রহস্যে ঘেরা সভ্যতা ‘ইনকা সভ্যতা’। সেই রহস্য আরও ঘনীভূত করার উদ্দেশ্যেই যেন তৈরি করা হয়েছিল মাচু পিচু। আর রহস্যময় এই মাচু পিচু নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
মাচু পিচু কি?
দিনটি ছিল ১৯১১ সালের ২৪ জুলাই। হিরাম বিংহাম, একজন আমেরিকান অভিযাত্রী, মাচু পিচুতে উপস্থিত হন তখন এক স্থানীয় কৃষক তাকে পাহার চূড়ার এক ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে জানায়। কৃষকটির ১১ বছর বয়সী ছেলে তাকে সেই স্থানের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যায়। ততদিনে গাছপালার কারণে ৪০০ বছর ধরে পরিত্যক্ত শহরের পাথরের কাঠামোগুলোর বেশিরভাগ অংশ ঢাকা পরে গিয়েছিল। যখন বিংহাম জায়গাটিতে যান, তখন সেখানে কয়েকটি আদিবাসী পরিবার এবং তাদের চাষের জমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যদিও মিশনারিরা প্রথম সেখানে পদার্পণ করেছিল, তবে বিংহামই প্রথম মাচু পিচুকে জনসমক্ষে আনেন তার বই ‘দ্য লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস’ এ।
মাচু পিচু কোন হারানো শহর ছিল না- স্থানীয় লোকদের কাছে কয়েকশ বছর ধরেই এই শহর পরিচিত। আর বিংহাম প্রথমত ভিলকাবাম্বা নামক শহরের খোঁজে বের হয়েছিলেন যেখানে স্প্যানিশদের আক্রমণের পর ইনকারা পালিয়ে গিয়েছিল, মাচু পিচু নয়। কিন্তু বাইরের দুনিয়ার কাছে প্রাচীন এই শহরের আবিষ্কার নতুন ছিল। তখন থেকেই মাচু পিচু, যার অর্থ “পুরনো চূড়া”, হয়ে উঠেছে ল্যাটিন আমেরিকা এবং পেরুর সবচেয়ে বিখ্যাত স্থান।
কুজকো, পেরুর ৫০ মাইল (৮০ কিমি) উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আন্দিজ পর্বতমালার কোরডিলেরা দে ভিলকাবাম্বা এলাকায় অবস্থিত প্রাচীন ইনকা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ মাচু পিচু। উরুবাম্বা নদী উপত্যকার উপরে দুইটি সুউচ্চ চূড়া- মাচু পিচু (পুরাতন চূড়া) এবং হুয়ায়না পিচু (নতুন চূড়া), যার উচ্চতা ৭,৯৭০ ফিট। ১৯৮৩ সালে মাচু পিচুকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে নির্বাচিত হয়।
মাচু পিচুর ইতিহাস
মাচু পিচু প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৪৫০-১৪৬০ এর মাঝামাঝি সময়ে। এর নির্মাণকাল নির্দেশ করে দুইজন বিখ্যাত ইনকা শাসকের শাসনামল- পাচাকুটেক ইনকা ইউপানকি (১৪৩৮-৭১) এবং টুপাক ইনকা ইউপানকি (১৪৭২-৯৩)। এই বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে ঐকমত আছে যে, পাচাকুটেক তার সফল সামরিক অভিযানের পর সম্ভবত নিজের জন্য রাজকীয় একটি এস্টেট নির্মাণের আদেশ দেন। যদিও মাচু পিচু কে রাজকীয় এস্টেট হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল, তবুও উত্তরাধিকার সূত্রে এর হাত বদল হয় নি। স্প্যানিশদের আক্রমণের কারণে পরিত্যক্ত হওয়ার আগে মাত্র ৮০ বছর পর্যন্ত এই শহর ব্যবহৃত হয়েছিল। সম্ভবত এই শহরের বেশিরভাগ মানুষ স্মল পক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যার জীবাণু ছড়ায় স্প্যানিশদের আসার আগে কিছু ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে।
১৪৪০ সালের ভিলকামবাম্বা পাচাকুটেক এর যুদ্ধের সময় প্রথম বসতি স্থাপিত হয়। এই বসতির নামকরণ করা হয়েছিল তাহুয়ানতিনসুও সাম্রাজ্য যা পরবর্তীতে মানকো ক্যাপাক সরকার গঠন করে। ধারণা করা হয়, যখন মাচু পিচুতে প্রথম বসতি স্থাপিত হয় তখন এর জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০-১০০০ জন এবং তারা ছিল সমাজের সবচেয়ে উঁচু শ্রেণী “ল্যাকটাস” এর সদস্য।
এই অঞ্চলের আশেপাশে যে উপত্যকাগুলো ছিল তা তাদের কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে সম্রাট পাচাকুটেক এর মৃত্যুর পর উপত্যকাগুলোর গুরুত্ব কমে যায় এবং ওলায়াতানতাম্বো ও ভিলকামবাম্বার মত নতুন প্রতিষ্ঠিত স্থানগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। নতুন জায়গায় নতুন নতুন দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা তৈরি হওয়ার কারণে এবং স্থাপনাগুলো তুলনামূলক সমতলে হওয়ার কারণে মাচু পিচুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন কমতে থাকে।
১৫২৭ থেকে ১৫৩২ পর্যন্ত দুই ভাই হুয়াস্কার এবং আতাহুয়াল্পা ইনকা সাম্রাজ্য কার হবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলে। তাদের বাবা, ইনকা হুয়ায়না ক্যাপাক দুই ভাইকে সাম্রাজ্য ভাগ করে দিয়েছিল- হুয়াস্কারকে কুজেকা এবং আতাহুয়াল্পাকে কিটো। ১৫২৫ এবং ১৫২৭ এর মাঝে যখন হুয়ায়না এবং তার উত্তরাধিকারী নিনান কুয়ুচি মারা যায়, তখন হুয়াস্কার এবং আতাহুয়াল্পা পুরো সাম্রাজ্যের দখল নিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলে। যে মানুষগুলো দুর্গম এলাকা থেকে মাচু পিচুতে থাকার জন্য এসেছিল, তারাও যুদ্ধের পর যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে যায়। পরবর্তীতে আরেক ভাই, মানকো ইনকাকে ভিলকামবাম্বাতে বনবাসে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং ফলস্বরূপ মাচু পিচু জনমানব শূন্য এলাকায় পরিণত হয়।
যেভাবে আবিষ্কৃত হয় মাচু পিচু
বিংহাম মাচু পিচু আবিষ্কার করার আগে বর্তমানে পৃথিবী বিখ্যাত প্রাচীন এই নিদর্শন ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত অবহেলিত ছিল। ১৪৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই শহর দুই কারণে পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হয়- স্প্যানিশদের আগমন এবং ইনকা গৃহ যুদ্ধ।
১৯১১ সালের গ্রীষ্মে আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ হিরাম বিংহাম ছোট একটি অভিযাত্রী দল নিয়ে পেরুতে আসেন ভিলকামবাম্বা এর খোঁজে। পায়ে হেঁটে বিংহামের দল কুজকো থেকে উরুবাম্বা উপত্যকা পর্যন্ত পৌঁছালে স্থানীয় এক কৃষক নিকটবর্তী এক ধ্বংসাবশেষের ব্যাপারে জানায় যা অবস্থিত ছিল একটি পর্বতের চূড়ায়। প্রতিকূল এক পরিবেশে পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে তারা যখন চূড়ায় পৌঁছায়, তখন বিংহাম প্রথমবারের মত মাচু পিচুর জটিল ভাবে সাজানো পাথরের প্রবেশদ্বার অবলোকন করেন।
১৯১২ সালে সেখানে খনন করে বেশ কয়েক ডজন কঙ্কাল পাওয়া যায়। প্রাথমিক ভাবে বেশিরভাগ কঙ্কাল মহিলাদের হিসেবে চিহ্নিত করা হলে বিংহাম ধারণা করেন যে, মাচু পিচু ছিল “সূর্যের কুমারী” (ভার্জিন্স অব দ্য সান) বা “নির্বাচিত নারী”দের আবাস, যারা ছিল একটি অভিজাত ইনকা গোষ্ঠীর সদস্য। বাকি যে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল সেগুলো খুব সম্ভবত চাকর, কৃষি-মজুর, যোদ্ধাদের কঙ্কাল যাদেরকে শহরের বাইরে কবর দেয়া হয়েছিল।
নিজের আবিষ্কারে প্রফুল্লিত বিংহাম তার লেখা বই “দ্য লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস” এর মাধ্যমে মাচু পিচুর কথা সবখানে ছড়িয়ে যায়। উৎসুক ভ্রমনপিপাসু জনগণ বিংহামের মত করে নিজেদের পদচিহ্নে পদাংকিত করার উদ্দেশ্যে পেরুতে ভিড় জমানো শুরু করে।
বিংহাম মাচু পিচু থেকে কিছু নিদর্শন খুঁজে পায় এবং তিনি তা গবেষণার উদ্দেশ্যে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়ে দেন। বিংহাম তার গবেষণায় উল্লেখ করেন যে তারা কোন সোনা বা রুপার জিনিসের সন্ধান পাননি। তবে ব্রোঞ্জ, কাঠ, পাথর, হাড় এবং অন্যান্য ধাতুর তৈরি জিনিস খুঁজে পাওয়ার উল্লেখ আছে। সব মিলিয়ে বিংহাম একটি তালিকা দিয়েছেন যার মধ্যে ৫২১ টি চিনামাটির এবং প্রায় ২২০ টি বিভিন্ন ধাতুর তৈরি জিনিসের উল্লেখ আছে।
তবে বিংহামের আবিষ্কার নিয়ে অনেক দ্বিমত রয়েছে। পেরুভিয়ান সরকার ১৯১৬ সালে যে রিপোর্ট পেশ করে সেখানে বলা আছে যে তারা হাড়, মমি চিনামাটির জিনিস, কাপড়, ধাতু এবং কাঠের তৈরি জিনিস ভর্তি ৭৪ টি বক্সের তালিকা করেছে তবে সেখানে সোনা বা রূপা প্রাপ্তির কোন উল্লেখ নেই। বিভিন্ন গবেষণা বলে যে, এই শহরকে যেহেতু অভিজাত ইনকাদের শহর বলা হত, সেহেতু মূল্যবান কোন জিনিস পাওয়া যাবে না সেটা অবিশ্বাস্য। ইতিহাস বলে, ৪০০ বছর পর্যন্ত স্প্যানিশরা মাচু পিচু লুট করেনি বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসেনি। তাই সেই হিসেবে আচার কাজে ব্যবহৃত সোনা ও রূপার তৈরি বেশ কিছু নান্দনিক তৈজস এবং রাজকীয় অলংকরণ খুঁজে পাওয়ার কথা।
মাচু পিচুর নকশা
মাচু পিচুর নকশা কয়েক ভাগে ভাগ করা- শহর এবং কৃষিক্ষেত্র, উপরের শহর এবং নিচের শহর। মন্দির গুলো অবস্থিত ছিল উপরের শহরে আর নিচের শহরে ছিল গুদাম। এই নকশার ভিত্তিতে পর্বতের উপরে পূর্ব-পশ্চিম কেন্দ্রীয় বর্গ ঘিরে প্রায় ২০০ টি স্থাপনা নির্মিত হয়। “কাঞ্চা” নামের লম্বা এবং সংকীর্ণ প্রাঙ্গণগুলো কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। জমিতে পানি দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হত অত্যাধুনিক পদ্ধতি। দেয়ালের গায়ে তৈরি পাথরের সিঁড়ি ব্যবহৃত হত পুরো স্থানের বিভিন্ন স্তরে যাওয়ার জন্য। শহরের পূর্বাংশ সম্ভবত ছিল আবাসিক এলাকা। পশ্চিমাংশ ব্যবহৃত হত ধর্মীয় এবং আচার-অনুষ্ঠানাদির কাজে। শহরের এই অংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল “টোরিওন”, বিশাল এবং সুউচ্চ মিনার যা ব্যবহার করা হত মান-মন্দির হিসেবে।
শহরের উপরের অংশে অবস্থিত “ইনতিহুয়াতানা” (টেম্পল অব দ্য সান) এবং “দ্য রুম অব দ্য থ্রি উইন্ডোস” স্থাপনা সমূহ প্রাথমিক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ। এই মন্দির করা হয়েছিল সর্বশক্তিধর সূর্যদেবতা ইনতিকে উদ্দেশ্য করে। আবাসিক এলাকায় বাস করতো নিচু গোত্রের লোকেরা। এই অংশে ছিল সাধারণ ঘরবাড়ি আর গুদাম।
রাজকীয় অংশের বাড়িগুলো সাজানো ছিল উঁচু ঢালের উপর। বিদ্বান “আমাউতাস”দের বাসস্থান চিহ্নিত করা হত লাল দেয়াল দিয়ে এবং “নুসতাস”দের (রাজকুমারী) কক্ষ ছিল ট্রাপিজিয়াম আকৃতির। খোদাইকৃত এবং খিলানযুক্ত মূর্তি ব্যবহার করা হত অনুষ্ঠান বা বলিদানের ক্ষেত্রে।
পাহারাদারের ঘরের আকৃতি ছিল ত্রিকোণাকার এবং একদিক উন্মুক্ত ছিল সেরেমোনিয়াল পাথরের সামনের প্রাঙ্গণ পর্যন্ত। ইনকা স্থাপত্যের এই নকশাকে বলা হত ওয়েরোনা স্টাইল।
মাচু পিচুর বর্তমান চিত্র
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পেরুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র এই মাচু পিচু। প্রতি বছর সারা বিশ্বের হাজার হাজার পর্যটক আসে এখানে। আর এই কারণে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়া নিদর্শন গুলো উদ্ধারের জন্য পেরুভিয়ান সরকার সচেষ্ট আছে। কুজকো থেকে ট্রেন এর মাধ্যমে উরুবাম্বা নদী উপত্যকা থেকে প্রায় ১৬৪০ ফিট উপরে আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে দিনের মধ্যে পৌঁছানো যাবে মাচু পিচু তে।
রেস্টুরেন্টসহ একটি আবাসিক হোটেল রয়েছে এখানে এবং এগুয়াস ক্যালিএন্তেস নামের পার্শ্ববর্তী গ্রামে রয়েছে থার্মাল বাথ বা উষ্ণ স্নানাগার। ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে এক দাবানলের ঘটনায় ইনকা ব্রিজ এবং মাচু পিচুর বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে প্রায় সাথে সাথেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
পর্যটন সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ফলে আশে-পাশের শহর গুলোতে উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পরিবেশের উপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে, যার ফলে মাচু পিচুর বাসিন্দা বিলুপ্তপ্রায় কিছু প্রাণী হুমকির মুখে পড়ছে। পেরুভিয়ান সরকার এই ঘটনা বিবেচনা করে মাচু পিচু সংরক্ষণ এবং পর্বতের ক্ষয় রোধে কাজ করে যাচ্ছেন। মাচু পিচু ২০০৭ সালে পৃথিবীর নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
zofran route of administration
order lamisil pills – forcan generic grifulvin v ca
zyprexa eli lilly