কয়েকদিন যাবত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে নিয়ে ইতিবৃত্তের জন্য একটা আর্টিকেল লিখবো বলে ভাবছিলাম। এটা ওটা করতে করতেই আর সময় বের করতে পারছিলাম না।
প্রতিদিনের মতই গতকাল সকাল ১০টার দিকে টিভিটা অন করে খবর দেখতে বসলাম। সময় টিভিতে বরাবরের মত নিউজ আপডেটে চোখ বোলাচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ল, পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং আর নেই!
৭৬ বছর বয়সে তিনি আজ (১৪ মার্চ, ২০১৮) সকালে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে নিজ বাড়িতে মারা যান।
কে এই স্টিফেন হকিং? কেনই বা তিনি এতো বিখ্যাত? এবং আজ তাঁর মৃত্যুর খবর সারা পৃথিবীব্যাপী কেনই এতটা গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা হচ্ছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজতেই আজকে আমাদের এই আয়োজন-
স্টিফেন হকিং কে?
স্টিফেন হকিং একজন পদার্থ বিজ্ঞানী, একজন অধ্যাপক এবং একজন লেখক। তাঁর পুরো নাম স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্ম গ্রহণ করেন এই কিংবদন্তী বিজ্ঞানী।
বাবা ফ্রাঙ্ক হকিং এবং মা ইসাবেল হকিং এর চার সন্তানের মধ্যে স্টিফেন জ্যেষ্ঠ। স্টিফেন হকিং এর মা যখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেন তখন খুব কম সংখ্যক মেয়েরাই কলেজে যেত এবং বাবাও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন, তিনি একজন মেডিকেল রিসার্চার ছিলেন।
১৯৬৩ সালে জেনি ওয়াইল্ডের সাথে স্টিফেনের পরিচয় হয় এবং ১৯৬৫ সালে তারা বিয়ে করেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে তিন সন্তানের জনক।

১৯৯৫ সালে স্টিফেন জেনি ওয়াইল্ডের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করে তাঁর নার্স মেসনকে বিয়ে করেন। কিন্তু মেসনের প্রতি অভিযোগ উঠে তিনি স্বামী স্টিফেনকে নির্যাতন করতেন, কিন্তু স্টিফেন এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে দশ বছর সংসার করার পর তিনি মেসনের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন এবং জেনির সাথে তাঁর আবার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।
শিক্ষাজীবন
বাল্যকাল থেকেই স্টিফেনের বিজ্ঞান এবং গণিতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুর দিকে তিনি খুব একটা ভালো ছাত্র ছিলেন না। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল অব্দি তিনি ‘সেন্ট এলবার’ স্কুলে পড়েন, এটি ছিল একটি মেয়েদের স্কুল। এরপর তিনি ছেলেদের স্কুলে ভর্তি হন। তিনি বোর্ড গেম খেলতে পছন্দ করতেন এবং কয়েকজন বন্ধু মিলে নিজেদের জন্য একটা গেমও তৈরি করেছিলেন।
বাবার ইচ্ছে ছিল স্টিফেন যেন তাঁর মত একজন ডাক্তার হন। কিন্তু স্টিফেনের যেহেতু বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বেশি ছিল তাই তিনি ১৭ বছর বয়সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিশেষ করে মহাজাগতিক তথ্য নিয়ে পড়তে শুরু করেন। যদিও তিনি প্রথমে গণিত নিয়ে পড়তে চেয়ে ছিলেন, কিন্তু তখন অক্সফোর্ড এ গণিত পড়ানো হত না বলে তা পড়তে পারেন নি।

১৯৬২ সালে তিনি ন্যাচারাল সাইন্সের উপর অনার্স পাস করেন এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি হলে কসমোলজিতে পিএইচডি করতে যোগ দেন।
১৯৬৮ সালে কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব এস্ট্রোনমি এর সদস্য হন। এবং পরবর্তী কিছু বছর তিনি তাঁর রিসার্চে সময় দেন এবং ১৯৭৩ সালে তিনি তাঁর প্রথম
বই ‘দা লার্জ স্ট্রাকচার অব স্পেস টাইম’ জি এফ আর এলিস কে সাথে নিয়ে প্রকাশ করেন।
এবার তাঁর গবেষণা এবং আবিষ্কার নিয়ে কিছু কথা বলা যাক,
১৯৭০ সাল, স্টিফেন এবং রজার পেনজোর প্রথম ব্ল্যাক হোল এ গাণিতিক সূত্র প্রয়োগ করেন এবং আপেক্ষিক তথ্যের একটি নতুন ধারণা দেন। এবং এর মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে শুরু করে। স্টিফেন হকিং তাঁর বিকিরণ তত্ব প্রকাশ করার সাথে সাথে এটি একটি উত্তেজনার সৃষ্টি করে।
৩২ বছর বয়সে স্টিফেন রয়েল সোসাইটির একজন ফেলো হন এবং আইনস্টাইন পুরষ্কার লাভ করেন।
১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিং ‘এ ব্রিফ হিষ্ট্রি অব টাইম’ বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত হয়ে উঠেন। এই বইটিতে মহাজাগতিক তথ্য, সময় ও স্থান এবং ভবিষ্যতের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিবরণ প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে বইটি বেস্ট সেলার হিসেবে এক কোটি কপি বিক্রি হয়। লন্ডন সানডে টাইমসের সেরা বিক্রয়ের তালিকায় চার বছরেরও বেশি সময় ধরে শীর্ষে ছিল বইটি এবং এটি ৪০ টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

এছাড়াও তিনি ‘দা ইউনিভার্স অব নাটসেল’, ‘এ ব্রিফার হিষ্ট্রি অব টাইম’ এবং ‘দা গ্রান্ড ডিজাইন’ নামে আরও তিনটি বই যথাক্রমে ২০০১, ২০০৫ এবং ২০১০ সালে প্রকাশ করেন। মেয়ে লুসিকে নিয়েও ছোটদের জন্য ‘জর্জ’স সিক্রেট কি টু দা ইউনিভার্স’ নামে একটা বই লেখেন।
২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এই পদে আইজ্যাক নিউটন, চার্লস ব্যাবেজও ছিলেন।
২০১৫ সালে সুইডেনে একটি কনফারেন্সে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে নতুন একটি থিওরি এবং ‘ইনফরমেশন প্যারাডক্স’ নিয়ে অলোচনা করতে উপস্থিত হন। একটি বস্তুকে ব্ল্যাক হোলে প্রবেশ করালে কি হতে পারে এ সম্পর্কে তিনি বলেন, পদার্থের ইনফরমেশন প্যারাডক্স ‘ইভেন্ট হরিজন’ নামে পরিচিত বস্তুর আউটার বাউন্ডারিতে অবস্থিত একটি দ্বিমাত্রিক ফরমে সংরক্ষিত থাকে এবং ব্ল্যাক হোলে চিরন্তন বলে কিছু থাকে না যা তারা আগে ভেবেছিল। বরং ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হয় কণার প্রবাহ।
স্টিফেনের দুরারোগ্য ব্যাধি
১৯৬৫ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে স্টিফেন হকিং দুরারোগ্য মোটর নিউরন নামক একটি ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এ কারণে তাঁর মাংসপেশি ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে শুরু করে, ডাক্তার তখন জানায়, তিনি আরা ২ বছর বাঁচবেন। কিন্তু হকিং ডাক্তারদের সেই ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণিত করেন। তখন তাঁর পড়াশুনার প্রায় শেষ, ঐ সময়ই তাঁর এই রোগটি ধরা পড়ে। তিনি তাঁর সুপারভাইজার এর সহায়তায় পিএইচডি শেষ করেন। জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় হুইল চেয়ারই ছিল তাঁর সঙ্গী।
সম্মাননা এবং পুরষ্কার
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমোলজি কেন্দ্রের সামনে ২০০৭ সালে স্টিফেন হকিং এর সম্মানার্থে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালে স্টিফেন হকিং এর জীবনীর আলোকে তৈরি হয় “থিওরি অব এভরিথিং” নামে একটি চলচ্চিত্র।

তিনি তাঁর কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হন। এগুলো হল- অ্যাডামস পুরস্কার (১৯৬৬) এডিংটন পদক (১৯৭৫) ম্যাক্সওয়েল পদক ও পুরস্কার (১৯৭৬) গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় ড্যানি হাইনম্যান পুরস্কার (১৯৭৬) হিউ পদক (১৯৭৬) আলবার্ট আইনস্টাইন পদক (১৯৭৮) রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির স্বর্ণ পদক (১৯৮৫) ডিরাক পুরস্কার (১৯৮৭) প্রিন্স অব অ্যাস্টুরিয়াস পুরস্কার (১৯৮৯) প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (২০০৯) ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স পুরস্কার (২০১২)
পরিশেষে বলা যায় যে, আইনস্টাইন পরবর্তী যুগে স্টিফেন হকিং হলেন অন্যতম পদার্থ বিজ্ঞানী। মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া এক অপরাজেয় ব্যক্তিত্ব এই বিজ্ঞানীর একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়েই শেষ করছি-
‘I’m not afraid of death, but I’m in no hurry to die. I have so much I want to do first’
সোর্স:
The guardian, BBC world, biography.com