জ্যাক দ্যা রিপারঃ রহস্যময় বিখ্যাত সিরিয়াল কিলার

1

প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছু না কিছুনা দক্ষতা থাকে, থাকে শখ, থাকে প্যাশন। যদি তার নাম সিরিয়াল কিলিং হয় তবে অবশ্যই তা ভাল শোনাবেনা। হয়তো আপনার আশেপাশেই এমন কেউ লুকিয়ে আছে জানেন না। হয়তো পরমূহুর্তেই আপনিই হতে পারেন টার্গেট। এমনই ভয়ংকর আশংকা নিয়ে ১৮৮৮ সালে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল ডিসট্রিক্টের লোকজনকে চলাফেরা করতে হত। যার কারিগর ছিল জ্যাক দ্যা রিপার। যাকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় সিরিয়াল কিলার, যাকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায় নি।

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে আইরিশ অভিবাসীরা এবং ১৮৮২ এর দিকে রাশিয়া পোল্যান্ড এবং রোমানিয়া থেকে ইহুদিরা  লন্ডনে আসতে থাকে। তার ফলে পূর্ব লন্ডনে জনারণ্য হয়ে উঠতে থাকে। তাদের মাঝে বেশীরভাগই ছিল দরিদ্র ইহুদী। ময়লা আবর্জনা, নোংরা,গরীব, অতিরিক্ত জনগণ, বস্তি বসতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দ্বারা ঘেরা একটি শহর হয়ে উঠে হোয়াইট চ্যাপেল। তাদের ছিলনা স্বাভাবিক জীবনধারণের মত সঙ্গতি। তার ফলে অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করত। ফলশ্রতিতে   বাধ্য হয়েই অনেক মেয়েকে পতিতাবৃত্তিতে নামতে হয়। এইখানে তাই গড়ে উঠে ৬২ টি পতিতালয় আর পতিতার সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০।

Source

নারীর উপর সহিংসতা এত বৃদ্ধি পায় যে একজন লোকের দ্বারা  কতজন খুন হয়েছে তা জানার উপায় নেই। ২ এপ্রিল  ১৮৮৮ সাল থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ পর্যন্ত লন্ডন  মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ১১ টি হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশ এটিকে “হোয়াইট চ্যাপেল মার্ডার” নামে অভিহিত করে। এহেন অরাজক অবস্থায় নতুন করে একটি আতংক নেমে আসে। আতংকের নামে জ্যাক দ্যা রিপার। এই ১১ টি খুনের মাঝে পাঁচটি খুনের জন্য দায়ী করা হয় জ্যাক  দ্যা রিপারকে। এই পাঁচটি খুনকে বলা হয় ক্যানোনিকাল ফাইভ।

ক্যানোনিকাল ফাইভের শিকার পাঁচজন  নারী হলেন ম্যারি অ্যান নিকলস, অ্যানি চ্যাপম্যান, এলিজাবেথ স্ট্রাইড, ক্যাথরিন এডোস, মেরি জেন ক্যালি। এদের মাঝে মেরি ক্যালি ছাড়া বাকি চারজনই ছিল পতিতা।

হোয়াইট চ্যাপেলের বাকস রো এলাকায় ১৮৮৮ সালের ৩১ শে আগস্ট রাত ৩ টা ৪০ মিনিটে  নিকলসের লাশ পাওয়া যায়। ধারালো চাকুর সাহায্যে গলায় দুটি আঘাত করা হয়েছে যার ফলে তা ফেড়ে গেছে। তলপেটের নিচের অংশ নিখুঁতভাবে কেটে নিয়েছিল খুনি।

তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে হ্যানব্যারি স্ট্রিটের একটি বাড়ির পিছনের দরজায় ১৮৮৮ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর সকাল ৬ টার দিকে অ্যানি চ্যাপম্যানের লাশ পাওয়া যায়। তার গলাটিও ঠিক আগের হত্যাকাণ্ডের মতই একইভাবে দুটি আঘাত করে ফেড়ে ফেলা হয়েছিল। তার তলপেট কেটে উন্মুক্ত করা ছিল। পরে দেখা যায় তার জরায়ু পুরোটাই কেটে ফেলে দিয়েছিল খুনি। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানায় ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে একটি একটি কালো চুলের এক উসকোখুসকো লোকের সাথে তাকে শেষ দেখা গিয়েছে। এই দুইটি খুন এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।

Source

এর প্রায় তিন সপ্তাহ পর, ১৮৮৮ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর এলিজাবেথ স্ট্রাইড ও ক্যাথরিন এডোসের লাশ পাওয়া যায়। স্ট্রাইডের লাশ পাওয়া যায় দ্যূত-ফিল্ডস ইয়ার্ডে  রাত একটায়। তার কাঁধে প্রধান ধমনীর বাম পাশ থেকে কেটে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এইবার তলপেট অক্ষতই ছিল। ধারণা করা হয় খুনির তাড়াহুড়ার কারণে এমনটি হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জানায় এক উসকোখুসকো লোকের সাথে সর্বশেষ দেখা গিয়েছে তাকে।

এর ঠিক ৪৫ মিনিট পরেই মিট্রে স্কয়ারে এডোসের লাশ পাওয়া যায়।  বরাবরের মতই গলা কাটা এবং তলপেটে বাম কিডনি ও জরায়ু কেটে নেওয়া হয়েছে। এডোসের রক্তাক্ত এপ্রনের কিছু অংশ একটি বহুতল বস্তির সামনের প্রবেশদ্বারে পাওয়া যায়। এর ঠিক উপরেই ইহুদিদের বিরুদ্ধ লেখা একটি গ্রাফিতি আকা ছিল। তবে সেটা খুনিদেরই আকা ছিল কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মানুষের মনে প্রচণ্ড আতংক ছড়িয়ে পড়ল।

এর একমাসের কিছু সময় পর ৯ই সেপ্টেম্বর সকাল পৌনে ১১ টায় নিজের রুমে মেরি ক্যালির লাশ পাওয়া যায়। গলা থেকে মেরুদণ্ড পর্যন্ত কাটা ছিল। তলপেটের কোন অঙ্গই ছিলনা, হৃদপিণ্ডটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ক্যানোনিকাল  ফাইভ হত্যাকাণ্ডগুলো রাতে, সাপ্তাহিক বন্ধের দিন, এক সপ্তাহ  অথবা এক মাস পরে সংগঠিত হয়।  এর পরেও আরও ছয়টি খুন হয় যেগুলোর সাথে রিপারের খুনের  ধরণ না মেলায় এগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যদিও এই এগারোটি  খুন কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় এগুলোকে রিপারের খুন বলেই ধারণা করা হয়। এর মাঝে আছে মার্থা টাব্রাম, এলিস ম্যাকেঞ্জি, ফ্রান্সেস কোলস খুন।

Source

প্রথম চারটি খুনেই গলায় বাম থেকে ডানে কেটে ফেড়ে দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চম লাশের অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে তা শনাক্ত করা যায়নি। তলপেটের অঙ্গগুলির কেটে  ফেলারও সাদৃশ্য  পাওয়া গেছে। তাই তদন্ত দল এটা একজনের কাজ বলেই মনে করে তদন্ত করেছে। এত নিখুঁতভাবে অঙ্গগুলো কাটা হয়েছে তাই এটি মেডিকেল প্রফেশনের কেউ করেছে বলে মনে করা হয়।

এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পর লন্ডনে কোন খুন হলেই সবাই ধরে নিত যে এটা জ্যাক দ্যা রিপারের কাজ। পুলিশ আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। একটি বর দল এই খুনের তদন্তে নামে। প্রায় ২০০০ ব্যাক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, ৩০০ জন লোকের উপর তদন্ত করা হয় এবং ৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয় এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করার জন্য। হোয়াইট চ্যাপেলের সিআইডি পুলিশ, লন্ডন সিটি পুলিশ আর নামকরা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও এর কূল কিনারা করে উঠতে পারেনি।

কে এই জ্যাক দ্যা রিপার তা নিয়ে এখন পর্যন্ত সন্দিহান-ভাবে জানা যায়নি। এর জন্যই এই সিরিয়াল কিলার বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।

পুলিশ বিভাগের অন্যতম জনপ্রিয় তত্ত্ব হল জর্জ চ্যাপম্যান হল জ্যাক দ্য রিপার । প্রকৃত পক্ষে পোল্যান্ডের এক জন অধিবাসী ছিল চ্যাপম্যান, যার আসল নাম সেভেরিন ক্লোসোউস্কি। খুনগুলো সংগঠিত হবার সময় সে নাপিতের কাজ করত হোয়াইট চ্যাপেলে। ১৮৮৯ সালে চ্যাপম্যান গিয়েছিল আমেরিকা আর লন্ডনে ফিরে আসে ১৮৯২ সালে। পরবর্তী দশ বছরে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে তিন মহিলাকে কোন উদ্দেশ্য ছাড়া, শুধু স্যাডিস্টিক আচরন চরিতার্থ করার জন্য। চ্যাপম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল ১৯০৩ সালে, আর রিপারের হত্যাকান্ডে নিয়োজিত চীফ ইন্সপেক্টর ঘোষণা দিল চ্যাপম্যানই ছিল রিপার।

রিপারের পরিচিতি ও অপরাধের উদ্দেশ্য সংক্রান্ত সর্বজন বিদিত তত্ত্বটা পেশ করেন লিওনার্ড ম্যাটারস। কোন প্রমাণ ছাড়াই তিনি বলেন যে, রিপার ছিল জনৈক ডাক্তার স্ট্যানলি। বিপত্নীক ভদ্রলোক তার ছেলেকে ভীষণ ভালবাসত। সেই ছেলে মেরী কেলীর সংস্পর্শে আসার পর সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল। এরপরই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি খুঁজতে শুরু করলেন মেরি ক্যালিকে। সব গুলো শিকারের কাছে তিনি জিজ্ঞেস করতেন ক্যালির কথা, তারপর তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য তাদের মেরে ফেলতেন। ম্যাটারের মতে ডাক্তার স্ট্যানলি মারা গেছে বুয়েন্স এয়ারসে আর স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে মৃত্যুশয্যায়।

রিপারের পরিচিতি বিষয়ে এক তত্ত্ব পেশ করেন ডোনাল্ড ম্যাককরমিক তার “দ্য আইডেন্টিটি অভ জ্যাক দ্যা রিপার” বইতে, ম্যাককরমিক বলেছেন যে ১৯১৭ সালে খুন হওয়া আর এক রহস্যময় চরিত্র “রাশ পুতিন” এর কাগজ পত্রের মধ্যে একটি দলিল দাবী করছে যে রিপার ছিল এক খুনে উন্মাদ যাকে জারের পুলিশরা লন্ডনে পাঠিয়েছিল শুধু ইংরেজ পুলিশকে হতবাক করার জন্য। ম্যাককরমিক অনেক প্রমাণ উদ্ধার করে পূর্ব লন্ডনে বসবাসরত রুশ অভিবাসীদের সাথে একটা যোগসূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে বিশেষ করে পেদাচেঙ্কো নামে এক নাপিত সার্জেনের সাথে। কিন্তু এখনও কোন নিশ্চিত প্রমাণ এবিষয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।

Source

জ্যাক দ্যা রিপারের নামে অনেক উড়ো চিঠি আসতে থাকে পুলিশের কাছে। এর মধ্যে একটার নিচে লেখা ছিল Jack The Ripper রিপার শব্দের অর্থ ফেড়ে ফেলা। তারপর থেকেই এই নামেই পরিচিত হতে থাকে এই সিরিয়াল কিলার। জ্যাক দ্য রিপার নামের আগে  “Leather Apron” আর “Whitechapel Murderer” নামে পরিচিত ছিল।

জ্যাক দা রিপারের সিরিয়াল কিলিং এতো আলোচিত সমালোচিত ছিল যা কিনা এক সময় হোয়াইট চ্যাপেল শহরটিকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়।এই শহরের সব বস্তি ভেঙ্গে ভালো বাড়িঘর বানানো হয় নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয় ঘনবসতি কমে যায়।এই পরিবর্তনের জন্য অনেকে আবার জ্যাক দ্যা রিপারকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন।

The Fifty Most Amazing Crimes Of The Last 100 Years বই এ একমাত্র তারই কোন ছবি নেই। এই রহস্যময় সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে তাই মানুষ এখনো জানতে আগ্রহী। রিপারকে নিয়ে তাই হয়েছে তাই অসংখ্য গবেষণা, তথ্যচিত্র আর চলচ্চিত্র। তাকে নিয়ে গবেষণাকে রিপোরোলজি নামে আখ্যা দেওয়া হয়।

ইতিহাসের রহস্যময় একটি চরিত্র হিসাবে এখনো গণ্য হয় এই সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্যা রিপার।

 

 

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, jack-the -ripper.org, Jack the Ripper: Summing Up and Verdict by Colin Wilson

Leave A Reply
1 Comment
  1. Wcwpwk says

    semaglutide drug – semaglutide 14mg oral DDAVP brand

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More