প্রাচীন এক সভ্যতা ইনকা সভ্যতা , ১২ লাখের মত জনগোষ্ঠী নিয়ে রহস্য নগরী পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার উচ্চভূমিতে এক মনোরম সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তাদের কোন লেখ্য ভাষা ছিলনা, অথচ সফলতার সাথে জনকর্মসংস্থান আর সুপরিকল্পিত চাষাবাদভিত্তিক এক বিশাল রাজত্বের সূচনা করেছিল ইনকারা ।
আশেপাশের বহু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ যুদ্ধে পরাজিত করে কিছুদিনের মধ্যেই তারা দক্ষিণ আমেরিকার এক পরাক্রমশালী সভ্যতায় পরিনত হয় । কিন্তু কালের পরিক্রমায় প্রাচীন এ সভ্যতাটি একসময় ধ্বংস হয়ে যায়। ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যাওয়া এই শক্তিশালী জাতিটির বিলুপ্তির পেছনে রয়েছে এক নিষ্ঠুর গল্প, আর এ গল্পের শুরুটা হয় সাম্রাজ্যে স্প্যানীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। বহু জাতিগোষ্ঠীকে পরাজিত করতে পারলেও স্প্যানীয়দের ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমনকে ঠেকাতে পারেনি ইনকারা। কারন স্প্যানিয়দের আগমনের ৫ বছর পূর্বেই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে এক বিধ্বংসী যুদ্ধে ইনকা রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাজশক্তির এ দুর্বলতাই ছিল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সূচনা বিন্দু ।
স্প্যানিশদের আগমনের ৫ বছর পূর্বে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে এক বিধ্বংসী যুদ্ধে ইনকা রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পরে। রাজশক্তির এ দুর্বলতাই ছিল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সূচনা বিন্দু । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইনকার সর্বশেষ স্বাধীন সম্রাট আটাহুয়ালপার প্রানদন্ড- যা ছিল ৩০০ বছরের ইনকা সভ্যতা র ইতিরেখা।
গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল আটাহুয়ালপা ও তার বৈমাত্রেয় ভাই হুয়াস্কার

১৫০২ খ্রীস্টাব্দে জন্ম নেয়া আটাহুয়ালপা ছিলেন ইনকা সম্রাট হুয়ায়না কাপাকের ছোট ছেলে। হুয়ায়নার মৃত্যুর পর পুরো সাম্রাজ্য দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কালক্রমে এ ঘটনা ভয়ানক এক গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। ১৫৩২ সালে রাজধানী কুজকোর কাছে সংঘটিত হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আটাহুয়ালপা পরাজিত করেন তার বৈমাত্রেয় ভাইকে । কিন্তু সর্বশেষ স্বাধীন সম্রাটের এ জয় দীর্ঘস্থায়ী হলনা । ১৮০ জন সৈন্য নিয়ে ইনকায় পাড়ি জমান স্প্যানিশ সৈন্যপ্রধান ফান্সিসকো পিজারো , আটাহুয়ালপা কোন বাধা না দেওয়ায় সাম্রাজ্যে বহিরাগত হস্তক্ষেপের সূচনা হয়।
স্প্যানিশ সৈন্যদের প্রতি আটাহুয়ালপার এ নির্লিপ্ততা কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৫৩৩ সালের ২৯ আগস্ট ইনকার ত্রয়োদশ ও সর্বশেষ সম্রাটকে শ্বাসরোধে হত্যা করে ফ্রান্সিসকো পিজারো র সৈন্যরা ।
ফ্রান্সিসকো পিজারো কে এক বিশেষ অভিযানে পাঠানো হয়েছিল
স্প্যানিয় বংশোদ্ভূত এই পিজারো যুবক বয়সে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করত। সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করার কিছুদিন পর পিজারো ফ্রান্স থেকে হিসপানিওয়ালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৫১০ সালে তিনি কলম্বিয়া অভিযানে অংশগ্রহন করেন। এ সময় তিনি স্প্যানিশ বিজেতা অ্যালন্সো দ্যি ওজেদার অধীনে ছিলেন। কয়েক বছর পর, ১৫১৩ সালে ভাস্কো নুনেজ দ্যি বালবুয়া প্রশান্ত মহাসাগর আবিষ্কার করেন, তার সঙ্গী ছিলেন পিজারো।
ঘটনাক্রমে একসময় দক্ষিন আমেরিকার সম্পদ পূর্ন ভূখন্ডের কথা জানতে পারেন এবং ১৫২৪ সালে সহকর্মী দিয়েগো দি অ্যালমাদোর সাথে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পৌছান। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পিজারো পানামায় চলে আসেন এবং পেরু আক্রমনের মাধ্যমে ধনসম্পদ লুন্ঠনের এক ছক আঁকতে থাকেন। কিন্তু স্প্যানিশ গভর্নর তার এ পরিকল্পনায় সায় দেননি । ১৫২৮ সালে পিজারো আবারো স্পেনে ফিরে আসেন, স্পেনের শাসক তখন রাজা পঞ্চম জর্জ । পিজারো তার সেই পরিকল্পনার ব্যাপারে রাজার সহায়তা প্রার্থনা করেন। ঐ সময়ে অ্যাজটেক সাম্রাজ্য জয় করার পর হারনান কর্টেজে প্রচুর স্বর্নমুদ্রা জমা পড়েছিল । তাই নিজের লাভের কথা ভেবে রাজা পঞ্চম জর্জ পিজারোকে অনুমতি দিয়ে দেন এবং সেই সাথে অভিযানের জন্য একটা বড় অংকের অনুদান দিতেও রাজি হয়ে যান। ১৫৩০ সালে পানামায় ফিরে আসেন পিজারো।
১৫৩১ সালে পেরুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে টুম্বেসে এসে পৌছান। সেখান থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে আন্দিজ পর্বতমালার দিকে যাত্রা শুরু করেন। অবশেষে ১৫৩২ সালে ১৫ নভেম্বর কাজামারকার সেই সমৃদ্ধ ইনকা শহরে প্রবেশ করেন।
সম্রাট আটাহুয়ালপাও তখন কাজামারকায় ছিলেন। বৈমাত্রেয় ভাই হুয়াস্কারের শাসনাধীন রাজধানী কুজকো আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

পিজারোর ফাঁদে পড়লেন সম্রাট
শহরে পৌঁছে পিজারো আটাহুয়ালপা ও কিছু ইনকা অভিজাতদের এক ভোজে নিমন্ত্রণ করেন। সম্রাট এ নিমন্ত্রণ গ্রহন করলেন। কিছুদিন আগেই ৩০০০ সৈন্যের নেতৃত্বে ইনকা সভ্যতার ইতিহাসে এক বড় যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন তিনি। তাই ভেবেছিলেন শশ্রুধারী এই শ্বেতাঙ্গ আগন্তুক আর তার ১৮০ সহচরকে ভয়ের কিছু নেই। অথচ তিনি কখনো কল্পনাই করেননি এদিকে এই শ্বেতাঙ্গ লোকটি কত ভয়ংকর এক নকশা এঁকে রেখেছে। পিজারোর অস্ত্রধারী সৈন্যরা কৌশলে পুরো কাজামারকাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল !
মাটিতে বাইবেল ছুঁড়ে ফেলে আটাহুয়ালপা
পরেরদিন, নভেম্বরের ১৬ তারিখ, সরল বিশ্বাসে আটাহুয়ালপা আর তার কয়েক হাজার সৈন্যসামন্ত নিরস্ত্র অবস্থায় ভোজে অংশগ্রহন করে। পিজারো তখন সম্রাটের কাছে এক ধর্মযাজক পাঠায়। নির্দেশানুযায়ী যাজক তাকে রাজা চার্লসের আধিপত্ব মেনে নিয়ে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহন করতে বলে।
সম্রাট আটাহুয়ালপা এহেন অসম্মানজনক প্রস্তাবনা অস্বীকার করলেন এবং প্রচন্ড রাগ আর ঘৃনায় তার হাতে থাকা যাজকের দেয়া একটা বাইবেল মাটিতে ছুঁড়ে মারলেন। এ ঘটনায় পিজারো ভয়ানকভাবে রেগে গিয়ে তৎক্ষনাৎ আক্রমনের আদেশ দিলেন। পিজারোর ছিল ঘোড়সওয়ার, বন্দুক আর আর এমন কিছু অস্ত্র যা ইনকারা কখনই দেখেনি ! অস্ত্রধারীরা হঠাৎ আক্রমন করে পিষ্ট করল হাজারো ইনকাকে, নৃশংসভাবে হত্যা করল তাদের। বন্দী করা হল আটাহুয়ালপাকে।

মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে হত্যা করা হল ইনকা সম্রাটকে
বন্দী করার পর আটাহুয়ালপার কাছে পিজারো মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ হিসেবে সম্রাট ও তার রাজ্যের অভিজাতরা এক ঘরভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিতে রাজি হয়। এসব বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় ইনকা সাম্রাজ্য থেকে স্প্যানিশরা মোট ২৪ টনের মত স্বর্ণরৌপ্য লুট করেছিল ।
বিশ্বের ইতিহাসে আটাহুয়ালপার দেয়া এ মুক্তিপণই ছিল সবচেয়ে বড় অংকের মুক্তিপণ। কিন্তু তবুও সম্রাট তার দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেলেন না। বিশ্বাসঘাতক পিজারো সম্রাটকে মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে এক অন্যরকম ষড়যন্ত্র করলেন। বৈমাত্রেয় ভাই হুয়াস্কারকে হত্যা করা এবং কিছু ছোটখাট বিষয়ের দায়ে তাকে স্প্যানিশ বিচারালয়ে পাঠানো হয়। আদালত সম্রাটকে অপরাধী বলে ঘোষনা করে এবং হত্যার আদেশ দেয়।
১৫৩৩ সালের ২৯ আগস্ট, সম্রাটকে তার মৃত্যুর দুটি উপায় জানিয়ে একটি শর্ত দেয়া হয়। সম্রাট যদি খ্রীস্টধর্ম গ্রহন করেন তবে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হবে এবং তা না হলে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। দুর্ভাগা আটাহুয়ালপা চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তার দেহটি অন্তত মমিতে সংরক্ষিত থাকুক। এ আশায় তিনি প্রথম পথটি বেছে নিলেন। এরপর নিষ্ঠুর আর বিশ্বাসঘাতক পিজারোর আদেশে লোহার শেকল দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় ইনকার সর্বশেষ স্বাধীন সম্রাটকে।
পিজারো তার অভিযান অব্যাহত রাখে এবং ঐ বছরেই স্প্যানিয় সহায়তায় কাজামারকার রাজধানী কুজকো আক্রমন করে। ১৫৩৩ সালের নভেম্বরের দিকে কোনঠাসা হয়ে পড়ে রাজধানী কুজকো। হুয়াস্কারের ভাই মানকো কাপাককে সিংহাসনে বসানো হয় এবং তিনি পিজারোর খেলার পুতুলে পরিণত হন। আক্রমন চলে কুইটো সিটিতে। পিজারো পুরোপুরিভাবে ইনকা দখল করে নেয় এবং স্প্যানিশ শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে থাকে। দিয়েগো আলমাগ্রোকে তিনি চিলিতে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন যাতে পুরো ইনকায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের তৃষ্ণা ষোলকলায় পূর্ন হয়।
পানামার সাথে যোগাযোগের সুবিধার জন্য ১৫৩৫ সালে উপকূলের কাছাকাছি লিমা নামে এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করে। পরের বছর নামমাত্র সম্রাট মানকো কাপাক স্প্যানীয় তত্ত্বাবধান থেকে মুক্ত হয় এবং বিদ্রোহ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার সে অপরিকল্পিত বিদ্রোহ সফল হয়নি বরং তাকে বন্দী করা হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই স্প্যানীয় শাসনের কাছে ইনকা সভ্যতার পতন ঘটে। এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েই সর্বশেষ ইনকা সম্রাট ও তার সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এদিকে চিলিতে দারিদ্র্যতায় পিষ্ট হয়ে দিয়েগো আলমাগ্রো ইনকায় ফিরে আসে এবং ইনকা সাম্রাজ্য লুন্ঠনে প্রাপ্ত সম্পদে তার অংশ দাবি করে। আবারো গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং খুব দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
১৫৩৮ সালে আলমাগ্রো কুজকো দখল করে নেয়। পিজারো তার বৈমাত্রেয় ভাই হারনান্দোকে কুজকো শহরপুনরুদ্ধার করতে পাঠায়। হারনান্দো আলমাগ্রোকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
১৫৪১ সালে আলমাগ্রোর পুত্র দিয়েগো অ্যাল মোনজ লিমাতে অবস্থিত পিজারোর প্রাসাদে জোরপূর্বক প্রবেশ করে এবং রাতের খাবার খাওয়ার সময় প্রাসাদে গুপ্তহত্যা চালায়, হত্যা করে পিজারোকে । দিয়েগো এরপর নিজেকে পেরুর শাসক বলে দাবি জানায় কিন্তু কিছু স্প্যানীয় তাকে এ স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। ১৫৪২ সালে দিয়েগো স্প্যানীশদের হাতে বন্দী হলে তাকে হত্যা করা হয়। ১৫৫০ সালের শেষের দিকে স্প্যানীশ ভাইসরয় আন্দ্রেস হার্টেডো দ্যি মেনডোজার শাসন প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত পেরুর বিজেতাদের মধ্যে এমন বিরোধ ও ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে।
levaquin usa buy levaquin for sale