাল্কা, কনসেপসিওন, তালকাহুয়ানো এবং ভ্যালদিভিয়া।ভালদিভিয়া ভূমিকম্প, তৎকালীন রেকর্ড শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল যা ২২ মে ১৯৬০ সালে রেকর্ড করা হয়। ৫০হাজারের বেশি এবং ২ মিলিয়ন এর বেশি মানুষ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভূমিকম্প এর ফলে বিশ্বকাপ কমিটি বিশ্বকাপ এর ক্যালেন্ডার সম্পূর্ণরূপে সংশোধন করতে বাধ্য হন। তালকা, কনসেপসিওন, তালকাহুয়াও এবং ভ্যালদিভিয়া গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্থানগুলিকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এন্টোফাগস্টা ও ভ্যালপারাইয়োসো কোন ম্যাচের আয়োজক হলেও তাদের স্থানগুলি আর্থিকভাবে টেকসই ছিল না।

সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত স্টেডিয়াম ছিল সান্টিয়াগোতে এস্তাদিও নাসিওনাল, যার মধ্যে ১০টি ম্যাচ হয়েছিল; ভিনা ডাল মার এ অবস্থিত এস্টাদিও সাসাসলিটো 8টি ম্যাচ এবং রাঙ্কাগুয়া এবং আরিকা উভয়ই ৭টি করে ম্যাচ আয়োজন করে।
অংশগ্রহণকারী দলঃ
৫৭টি দল ১৯৬২ বিশ্বকাপের জন্য মনোনীত হয়। (প্রত্যাখ্যাত এন্ট্রি এবং প্রত্যাহারের কারণে, ৫২ টি দল শেষ পর্যন্ত বাছাই পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিল)। চিলি স্বাগতিক হিসেবে এবং ব্রাজিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসাবে সরাসরি সুযোগ লাভ করে। বাকি ১৪টি স্থান মহাদেশীয় কনফারেন্সেস মধ্যে ভাগ করে দেওয়া ছিল।
ইউরোপ থেকে ১০টি, কনমেবল অঞ্চল থেকে ৫টি এবং কনক্যাকাফ অঞ্চল থেকে একটি দেশ অংশগ্রহণ করে। ১ম বারের মত অংশগ্রহণ করে কলোম্বিয়া এবং বুলগেরিয়া। ৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট সুইডেন, সেমি-ফাইনালিস্ট ফ্রান্স বাছাইপর্ব পেরোতে ব্যর্থ হয়। বাছাইপর্ব চলাকালীন নিজেদের সরিয়ে নেয় অস্ট্রিয়া। ৫৮ বিশ্বকাপের মত এবারও স্কোয়াডে ২২জন করে প্লেয়ার ছিল।

ফরম্যাটঃ
৪ গ্রুপ থেকে মোট ৮টি দল পরের নক আউট রাউন্ড এর জন্য বিবেচিত হয়। কোয়াটার ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল, ৩য় স্থান নির্ধারণী, ফাইনাল এভাবে পূর্বের ন্যায় ফরম্যাট দাড় করানো হয়।বলা হয়ে থাকে যে ব্রাজিলের গারিঞ্চা ইতিহাসের সেরা ড্রিবলার। তার পায়ের জাদুতে নাকানিচুবানি খায়নি এমন ডিফেন্ডার পাওয়া বড় দায়। গারিঞ্চা আর ভাভা জাদুতে ভর করে ফাইনালে পৌঁছে যায় ব্রাজিল।
ব্যাটল অফ সান্তিয়াগোঃ
চিলি বিশ্বকাপ এর অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় এই ব্যাটল অফ সান্তিয়াগো। টুর্নামেন্ট এর প্রথম ২দিনের মাথায় ৪টি রেড কার্ড, ৩জনের পা ভেঙ্গে যায়, মচকানো গোড়ালি, রিব ফাটল এর ঘটনাও ঘটে। আর্জেন্টিনা-বুলগেরিয়া ম্যাচে রেফারি ৬৯টি ফাউল ধরেন(গড়ে প্রতি ৭৮সেকেন্ড এ একটি!!!)। ৬২এর বিশ্বকাপ কুখ্যাত হয়ে আছে ফাউলের জন্য। অতি জঘন্য মাত্রার ফাউলের শিকার হন খেলোয়াড়েরা। ইটালি-চিলি ম্যাচ শুরুর আগে যেমন চিলির দৈনিক ক্লারিক পত্রিকার শিরোনাম ছিল “Less a world cup and more a World War.”

ইটালি-চিলি ম্যাচের ১২মিনিটের মাথায় খুব বাজেভাবে চিলির হনোরিনো ল্যান্ডাকে আঘাত করে বসেন ইটালির জর্জিও ফেরিনি। রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখালেও মাঠ ছাড়তে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। পুলিশি হস্তক্ষেপে তাকে পরবর্তীতে বের করতে হয়।

এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরে ইটালির ডেভিডকে উদ্দেশ্যে চিলির সাঞ্চেজ ঘুষি মেরে বসেন যা রেফারির চোখ এড়িয়ে যায়। কিছু সময় পরেই প্রতিশোধ নিতে সাঞ্চেজ এর মাথায় লাথি মারতে উদ্যত হন তিনি। সাঞ্চেজ কোনমতে এড়িয়ে গেলেই এই জিনিস রেফারির চোখে পরে ঠিকই। ৪১মিনিটে কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন ডেভিড।

ফাইনালঃ
১৭ই জুন চিলির জাতীয় স্টেডিয়াম সান্তিয়াগোতে ৬৮,৬৭৯জন দর্শক উপস্থিত হয়। ব্রাজিল বনাম চেকোস্লোভাকিয়ার ম্যাচ দেখতে। ১৫মিনিটে চেকোস্লোভাকিয়া লিড নিলেও টা স্থায়ী হয় মাত্র ২মিনিটের জন্য। আমারিল্ডোর গোলে সমতায় ফেরে ব্রাজিল।

প্রথমার্ধ ১-১ গোলে শেষ হলেও ২য় হাফের শুরু থেকেই ম্যাচের নাটাই নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় ব্রাজিল। ভাভা, গারিঞ্চা, জিতোদের আক্রমণের তোপে চেকোস্লোভাকিয়া খেই হারিয়ে ফেলে। ৬৯ এবং ৭৮মিনিটে কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখাও পেয়ে যায় তারা। ব্রাজিলের মুকুটে যোগ হয় টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব।

সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ
পুরো টুর্নামেন্ট এ ৫৪ জন প্লেয়ার গোল করেন (মোট ৮৯টি গোল)। ৪টি গোল দিয়ে গারিঞ্চা, ভাভা, সাঞ্চেজ, আলবার্ট, ইভানভ, জার্কোভিচ যৌথভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।