ক্যারিবিয়ান সাগরে এবং তা ছাড়িয়ে, জলদস্যু রা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল বেঁচে থাকবে- তাদের দুঃসাহসিকতায়, ভুল কাজের খ্যাতি অথবা নৃশংসতায়। প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমুদ্রে তাদের প্রভাব বিস্তার করে গেছে, যদিও তারা সকলেই ছিল ক্ষণজন্মা। সমুদ্রে রাজত্ব করা এমনই ১০ জন বিখ্যাত জলদস্যু র তালিকা দেয়া হল।
উইলিয়াম কিড ( স্কটিশ, ১৬৪৫-১৭০১)
একজন কেতাদুরস্ত স্কটিশ লোক, নিউইয়র্কের বিশিষ্ট নাগরিক, ট্রিনিটি চার্চ এর সক্রিয় সহ-প্রতিষ্ঠাতা ক্যাপ্টেইন কিড তার পেশা জীবন শুরু করেছিলেন শত্রু-জাহাজ আক্রমণ ও লুণ্ঠনের অধিকার প্রাপ্ত বেসরকারি জাহাজে যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্র থেকে জলদস্যুদের অপসারন করা। অনেকটা অনিচ্ছকৃতভাবেই কিড জলদস্যু জীবনে প্রবেশ করেন, যদিও তার জলদস্যুতা রোমাঞ্চকর হিসেবে তুলে ধরার ফলে অনেক প্রশ্ন জাগে। কিডকে তার নাবিকদলই জলদস্যু ক্যাপ্টেইন হিসেবে নির্বাচিত করে। তার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ আক্রমণ করা। যখন তিনি জানতে পারলেন যে এই কাজের জন্যে তাকে খোঁজা হচ্ছে, তখন কিড তার কিছু সম্পদ গার্ডিনার আইল্যান্ডে লুকিয়ে ফেলে যাতে পরবর্তীতে একে দর কষাকষির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু বোস্টনে স্ত্রী সহ ধরা পরার পর বিচারের জন্যে কিডকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকের মতে, তাকে অন্যায় ভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং তা কার্যকর হয়েছিল অনেক বাজে পদ্ধতিতে। যে দড়িতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল তা দুইবার ছিঁড়ে যায়, এবং তৃতীয়বার যখন তাকে থেমস নদীর পাশে ফাঁসি দেয়া হয় তখন দড়ির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল শিকল আর পুরো শরীর আলকাতরা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল।
এডওয়ার্ড টিচ “ব্ল্যাক বিয়ার্ড”(ইংলিশ, ১৬৮০-১৭১৮)
অনেক সফল ত্রাস সৃষ্টিকারীদের জলদস্যুদের মধ্যে ব্ল্যাক বিয়ার্ড ছিল তার সময়কার সুপরিচিত এবং অন্যতম একজন। তার পরিচালনায় ছিল ৪ টি জাহাজ আর ৩০০ জনের জলদস্যু বাহিনী। বিখ্যাত যুদ্ধ জাহাজ এইচ এম এস স্কারবরো কে পরাস্ত করেছিল ব্ল্যাক বিয়ার্ডের বাহিনী। লড়ায়ে দুই হাতে দুই তলোয়ার, কয়েকটা ছুরি আর পিস্তল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরার জন্যে বিখ্যাত ব্ল্যাক বিয়ার্ড। ক্যারিবিয়ান সাগরে ৪০ টির বেশি বাণিজ্যিক জাহাজ লুণ্ঠন এবং অসংখ্য বন্দীকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছে ব্ল্যাক বিয়ার্ড ।
অনেক উপপত্নী থাকলেও মূলত ব্ল্যাক বিয়ার্ডের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছরের এক কিশোরীর সাথে – যে তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করেছিল এবং এই “অপরাধে” ব্ল্যাক বিয়ার্ড তার স্ত্রীকে উপহার হিসেবে নাবিকদের কাছে অর্পণ করে। এক ভয়ানক যুদ্ধের পর রাজার নৌবাহিনীর হাতে ব্ল্যাক বিয়ার্ড বন্দী হয় এবং পরে তার শিরচ্ছেদ করা হয়। তার কাটা মাথা ভার্জিনিয়ার হ্যাম্পটন নদীর কাছে খুঁটির মধ্যে গেঁথে রাখা হয়েছিল জলদস্যুদের সতর্কবার্তা হিসেবে।
বার্থলোমিও রবার্টস “ব্ল্যাক বার্ট” ( ওয়েলস, ১৬৮২-১৭২২)
রবার্টস এর সুনাম ছিল তার সাহসিকতার জন্যে। তাকে ডাকা হত “পিস্তল প্রুফ” হিসেবে, যদিও ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই পেশায় রবার্টস এর প্রবেশ। হুওয়েল ডেভিস নামের এক জলদস্যুর হাতে বন্দী হয়েছিলেন রবার্টস। জাহাজ দখলে নেওয়ার পর ন্যাভিগেটর হিসেবে দক্ষতা, অনন্যসাধারন প্রতিভা এবং সাহসের জন্য সকলের কাছে রবার্টস মহান হয়ে উঠেন।
৪০০ টিরও বেশি জাহাজ লুণ্ঠন করেছিলেন তিনি এবং প্রতিটি লুটের সময় অস্ত্র দ্বারা সজ্জিত জাহাজ পরিচালনা করেছিলেন। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেইন ক্যালোনার ওগলের বিরুদ্ধে জোরালো যুদ্ধে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রবার্টস এর মৃত্যু তার বিশ্বস্ত অনুসারি এবং শুভাকাঙ্খিদের সাথে রয়েল নেভিকেও স্তব্ধ করে দেয়।
হেনরি এভেরি “লং বেন” ( ইংলিশ, ১৬৫৩-অজানা )
নাবিক হিসেবে এভেরির কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে। ১৬৯৩ সালে স্প্যানিশ যুদ্ধ জাহাজে যোগদান করার আগে অনেক গুলো জাহাজে কাজ করেছিলেন তিনি। হেনরি এভেরি জলদস্যু নেতা হয়েছিলেন বিদ্রোহ করার মাধ্যমে। তাকে বলা হত লোহিত সাগরের ত্রাস।
অনেকগুলো জাহাজ লুট করার রেকর্ড না থাকলেও তিনি ভারত সাগরে বিখ্যাত দুই জাহাজ লুট করেছিলেন( যার একটির মধ্যে ভারতীয় ধন-রত্ন বোঝাই ছিল। এভেরি ছিল বিশ্বের সবথেকে ধনী জলদস্যু। প্রচুর সম্পদ গড়ার পর এভেরি অবসরে চলে যায়। তার মৃত্যু সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।
অ্যান বনি (আইরিশ, ১৭০০-১৭৮২)
পরিবারের সাথে নতুন বিশ্বে ভ্রমণের সময় অ্যান ভালবেসে জেমস বনি নামের এক কপর্দকহীন নাবিকের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু জেমস এর পৌরষ্যের অভাব অ্যানকে নিরাশ করে এবং এর ফলে ন্যাসো এর অনেক পুরুষের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে একজন “ক্যালিকো জ্যাক” র্যাকহেম, যে ছিল জলদস্যু জাহাজের ক্যাপ্টেইন। অ্যান পুরুষের ছদ্মবেশে র্যাকহেম এর নাবিকদলের সাথে যুক্ত হন। এইভাবে র্যাকহেম এর নির্দেশে অ্যান যুদ্ধ করতেন এবং মেরি রীড নামের আরেকজন নারী জলদস্যুর সাথে মিলে নাবিকদলকে সাথে নিয়ে রক্তক্ষয়ী এবং ভয়ানক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিলেন আর এ সকল কারণে তিনি দুর্দান্ত জলদস্যুতে পরিণত হয়েছিলেন।
তবে র্যাকহেমের দলের সাথে অ্যান ধরা পরেন এবং সকলের সাথে তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বন্দী থাকা অবস্থায় অ্যান এবং মেরি রীড উভয়ই দাবি করেন যে তারা গর্ভবতী এবং সেই কারণে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়না(যদিও মেরি জেলখানাতেই মারা যায়)। অ্যান এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল তা কেউ জানেনা। তবে অনেকের মতে, অ্যান তার স্বামী অথবা তার বাবার কাছে ফিরে গিয়েছিলেন।
স্যার হেনরি মরগান (ওয়েলস, ১৬৩৫-১৬৮৮)
বিখ্যাত জলদস্যুদের মধ্যে ক্যাপ্টেইন মরগান ছিলেন অন্যতম যার কারণে ১৬০০ শতাব্দীর শেষের দিকে স্পেন এর ক্যারিবিয়ান কলোনি ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। সকলের অলক্ষ্যে মরগান জ্যামাইকান নৌবহরের প্রধান হিসেবে ইংল্যান্ডের অনুমোদন লাভ করেন এবং ওয়েস্ট ইন্ডিসে স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত করে সফলতার সাথে স্প্যানিশ শাসনের পতন ঘটায়। জলদস্যু হিসেবে প্রায় ৪০০ টি জাহাজ লুট করেছেন ক্যাপ্টেইন মরগান।
তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল ৩০ টি জাহাজ, ১২০০ জন লোক সমেত সম্পদশালী পানামা শহরের লুট। এই ঘটনার জন্যেই ক্যাপ্টেইন মরগানকে বন্দী করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু স্পেন ও ইংল্যান্ড এর মধ্যকার যুদ্ধের কারণে রাজা ২য় চার্লস তাকে নাইট হিসেবে অভিষিক্ত করেন এবং জ্যামাইকার ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করে মুক্তি দেন যেখানে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্মানের সাথে জীবনযাপন করেন।
ফ্রাসোয়া ইওলনেই (ফ্রেঞ্চ, ১৬৩৫-১৬৬৮)
ফ্রাসোয়া ইওলনেই আমেরিকার এক কারখানায় চুক্তিতে কাজ করতেন এবং দারিদ্র্যের মাঝে দিনযাপন করতেন। জলদস্যুর খাতায় নাম লেখানোর পর ফ্রাসোয়া ইওলনেই খ্যাতি লাভ করেন তার বদমেজাজ এবং লুটপাটের জন্যে। যে লুঠতরাজের কারণে ফ্রাসোয়া ইওলনেই বিখ্যাত হন তা হল ভেনিজুয়েলার মারাকাইব শহরের লুট যেখানে প্রায় ২০০,০০০ স্প্যানিশ ডলার লাভ করেন তিনি। তার ধর্ষকামী ও রক্তপিপাসু বৈশিষ্ট্যের ফলে এমন কথাও ছড়িয়েছে যে, ফ্রাসোয়া ইওলনেই কোন এক যুদ্ধের সময় একজন স্প্যানিশ সৈনিকের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে খেয়েছেন।
তার নিজের মৃত্যুও ছিল ভয়াবহ। ফ্রাসোয়া ইওলনেই এবং তার নাবিকেরা পানামা উপকূলের কিছু দূরে বালুতটে তাদের জাহাজ ভিড়িয়েছিল। স্থলে খাবারের খোঁজে বের হলে স্থানীয় উপজাতিরা তাদেরকে বন্দি করে ফেলে এবং গ্রাস করে।
স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক ( ইংলিশ, ১৫৪০-১৫৯৫)
স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক তার সময়ের বিখ্যাত একজন জলদস্যু। রানি এলিজাবেথ এর নির্দেশে বেশ কয়েকবার স্প্যানিশ আর্মিদের উপর হামলা চালিয়েছেন। স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন পর্যন্ত ফ্লোরিডা উপকূলের স্প্যানিশ শহরগুলো লুট করে গেছেন। তিনি উত্তর আমেরিকাতে যাত্রা করে প্রশান্ত উপকূলে রানী এলিজাবেথের নামে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি ছিলেন প্রথম ইংরেজ যিনি সমুদ্র পথে বিশ্ব ভ্রমণ করেন। রোওয়ানক দ্বীপের ব্যর্থ ইংরেজ কলনিস্টদেরও উদ্ধার করে নিয়ে এসে নিজের জাহাজে করে ইংল্যান্ড এ ফিরিয়ে এনেছিলেন। প্রসিদ্ধ এক কর্মজীবন পার করার পর পানামা উপকূলের কাছে আমাশয়ের মত সামান্য কারণে মারা যান।
জলদস্যু – চেং পো সাই ( চাইনিজ, ১৭৮৩-১৮২২)
চেং পো সাই এর পিতা ছিলেন একজন জেলে। এক জলদস্যু দম্পতি তাকে অপহরণ করে এবং পরবর্তীতে পালিত পুত্র হিসেবে লালিত-পালিত হন। তিনি নিজেও পরে জলদস্যুতে পরিণত হন। তার বহরে ছিল কয়েকশ জাহাজ এবং অনুসারী ছিল ৫০০০০ এরও উপরে মানুষ। গুয়াংডংর উপকূলবর্তী এলাকাতে সক্রিয় ছিলেন তিনি।
তার সংগ্রহে অনেক অনেক ধন-সম্পদ ছিল যা তিনি ছোট এক গুহায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। কোনমতে চীনা সরকার তাকে ধরতে সক্ষম হয়। তবে চেং পো সাই সরকারের সাথে চুক্তি করেন এবং কুইং ইমপেরিয়াল নেভির ক্যাপ্টেন হিসেবে মনোনীত হন। তাকে কর্নেল পদে নিয়োজিত করা হয় এবং জীবনের বাকী সময় তিনি অন্য জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধ করে ও সরকারকে সহয়তা করে কাটিয়েছেন।
জলদস্যু – চিং শিহ্ ( চাইনিজ, ১৭৮৫-১৮৪৪)
চিং শিহ্, যার আরেক নাম চেং ই সাও, ছিলেন চীনের কুখ্যাত নারী জলদস্যু যিনি তার দস্যু জীবনে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। চেং এর স্বামী ছিলেন জলদস্যু এবং তার মৃত্যুর পর স্বামীর সকল কাজের দায়িত্ব গ্রহন করেন তিনি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বামীর সমকক্ষ হয়ে উঠেন তিনি। চেং তার স্বামীর ডান হাত, তার পালিত পুত্র, চেং পো সাই কে নিজ নৌবহরের ক্যাপ্টেইন হিসেবে নিযুক্ত করেন। সুন্দরী ক্যাপ্টেইন সাও এর হাতে ছিল ১৫০০ এর বেশি জাহাজ এবং ৮০০০০ অনুসারী।
তিনি তার পালিত পুত্র চেং পো সাই কে বিয়ে করেছিলেন। চীনের সরকার যখন শান্তির বদলে সমস্ত জলদস্যুকে ক্ষমা দেওয়ার প্রস্তাব করে, তখন চেং তা গ্রহণ করেন। তার অনুসারীরা নিজ নিজ সম্পদ নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি পেয়েছিল এবং প্রত্যেককে সামরিক বাহিনীতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছিল। চেং তার বাকি ৬৯ টি বছর স্বামীর সাথে ক্যাসিনো আর পতিতালয় পরিচালনা করে কাটিয়ে দেন।