“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশির বিন্দু।”
কবি যথার্থই বলেছেন, ঘুরতে পছন্দ করলেও জীবনে আমি ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পেয়েছি খুবই কম। জীবন আমার কেটেছে নিয়ন বাতির লাল আলোয় ভিজে থাকা ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তা দেখে। আমার কাছে সৌন্দর্য সীমাবদ্ধ ছিল স্কুলের ক্লাসরুমের জানালা থেকে শিলকড়ই বটগাছটা, আমার কাছে বৃষ্টি মানে ছিল চারতলার উপর থেকে কাঁদা পানি পায়ে নিয়ে মানুষের হেঁটে যাওয়া, পূর্ণিমা মানে আমার কাছে সোডিয়াম আলো (কেননা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চাঁদের আলো পার্থক্য করা যেত না!) আমার আকাশে আগে তারা গোনা যেত।
সেই আমি যখন বাকৃবিতে আসি তখন আস্তে আস্তে সৌন্দর্যের সংগা বদলাতে থাকে, প্রতিরাতেই যখন রিভার সাইডের ছাদে উঠে দেখতাম আকাশ ভরা তারা, তখন প্রায়ই আফসোস হতো শহরের চারদেয়ালে বন্দি থাকা মানুষগুলোর জন্য। যখন পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলো নদীর পানিতে চিকমিক করত তখন মনে হত এটাই বুঝি গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না।
কিন্তু না! আমার সব ধারণা ভেঙে গেল। ভয়ংকর সুন্দর বলতে আসলেই যে কিছু একটা আছে তা আমি জেনে গেছি এবার। যেই ভয়ংকর সুন্দর দেখার পর সবচেয়ে আপন মানুষটাকে তা দেখাতে ইচ্ছে করবে। আচ্ছা, আসল গল্পে ফিরে আসি! গিয়েছিলাম সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওরে! ছোটবেলা থেকে বইয়ের পাতায় পড়ে আসা সেই জায়গায়! হাওর আসলে কি তা নিয়ে আমার ধারণা ছিল না, কারণ আমি বড় হয়েছি রমনা পার্কের পুকুর দেখে!
খুউব সকালে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরবার জন্য আমারা যখন স্টেশনে যাই তখনো বুঝতে পারিনি কি দেখতে যাচ্ছি আসলে! ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে চড়ে মোহনগঞ্জে যাই, লোকাল ট্রেনে গাদাগাদি করে বসে গেছি সবাই, তবুও সবাই কত প্রফুল্ল তা মুঠোফোনের গ্যালারীতে জমে থাকা সেলফিগুলোই প্রমাণ করে।

Source: History and Travel-world heritage BD
ট্রেন থেকে নেমে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার উদ্দেশ্যে লেগুনাতে ওঠা, আমি সবসময়ই জানালা বা বাইরের সাইড প্রেফার করি, ধুলা খেতে হবে জেনেও লেগুনাতেও বাইরের পাশেই বসেছিলাম। বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দেখছিলাম, দুপাশে ধানক্ষেত, মাঝে রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে এগুচ্ছে লেগুনা। আমার পাশেই ছিল বাবু মীম, সুন্দর কিছু দেখলেই দুজন দুজনকে ডেকে দেখাচ্ছিলাম। কিছুদূর যেতে না যেতেই দৃশ্যপট বদলে গেল, দুপাশে পানি, মাঝে যাচ্ছে আমাদের লেগুনা, পানি স্বচ্ছ নীল, সে পানিতে আকাশের মেঘের ছায়া, রাস্তার গাছের ছায়া আর দূরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ের পাহাড়।
ঘন্টাখানেক পর লেগুনা থেকে নামলাম, তখন আমরা সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায়, নৌকার যাত্রা হবে সেখান থেকেই। নৌকার নিচতলায় থাকার ব্যবস্থা, যেখানে সব কাজ হামাগুড়ি দিয়ে করতে হয়, দাঁড়ানো যায় না। তবুও খারাপ না, জানালার পাশে বসে স্বচ্ছ পানি আরও কাছ থেকে দেখা যায়। আর নৌকার দোতালা মানে নৌকার ডেক, আমরা সারাদিন নৌকার ডেকেই ছিলাম। নৌকার ডেকে বসে আছি, নৌকা চলছে, যেদিকে দৃষ্টি মেলা যায় শুধু পানি আর পানি! ধু ধু প্রান্তর মরুভূমির মত, থৈ থৈ প্রান্তর জলরাশি! যেহেতু হাওর নদীর থেকে ছোট তাই ভেবেছিলাম কিছুদূর নৌকা যাবার পর হয়ত পথ শেষ হয়ে যাবে আমরা তীরে এসে তরী বেঁধে বসে থাকব আগামী তিনদিন।
তাই হল, খানিকবাদে নৌকা একটা চরের কাছে ভিড়ল, সেখানে ছেলেরা গোসল করল আর মেয়েরা শুধু পা ভিজিয়ে ছবি তুলে নিজেদের সান্ত্বনা দিল। তবুও কম কিসে! এই স্বচ্ছ নীলাভ জলে পা ভিজানোও কি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার! দুপুরের ভোজনকার্য শেষে আমাকে অবাক করে নৌকা আবার চলা শুরু করল। তখন মাথার উপর সূর্য। হাওরের ঠিক মাঝে সূর্যের তেজী আলো পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে, এই তপ্ত রোদেও পুড়ে যাওয়ার ভয়কে উপেক্ষা করে আমরা মানে আমি, মীম, পূর্ণিমা, কানিজ, ইন্দ্রাণী নৌকার গুলয়ের উপর বসে পা ডুবিয়ে গান গাইছি গলা ছেড়ে। সুরের খেয়াল নেই কারোরই!
নদীর স্বচ্ছ জলের দিকে তাকালে পানির ভেতরের গাছ গুলোও দেখা যায়। আস্তে আস্তে মেঘালয় কাছে আসতে থাকে, পরিষ্কার হতে থাকে আবছা ভাব। চারপাশে মেঘালয় আর হাওরের পানি, সেই পানির মধ্যেও এত ভিন্নতা!! কখনো ‘লাইফ অফ পাই’ মুভিতে দেখা পানির রঙের মত রঙ, কখনো সেই রঙ কিছুটা গাঢ়, কিছুটা হালকা খানিক বাদে ঘোলা পানি! একনজরে পানির দিকে তাকালে মনে হয় ছোট কোন বাচ্চা যেন ইচ্ছেমত রঙ ঢেলে দিয়েছে ড্রয়িং খাতায় আঁকা নদীর এখানে সেখানে!
মাঝে মাঝেই গাছ, সেই গাছ মাটিতে থাকা সাধারণ গাছ না। আকারে ছোট কিন্তু ডালপালা বেশ ছড়ানো। যখন পানির মাঝে গাছ ছিল আর নৌকা সেই পানির মাঝ দিয়ে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল সুন্দরবন এসেছি, একটু পরেই হয়ত হরিণ দেখতে পাব, কিন্তু না গাছের পিছন থেকে হরিণ না উঁকি দিচ্ছিল ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। আর সেই ছোট ডিঙি নৌকার মাঝি ছিল পাঁচ বছরের ছোট ছেলেমেয়েরা! ভাবা যায়!! আমাদের কাছে মাটি যেমন ওদের কাছে পানি তেমন তাই হয়ত এটা খুব অস্বাভাবিক কিছু না ওদের জন্য, খানিক বাদে দেখতে পেলাম বিলবোর্ড যেখানে লেখা টাংগুয়ার হাওর! আহা! এই সে হাওর! যার নাম ধাম ঠিকানা সেই ছোটবেলা থেকে মুখস্থ করে আসছি! টাংগুয়ার হাওরে নৌকা ঢুকার পর দেখতে পেলাম এখানে সেই গাছ আরও বেশী পরিমাণে, নৌকার পিচ্চি ছেলে সালামিনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এটা হিজল বন। দৃশ্যটা রিভিউ করে তবে বলি, আমরা নৌকার গুলয়ে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছি, চারপাশে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে, হিজল বন, পাহাড় এখন খুব কাছে চলে এসেছে, মধ্য দুপুর শেষে এখন পড়ন্ত বিকেল, সূর্যের তেজীভাব কমে তা খানিকটা মায়াবী লালচেভাব ধারণ করেছে, সেই মায়াবী আলো পানিতে পড়েছে এবং সেই আলো ঢেউয়ে ক্ষণে ক্ষণে ভাঙছে।
এবার নৌকা থামল পাঁচতলা একটা টাওয়ারের পাশে। স্যার সময় বেঁধে দিলেন দশমিনিট। তড়িঘড়ি করে টাওয়ারে উঠলাম, পাঁচতলা টাওয়ার থেকে আমি হাওর দেখছি, চোখ যে ঝলসে যায়নি এই সৌন্দর্য দেখার পরও এটাই কি বেশি না!! যেহেতু পড়ন্ত বিকেল তাই সূর্য একপাশে, সেপাশ থেকে লালচে হলুদ আলো হিজল বনের গাছের ফাঁকে গিয়ে পড়ছে, আর বনের ফাঁকে ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের ডিঙি নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মেঘালয় এখন স্পষ্ট আমাদের কাছে, চারদিকে থৈ থৈ প্রান্তর জুড়ে পানি আর পানির মাঝে এই টাওয়ারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছি আমি!

আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন এই ছোট নৌকায় উঠেছিল, আমাদের নৌকা ছেড়ে দিবে কিন্তু তখনো তাদের নৌকা তীরে পৌঁছায়নি! দুটো নৌকার চারজন কোনরকমে পৌঁছে গেলেও, সারা আর মেহেদীর নৌকা একটু দুরেই ছিল, ঘাবড়ে গিয়ে ওরা যখন একটু নড়াচড়া করছিল তখন নৌকায় পানি ওঠে নৌকা ডুবে যায়। আমরা নৌকার গুলয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সারা ডুবে যাচ্ছে কিন্তু কিছু করতে পারছি না, ঘাবড়ে গিয়ে মেহেদীও যেন সাঁতার ভুলে গেছে! ওদের নৌকা তখন আমাদের নৌকা থেকে দেড় হাত দূরে, আমাদের নৌকার পিচ্চি ছেলে সালামিন কিছু না ভেবেই নেমে পড়ল পানিতে সাথে পিচ্চি ডিঙি নৌকার পিচ্চি ছেলেমেয়েগুলিও। সবাই মিলে তখন ওদের দুজনকে নৌকায় উঠালো। তখন বুঝতে পারলাম আমরা আসলে সবই থিওরি হিসেবে পারি, থিওরির বাস্তব প্রয়োগ বাস্তব জীবনে প্রয়োজনের তাগিদে পারিনা!
যাইহোক, পরিবেশটা থমথমে, সবাই ডুবে যাওয়া নিয়ে আলোচনা করছে, নৌকা চলছে আবারও। বসে আছি আগের প্রিয় জায়গাতেই, পাশে আছে মীম আর পূর্ণিমা, প্রিয় দুজন মানুষ।
এখন পড়ন্ত বিকেল শেষে সূর্য ডুবিডুবি অবস্থা। ছোটবেলায় আকাশের নিচে রেখা দিয়ে সূর্যের আলো আঁকতাম, সূর্যের বর্তমান অবস্থা এখন সেরকমই! নৌকা চলছে, দূরে গাছের নিচে সূর্য যেন ঢলে পড়েছে! সত্যি!! দেখে মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে নিচে নেমে আসতে হাঁপিয়ে উঠে সূর্যও যেন কৃষকদের মত গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছে!
প্রথমদিন শেষ।
হাওরের মাঝে রাতের শুরু! আমরা যখন তাহিরপুর উপজেলার টাকেরঘাটে পৌঁছাই তখন সূর্য ঘুমোচ্ছে, আকাশ ভরা তারার মেলা। এমন আকাশ দেখেই হয়ত গীতিকার লিখেছিলেন,
“আকাশ ভরা তারার আলোয় তোমায় দেখে দেখে, ভালোবাসার পাখি মেলে মন ভোলানো পাখা’
টাকের ঘাট মানে আমরা এখন মেঘালয় পাহাড়ের সর্বোচ্চ নিকটে, সারাদিন ব্যাপী দূর হতে দেখতে থাকা সেই পাহাড়ের গায়ের রাস্তা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এখন। আর বর্ডারের সারা এলাকা জুড়ে নিয়ন আলো জ্বলছে, কি যে সুন্দর লাগছে সব মিলিয়ে!!
টাকের ঘাট বাজারে আমরা রাত নয়টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে নৌকায় ফিরি। রাতে খাওয়া শেষে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বার প্রস্তুতি নেয় তখন আমি নৌকার নিচতলায় পেছনের দরজায় বসে থাকি। আর সবসময়ের মত আমাকে সঙ দিয়েছে মধু।

নৌকা হাওরের মাঝে দুলছে,পাশে মেঘালয়ের বর্ডারের নিয়ন আলো জ্বলছে,আকাশ ভরা তারা আর মস্ত বড় একটা চাঁদ আকাশে দুলছে, পাশেই আমাদের বাকি পাঁচটা নৌকাও ভাসছে! এসব দৃশ্য আমি এর আগে কেবল ওয়ালপেপারের ছবিতে আর মুভিতেই দেখেছি। পা ঝুলিয়ে নৌকার পেছনে বসে আমি আর মধু গান গাইছি, নোঙর ফেলে নৌকা থামিয়ে রাখা হয়েছে তবুও পানির আছড়ে পড়া ঢেউ নৌকায় লেগে নৌকা দুলছিল। পাশেই ছেলেদের একটা নৌকা, সে নৌকার ডেকে বসে ওরা গলা ছেড়ে গান গাইছে, কিছুক্ষণ ওদের সাথে আমরাও (আমি আর মধু) গলা মেলালাম, যেহেতু মধু আমার মত নিশাচর নয় তাই খানিকবাদেই ও ঘুমুতে চলে গেল। আমি বসে রইলাম একলা আরও কিছুক্ষণ! বর্ডারের নিয়ন আলো যেন আমাকে তাদের কাছে ডাকছে। আরও কিছুক্ষণ এরকম বসে দেখার পর আমি ভেতরে গেলাম শুতে, শোয়ার যা ব্যবস্থা তা কমলাপুর রেল স্টেশনের চেয়ে কোন অংশে ভালো না! গাদাগাদি করে সবাই ঘুমচ্ছে, পঞ্চ ইন্দ্রিয় আমাদের কেমন অসহায় করে রাখে সব সময়, এত সুন্দরও যেন আমাদের ভুলে থাকতে দেয়নি ক্লান্তিকে! সবাই ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় থেকে ঘুমোচ্ছে, আমাদের একজনের আবার জ্বর এসেছে, ওর নাম ছোঁয়া। আমি ওর মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে উল্টো দিকে শুয়ে আছি, উল্টো করে হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলোচ্ছি, হাত বুলতে বুলোতে মাঝে আমারও যেন তন্দ্রার মত এসেছিল, ওর জ্বরের কষ্টের আওয়াজে আবার যখন চোখ খুলে জেগে ওঠি তখন দৃষ্টি, মৌসুমি, হাসু ওরাও জেগেছে।! দৃষ্টিকে বললাম গামছা ভিজিয়ে দেবার জন্য, গামছা ভেজাবার জন্য ও যখন জানালা খুলল,ওর চিৎকারে তখন প্রায় সবার ঘুম ভাঙল, বাইরের দৃশ্যটা সত্যিই এতো বেশী সুন্দর ছিল যে ওর উল্লাস প্রকাশের ঐ চিৎকারটুকুও যেন কম মনে হয়, ছোঁয়ার মাথায় জলপট্টি দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সবাই ডেকে গেলাম, আমি গেলাম একটু দেরিতে, ছোঁয়াকে রেখে যেতেও খারাপ লাগছিল, এই এত সুন্দর দৃশ্য ও দেখতে পারবে না ভেবে। আমি যখন ডেকে গেলাম তখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। সূর্যের লালচে আলো পানিতে পড়েছে, রাতের নিয়ন বাতিতে জ্বলতে থাকা মেঘালয় এখন দিনের আলোয় দেখছি, পাহাড়ের প্রতিটা চূড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! নদীতে ভেসে বেড়ানো ছোট নৌকাগুলোর কালো ছায়া পানিতে পড়েছে, সবাই একসাথে দাড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখছি, আকাশ এখন আরও পরিষ্কার, সবাই নেমে যাব ডেক থেকে, এমন সময় সবাইকে অবাক করে আকাশের ঐ লালচে কিনারা থেকে সূর্য উঁকি দিতে থাকল! আমরা আবার থামলাম! বিশ্বাস করুন, ঠিক যেখানে আকাশ আর পানি মিশে একাকার সেখান থেকে, আকাশের লালচে আভার সেই জায়গা থেকে সূর্য উঁকি দিতে লাগল এমনভাবে যেন সূর্য কোন মেয়ে, যে স্নান করতে পানিতে নেমেছিল, ডুব দিয়ে উঠছে, তার আসন যেন সেই আকাশের কিনারায়! এভাবেই শুরু হাওরের দ্বিতীয় দিন সকাল!
নৌকার নোঙর তুলে নৌকা পাড়ে ভিড়ানো হল! সবাই ফ্রেশ হবার জন্য সামনেই একটা গেস্ট হাউজে গেলাম, সেখানে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম, যখন টাকেরঘাট থেকে সামনে গেস্ট হাউজের জন্য রওনা হচ্ছিলাম তখন হাতের ডানে পাহাড় যেন মাথা উঁচু করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল, বাম পাশে থৈ থৈ পানি আর সে পানিতে ভেসে বেড়ানো নৌকা!
নিজেকে আধিবাসী চা শ্রমিকদের মতো লাগছিল, মনে হচ্ছিল কাঁধে ব্যাগের জায়গায় চা পাতা তুলে রাখা মাচাগুলো থাকলে বেশি মানাতো!

যাই হোক, ফ্রেশ হয়ে যখন টাকেরঘাটে নৌকার কাছে ফিরি, তখন হুমায়ূন কবির স্যার ও হুদা স্যার বললেন চল আমরা ঝর্না দেখে আসি! ঝর্না দেখতে পাব এই উল্লাসে জুতা না পাল্টে জীর্ণ জুতা পড়ে চলে আসি, কিছুদূর হাঁটার পর আমরা এমন একটা জায়গায় আসি যেখানে চারিধার জুড়ে কেবল আমাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য মেঘালয় পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্যারের অনুমতির অপেক্ষা করছিলাম, স্যারের অনুমতি পাওয়ামাত্র উঠতে লাগলাম গতকাল সকাল থেকে দূর হতে দেখতে থাকা মেঘালয়ের বর্ডারে, যা আজকে শুধু আমার কাছে পরিষ্কার নয় বরং আজ এর পাদদেশ আমি ছুঁয়েও দেখতে পাব। এটা মেঘালয়ের পাহাড় কিনা জানিনা, তবে পাশাপাশি দুটো পাহাড়ে যার একটাতে ওঠার অনুমতি নেই, রেসট্রিক্টেড এরিয়া, স্যার একজন গার্ডকে আমাদের সাথে দিয়েছেন যার ইন্সট্রাকশনেই আমরা পাহাড়টা ঘুরেছি। তিনি বলেছিলেন যে আমরা ইন্ডিয়ার মেঘালয়েই আছি, উনি আমাদের ঘুরাবার জন্য পারমিশন নিয়ে এসেছেন!
মূল ঘটনায় ফিরে আসি! আমি আপাতত ৪০ ফুট উপরে (আনুমানিক, বেশীও হতে পারে, কমও হতে পারে) পাহাড়ের পাদদেশে আছি, আমার ডানে ভারত, মেঘালয়ের ভারতীয় সীমানার পাহাড়, আমি এতটা কাছে যে পাহাড়ের গায়ের রাস্তায় যে ঘরগুলো সেগুলোও দেখা যাচ্ছে। আর হাতের বামে হাওরের পানি! কি স্বচ্ছ, কি স্থির! বামে হাইট ফোবিয়াকে দূরে ঢেলে একটু নিচে তাকালেই দেখা যায় পাহাড়ের নিচ থেকে ঝর্নার পানি চলে যাচ্ছে, সেই পানিই এখানকার মানুষের পানির প্রয়োজন মেটায়।
আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছি, একসাথে পাহাড়, হাওর আর ঝর্নার সাথে মিশে থাকা বাতাস যদি আর নিতে না পারি? সবাই ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত ভীষণ। আমি পুরো জায়গাটা ভিডিও করে নিয়েছি মুঠোফোনে, দ্বিতীয়বার যে এই জায়গায় আর আসা হবে না, তা নিশ্চিত।
খুব অল্প সময় পেয়েছি আমরা এই পাহাড়ে থাকার জন্য, গার্ড মামা তড়িঘড়ি শুরু করে দিলেন নেমে যাবার জন্য! প্রখর রোদের ঝলকানি পানির তেষ্টা কিংবা সেলফি তোলা শেষ, সবাই বিনা প্রতিবাদে একে একে নেমে গেল। আহা! নেমে গেলে আর ওঠা হবে না! থাক, তবুও আমার স্পর্শ তো পেল এই পাহাড়!
পাহাড় থেকে নেমে ঝর্নার পানিতে পা ভেজালাম আমরা! পাহাড়ের নিচের গা ভেসে কোথা থেকে এই পানি আসছে তার উৎসের দেখা নেই কিন্তু তবু বিরামহীন ভাবে একমুখী বিক্রিয়ার মত জলের ধারা সামনের দিকে বহমান। যেমন দল বেঁধে এসেছিলাম তেমনি দল বেঁধে চলে গেলাম আবার নৌকাতেই! সবাই নৌকার ডেকেই বসে আছি, আসার অল্প কিছুক্ষণ বাদেই নৌকা আবার নোঙর তুলে ভেসে বেড়ানো শুরু করল!

সবাই সেলফি তুলছে, গান গাইছে! আমি নৌকার সামনের পাটাতনে পানিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছি, প্রথম দিকে কেউই ছিলনা আমার সাথে পরে, বিল্লাল, রাহাত, কাঁকন আসে! আমি আর বিল্লাল সেদিন অনেক গল্প করলাম, গত তিন বছরে হয়ত এত কথা বলিনি সেদিন ১ ঘণ্টায় যত কথা বলেছিলাম, নৌকা যখন হাওরে ভাসছিল তখন একপাশে গ্রাম, সেই গ্রামে মানুষগুলোর জীবন নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। এখানকার মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস নৌকা, এই অথৈ জলেও ছয়-সাত বছরের ছেলে মেয়েরা ডিঙি নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কতো সহজে, আর হাওরের মানুষের পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, স্যানিটেশন, এসব ধারনা নেই বললেই চলে। জনসংখ্যার হার এখানে অনেক বেশী তা ছোট ছেলে মেয়ে গুলোকে দেখলেই বোঝা যায়, তাদের জীর্ণ বস্ত্র আর পিঠাপিঠি বয়স দেখেই বোঝা যায়, এক কাপড়েই দুই সন্তানের কাপড়ের চাহিদা মিটিয়েছে বাবা মা, তাইতো একজন হাঁটা শিখতে না শিখতেই অন্যজন হামাগুড়ি দেয়া শিখে নিয়েছে। এই দৃশ্য আমাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মা নদীর মাঝি” মনে করিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, নৌকা অনেক দূর চলার পর আর পা ডুবিয়ে বসে থাকা যাচ্ছিল না কেননা অনেক অনেক বালুবাহী নৌকা আসা যাওয়া করছিল। তাই আমরা ডেকে পা ঝুলিয়ে বসলাম! পাশাপাশি হাজারখানেক এর মত বালুবাহী নৌকা যেসব নৌকার মাঝিরা নৌকা চলমান অবস্থাতেই পানি তুলে গোসল করছিল। শুধু ভাবছিলাম আচ্ছা, এই জলের সাথে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোকে যদি ঢাকা শহরে নিয়ে আসা হয় ওরা কি বাঁচতে পারবে প্রাণ ভরে?
নৌকা গোনার মিছে চেষ্টা আর করলাম না। সবাই বসে আছি দৃষ্টি সামনের দিকে দিয়ে, পাহাড় আমাদের থেকে এখন খানিকটা দূরে, কিন্তু সামনেও একটা পাহাড় আছে। পাশাপাশি দুটো পাহাড় কোনাকুনিভাবে তার মাঝে সাহারা মরুভূমির মত বালু আর বালু সেই বালুর মাঝেও আছে পানি, এই পানির রং আমি আমার অঙ্কন বিদ্যার কোন রং দিয়েও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হব না, তবুও নীলাভ সবুজ কিন্তু নীলচে ভাব বেশিই বলা যায়।
যাই হোক, তখনও জানিনা, কোথায় এসেছি, কেননা ব্যানারে তখনও লেখা তাহিরপুর উপজেলা।
পাহাড়ে উঠবো এই আনন্দেই অস্থির। এই পাহাড়ের উচ্চতা আগেরটার তুলনায় খানিক বেশী হবে যদি আমি ভুল অনুমান না করে থাকি তবে।
পাহাড়ে উঠার কষ্টটাও এখানে এসেই বুঝেছি, পাহাড়ের পথেই প্রথম সাইনবোর্ড খেয়াল করলাম, যাদুকাঁটা নদী!
তখন একটু থেমে গেলাম হাতের বাঁ পাশে তাকালাম, পাহাড় থেকে নদী দেখছি, হাজার খানেক নৌকা, পাহাড় থেকে দেখে নৌকা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু তাদের কাজের গতি দেখে এটাই বোঝা যায় যে ঘরে ফেরার তাড়া ব্যাপারটা সব শ্রেণীর সব বয়সের মানুষের মধ্যেই আছে।
যাই হোক, হুমায়ূন কবির স্যারের ডিরেকশনে চলছিলাম, স্যারের হাসির শব্দে দৃষ্টি আবার সামনের দিকে ফিরল। আরও অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পর খুঁজে পেলাম পাহাড়ের চূড়া, সেখানে যাবার পর আবার চারদিকটা দেখে নিলাম, পাশে যাদুকাঁটা নদী, তার পাশেই আরো একটা পাহাড়! নদী আর পাহাড় পাশাপাশি এতো সুন্দর তা আগে কখনো কল্পনাতেও আনতে পারিনি!
নামের সার্থকতা আছে বলতে হবে, সত্যিই যাদুর মত, স্বপ্নের মত সুন্দর। হঠাৎ দেখি একটা জায়গায় ছেলেমেয়ের জটল্লা যেন একটু বেশীই! ভেবেছিলাম হয়ত সবাই ছবি তুলছে বলে! কিন্তু কাছে যাবার পর রহস্য তার মোড়ক উন্মোচন করল।
পিলার নাম্বার ১২০৩। যার এক পাশে লেখা বাংলাদেশ, অন্যপাশে ভারত।
আমার দুই পা দুই দেশে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! চোখ বুলিয়ে মনের ভেতর চারদিকটা আবার এঁকে নিলাম। সামনে পাহাড়, নিচে বালু, বালুর পাশেই নীলাভ সবুজ রঙের পানি যা রোদের হলুদ আলোতে জ্বলজ্বল করছে নীলকান্তমণি পাথরের মত। আরেক পাশে বালুবাহী নৌকা, যাদের বালু যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফেরার ব্যাপক তাগাদা।
কিছুক্ষণ পর আমরা নেমে আসলাম পাহাড় থেকে। তারপর দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হল, আজকের মেন্যুতে ছিল হাওরের বোয়াল মাছ। পেট পূজা শেষে যখন ফিরবার জন্য রওনা দিব তখন সূর্য মধ্যগগণ থেকে খানিক নিচে নেমেছে, তার তীব্রতা, তীক্ষ্ণতাও যেন একটু কমেছে, সারাদিন বাড়ি পাহারা দেবার পর, দুপুরে খেয়ে বাড়ির পাহারাদারের যেমন একটু ঝিমুনি আসে, সূর্যও যেন এখন একটু ঝিমিয়ে গেছে। তার তীক্ষ্ণ হলুদাভ আলোতে যেন স্তিমিত কমলা ভাব চলে এসেছে।
তখনো আমরা খালি পায়ে বালুতে হাঁটছি, বালুতে সূর্যের স্তিমিত আলোর উজ্জ্বল ভাব বালুর উজ্জ্বলতা হাজার গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে! যেমনভাবে চোখের কাজল একটা মেয়ের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে দেয়। সবাই ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত, স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টায়। পাহাড় নদী আমাকে মোহিত করছে না আর! করছে সূর্য, সে আবার রূপ বদলেছে । এখন সে আকাশের শেষ ভাগে চলে এসেছে। রক্তিম বর্ণ, সাথে পাহাড়ে সবুজ মিশে প্রান্তভাগে একটু কালচে ভাব! পুরো এলাকা জুড়ে সে এই আলোর শিখা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সবাইকে বিদায় জানাচ্ছে।
যেন বলছে তার চলে যাবার সময় হয়েছে, সবাই যেন দোকান গুছিয়ে নেয়। সত্যি বোধহয় সবাই সূর্যের এই সংকেত বুঝেছিল। তাইতো সবাই দোকান গুছিয়ে নিচ্ছিল। স্যার আমাদের সকলকে নৌকায় উঠতে বললেন। কিছুক্ষণ বাদেই নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকা ছাড়ার পর বুঝলাম সত্যি সবাই তৈরি দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরবার জন্য। কেননা, হাজার খানেক নৌকাগুলো সকালের চেয়েও তীব্র বেগে যেন ছুটছে, যেন সূর্য রাগ করে পরদিন সকালে আর উঠবে না একটু দেরি করলেই। পানিতে নৌকার ধাক্কায় পানির ঢেউ গুলো যেন ফুলে উঠছে, ঢেউরা আবার ঢেউদের সাথে ধাক্কা খেয়ে নৌকায় ফেরত পাঠাচ্ছে, তাই সকালেও যেখানে দিব্বি দাড়িয়ে ছিলাম সেখানেই এখন বসেও ভয় লাগছিল নৌকার দুলুনির জন্য।

সূর্য নদীর সাথে মিশে গিয়ে যেন অন্য একজনকে সুযোগ করে দিল আকাশে। সূর্য’র জায়গায় চলে আসল চাঁদ আর আকাশ ভরা তারা। আমরা মোটামুটি সবাই ডেকের ছাদে বসে আছি যদিও অনেক ঠাণ্ডা। সেই ঠাণ্ডা গায়ে মেখে আকাশ ভরা তারার নিচে বসে গলা ছেড়ে গান গাইছি। সাদিকা ম্যামও আমাদের সাথে গলা মিলিয়েছেন।
ঘণ্টা দুই এক নৌকা চলার পর একটা ঘাটে এসে থামানো হয়, সেখানের বাজারের চায়ের দোকানে বসে আমরা চা খাই, তারপর সবাই মিলে বাজারের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াই।
তখন হয়ত রাত নটা! আমরা বাজার থেকে বের হয়ে নৌকায় উঠি, নৌকা আবার চলতে শুরু করে, এখন ডেকে না, নৌকার ভেতরে বসি যেহেতু ইঞ্জিনের শব্দে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে পারব না তাই জানালার পাশে বসে নদী, আকাশ আর আকাশের সম্রাজ্ঞীদের দেখতে থাকলাম। চাঁদের ছায়া পানিতে পড়েছে, যেন পানি এখানে আয়না, আয়নায় চাঁদ তার মুখ দেখছে।
এমনভাবে আরও কিছুক্ষণ নৌকা চলার পর আবার একটা ঘাটে থামলো, সেখানে আমরা রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম, তারপর নৌকাচালকদের বিশ্রামের জন্য নৌকা ঘন্টাখানেক থামানো হল। প্রথম দিন রাতের মত শেষ দিন রাতেও আমরা নৌকার পেছনের দিকে বসে রইলাম পা ঝুলিয়ে, আজ রাতে আমার সঙ্গী বাবু মীম, দুজনে মিলে গল্প করছি, সময় ফুরিয়ে যাবার গল্প, সময়ের নিষ্ঠুরতার গল্প। গল্প করতে করতেই হঠাৎ করে একটা তারা খসে পড়ল, যেন তারারা লুকোচুরি খেলছে। তখন আমাদের মনোযোগ গল্প থেকে সরে আকাশের দিকে চলে গেল যেন আরও কিছু তারা খসে পড়তে দেখতে পারি। তারা’র অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমাদের চলে যাবার সময় চলে এলো যেন। তখন রাত দুইটা বাজে, অন্য সব নৌকার মাঝিরা ঘুম থেকে উঠে গেছে কিন্তু আমাদের মাঝি তখনও ঘুমোচ্ছে।
তাকে ঘুম থেকে উঠাবার দায়ে সে যথেষ্ট বিরক্ত প্রকাশ করল, তার ভাষ্যমতে, রাত চারটায় রওনা হলেও ছয়টার মাঝে তাহিরপুর পৌঁছাতে পারব। তবুও স্যারের ধমকে উনার ঘুম বুঝি পুরোপুরি কেটে গেল। আমাদের নৌকাও চলতে শুরু করল। তখনও আমি আর মীম নৌকার পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। প্রথম দিন রাতে যখন আমরা এখানে বসে ছিলাম তখন নৌকা থেমে ছিল, আর আজ নৌকা চলন্ত অবস্থায় আমরা বসে আছি এখানে। কিছুটা ভয় কাজ করছে, যদি পরে যাই এই পানিতে তখন এই সৌন্দর্যই অসুন্দরের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই,আমি আর মীম ভেতরে চলে গেলাম, মীম শুয়ে পড়ল কিন্তু আমি তখন আরও একবার জানালা খুলে আয়নায় চাঁদকে দেখলাম। আহা! এই সৌন্দর্যের কাছাকাছি আজই শেষ দিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমিও শুয়ে পড়লাম। তখন বাজে রাত তিনটে। ঘুম ভাঙলো সবার ডাকাডাকিতে ভোর পাঁচটায়।
শেষদিন সকাল। সময় সত্যি মানুষকে খুব নিষ্ঠুর করে দেয়, আজ আর কারও মনোযোগ সকাল দেখা নিয়ে না, সবাই যে যার মত ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে, হারিয়ে ফেলেছে এমন জিনিস খুঁজছে কারো কাছে চলে গেছে কিনা।
আজ আর কারও মন নেই সূর্য উঠার দৃশ্য দেখা নিয়ে সবাই ইঞ্জিনের মত চলছে, কখন বাড়ি ফিরবে এই এখন সবার চিন্তা। সকাল ৬:৩০ টা নাগাদ আমরা ধর্মপাশায় এসে পৌঁছাই। সেখান থেকে লেগুনা করে স্টেশনে ফেরা, যখন ফিরে যাচ্ছি আবার রাস্তার দুপাশে সেই থৈ থৈ হাজার শেডের নীলচে রঙ, এই হাওর, এই মেঘালয় পাহাড় সব দুরে চলে যাচ্ছে, আবছা হয়ে যাচ্ছে পাহাড়, নদী, সূর্য। যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, প্রকৃতিকে পেছনে ফেলে। যত ঝাপসা হচ্ছে মেঘালয় পাহাড়, স্মৃতি যেন ততই প্রখর হচ্ছে।