পৃথিবীর বুকে শাসকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সফল শাসক বলতে গেলে প্রথমেই ইসলাম যুগের চতুর্থ খলিফা হবেন হযরত আলী (রাঃ) এর নাম, যার জীবনী হতে শিক্ষণীয় উপাদান রয়েছে অগণিত। নবীজী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর পূর্বের তিন খলিফার শাসনের পরবর্তী সময়ে শাসনবিহীন অবস্থায় মুসলিম সমাজ তথা আরব বিশ্ব মুখোমুখি হয় এক ভয়ানক পরিস্থিতির, যা সিদ্ধহস্তে মোকাবেলা করেন হযরত আলী (রাঃ) ।
হযরত আলী (রাঃ) র নামকরণ:
প্রথমত তাঁর নামকরণ করা হয়েছিলো ‘আসাদ’ এবং ‘জায়েদ’। তবে মহানবী (সাঃ) মক্কায় ফিরে আসার পর তাঁর নাম রাখেন আলী (রাঃ) । তবে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে ভিন্ন নামে ডাকা হতো।
তেমনই এক মজার নাম হল আবু তুরাব যার অর্থ হল “ধুলোবালির আব্বা”। একদিন নবীজী মসজিদে প্রবেশের পূর্বে দেখেন হযরত আলী এমন এক জায়গায় শুয়ে আছেন যা ধুলোবালিতে পূর্ণ। তখন তিনি রসিকতা করে ডাক দেন,
“হে আবু তুরাব (ধুলোবালির পিতা)। উঠো”।
তাছাড়া বড় ছেলে হাসানের নামে তাঁকে ডাকা হত ‘আবু-আল-হাসান।‘ এসব ব্যতীত মহানবী (সাঃ) তাঁকে ‘আসাদ আল্লাহ্’ উপাধি দান করেন যার অর্থ হল আল্লাহ্র সিংহ।
হযরত আলী (রাঃ) এর পরিচয়:
ইসলাম সাম্রাজ্যের অন্যতম এক উচ্চ ব্যক্তিত্ব তিনি। নাম তাঁর আলী ইবনে আবু তালিব। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর আপন চাচা আবু তালিবের স্ত্রী ফাতিমা বিনতে আসাদের কোলজুড়ে পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটে ৬০১ খ্রিষ্টাব্দে। হযরত আলীর জন্ম কোরাইশ বংশে। মহানবী (সাঃ) এর পিতা এবং মাতা মারা যাওয়ার পর চাচা আবু তালিব তাঁকে গড়ে তোলেন এবং চাচী ফাতিমা বিনতে আসাদ তাঁকে মেয়ের স্নেহ দেন। সেই প্রেক্ষিতে আলী (রাঃ) এর জন্মের পর চাচা আবু তালিবের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটলে শিশু বয়সে হযরত আলী (রাঃ) এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহানবী (সাঃ) এবং বিবি খাদিজা।
ছোটবেলা হতেই তিনি ছিলেন অকুতোভয়। যার প্রমাণ পাওয়া যায় মাত্র ১০ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার মাধ্যমে। সূত্রমতে তিনিই ছিলেন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া প্রথম মুসলিম পুরুষ যিনি মহানবী (সাঃ) এর ডাকে সাড়া দিয়ে বাচবিচার ছাড়াই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নবীজীর সাথে প্রথম নামাজ আদায় করেন। তাঁর ছিল ইসলামের শেষ রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর অগাধ বিশ্বাস। মুসলিম হওয়ার পর তাঁর বাবা আবু তালিব যদিও জাত ধর্ম ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালেও আলী (রাঃ)’কে কোনরূপ বাধা প্রদান না করে বরঞ্চ ভাতিজার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে বলেন,
“যেহেতু সে [মহানবী (সাঃ)] তোমাকে শুধুমাত্র সঠিক পথেই পরিচালিত করবে সেহেতু তুমি তাঁকে অনুসরণ করো এবং তাঁর অতি নিকটে অবস্থান করো”।
এরপর হতেই তিনি নবীজীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতেন ছায়ার মতো। ইসলামের যুগে সংগঠিত হওয়া প্রায় সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন হযরত আলী (রাঃ) এবং ঢাল হয়ে রক্ষা করেছিলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে যার জন্য তাঁকে “আল্লাহ্র সিংহ’ খেতাব দেয়া হয়।
মহানবী (সাঃ) খুব স্নেহ করতেন হযরত আলী (রাঃ) কে এবং যতদিন তিনি ছিলেন ততদিন আলী (রাঃ) এর পথ প্রদর্শন এবং সঠিক পরামর্শ দিতেন।
বলা হয়ে থাকে হযরত আলী (রাঃ) ই সেই ব্যক্তি যার জন্ম হয়েছিলো পবিত্র কাবা শরীফের অভ্যন্তরে। যদিও এই ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।
হযরত আলীর মদিনায় হিজরত:
সময়কাল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ। মোহাম্মদ (সাঃ) জানতে পারেন তাঁকে মেরে ফেলার জন্যে শত্রুরা পরিকল্পনা কষছে। তাই তিনি আলী (রাঃ) কে নির্দেশ দেন তাঁর শয়নকক্ষে অবস্থান করতে এবং বিভিন্ন মানুষ হতে পাওয়া আমানতসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ করতে। এ বলে তিনি হযরত আবু বকর (রাঃ) কে সঙ্গে নিয়ে নীরবে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এই ব্যাপারে শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ বেমালুম। পরিকল্পনা মতে যখন তাঁরা মহানবীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর শয়নকক্ষে প্রবেশ করে তখন তাঁর বদলে আলী (রাঃ)কে দেখে তারা যারপরনাই অবাক হয়ে যায়। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে দেখেও আলী (রাঃ) এর দৃঢ়তা এবং সৎসাহস দেখে কোন ক্ষতি না করে চলে যায়। পরে নির্দেশ পাওয়ার পর আলী (রাঃ) মোহাম্মদ (সাঃ) এর পরিবারকে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন যা বর্তমানে নবীজীর শহর নামে পরিচিত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, হযরত আলী (রাঃ) প্রথম মুসলিম যিনি মদিনায় হিজরত করেন।
হযরত আলী (রাঃ) এর বিবাহ এবং হযরত আলীর সন্তান:
হিজরতের সময়কালে নবী (সাঃ) একদিন আলী (রাঃ) কে ডেকে বলেন আল্লাহ্র নির্দেশ যেন হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর সাথে হযরত আলী (রাঃ) এর বিবাহ কার্য সম্পাদন করেন। এরপর হযরত খাদিজা (রাঃ) এবং মহানবী (সাঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় আদরের কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) কে বিবাহ করেন হযরত আলী (রাঃ)। তাদের কোলজুড়ে জন্ম নেয় হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এবং ইমাম হোসেইন (রাঃ)। হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর মৃত্যুর পর আলী (রাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন এবং ওই সংসারে জন্ম নেয় মোহাম্মদ ইবনে-আল-খলিফাসহ আরো কয়েকজন।
ইসলামের অগ্রযাত্রায় হযরত আলীর অবদান:
যুদ্ধে অংশগ্রহণ:
হযরত আলী (রাঃ), রাসুল (সাঃ) এর জীবিত দশায় সংঘটিত সব যুদ্ধে সশরীরের অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হল।
বদরের যুদ্ধ:
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রধান যুদ্ধ হল বদরের যুদ্ধ। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হওয়া যুদ্ধটি মদিনার মুসলিম এবং মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। শত্রুপক্ষের ৯৫০ জন সৈন্য, ১০০ টি ঘোড়া এবং ১৭০ টি উটের বিপক্ষে বুক পেতে সাহসিকতার সহিত দাঁড়িয়ে ছিল মুসলমান পক্ষের ৩১৩ জন সৈন্য, ২ টি ঘোড়া এবং ৭০ টি উট। এতে শত্রু পক্ষের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয় এবং মুসলমানদের পক্ষের ১৪ জন শহীদ হন।
উহুদের যুদ্ধ:
৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হওয়া এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৩০০০ সৈন্য, ৩০০০ উট এবং ২০০ টি ঘোড়ার বিরুদ্ধে মুসলিমদের ছিল ৭০০ সৈন্য, ৫০ জন তীরন্দাজ এবং ৪ টি ঘোড়া। তবে এই যুদ্ধটির ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়।
খন্দকের যুদ্ধ এবং জুলফিকার তরবারি প্রাপ্তি:
হযরত আলী (রাঃ) এর জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল জুলফিকার তরবারি। সময়কাল ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ, খন্দকের যুদ্ধের সময়ের। যুদ্ধের ময়দানে ৩০০০ মুসলিম সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে ১০ হাজার বিশাল সৈন্যের বিপক্ষে যার নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। এতো বিশাল শত্রুপক্ষের বিপক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্যের মনোবল ভেঙ্গে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এসময় মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) করজোড়ে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে ওইসময়ে হযরত জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে ‘জুলফিকার’ নামক তরবারিটি পাঠান এবং রাসুল (সাঃ) সেটি হযরত আলী (রাঃ) কে প্রদান করেন। বলা চলে ওই যুদ্ধ শেষে মুসলিম সৈন্যদের আহত হওয়ার সংখ্যা কম হলেও আবু সুফিয়ানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়।
বেশ কিছু ইতিহাসবিদের মতে, জুলফিকার তরবারি হযরত আলী (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর বড় পুত্র হাসান (রাঃ) এর কাছে দেয়া হয়। পরে হাসান (রাঃ) শহীদ হওয়ার পর পালাক্রমে আসে হোসাইন (রাঃ) এর কাছে এবং তা দিয়ে কারবালায় ইয়েজিদ সৈন্যের বিপক্ষে যুদ্ধ করেন।
আমাদের নবীজী (সাঃ) তখনকার যুগের নয়টি তরবারি রেখে যান যার মধ্যে আটটি তুর্কির তোপকাপি যাদুঘরে এবং অন্যটি মিশরের কায়রোতে সংরক্ষিত আছে। তবে জুলফিকার তরবারিটি আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। এ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীনই ভালো জানেন।
খায়বারের যুদ্ধ:
৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে মদিনা হতে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে খায়বার মরুভূমিতে মুসলিম সেনারা মুখোমুখি হয় ইহুদিদের। এখানেও মাত্র ১৬০০ মুসলিম সৈন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো প্রায় ১০ হাজার শত্রু সৈন্যের বিপক্ষে। এ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হয়।
উটের যুদ্ধ:
হযরত উসমান (রাঃ) র হত্যাকাণ্ডের পর শাসনভারের দায়িত্ব আসে হযরত আলী (রাঃ) এর উপর। তবে হযরত তালহা, জুবায়ের এমনকি মহানবীর পত্নী আয়েশা (রাঃ) উসমান (রাঃ) র হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবী করেন। কিন্তু ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের ফলে তৎক্ষণাৎ কিছু করা সম্ভব হচ্ছিলো না। পরক্ষণে শত্রুপক্ষের কূটনৈতিক চালে হযরত উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের হাতে নিহত হয় হযরত জুবাইর এবং তালহা। এতে করে অবস্থা আরো সঙ্গিন হয়ে দাঁড়ায় এবং হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজেই তাঁর জামাতার বিপক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যদিও আলী (রাঃ) যুদ্ধে জয়ী হোন এবং আয়েশা (রাঃ) কে সসম্মানে মদিনায় পৌঁছে দেন।
সিফফিনের যুদ্ধ:
ক্ষমতা গ্রহণের পর ৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় হযরত আলী এবং সিরিয়ার গভর্নর আবু সুফিয়ানের মধ্যে। এই যুদ্ধে হযরত আলী (রাঃ) হারান তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থক আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে যার মৃত্যু সম্পর্কে বহু আগেই মোহাম্মদ (সাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন,
“আম্মার সত্যের সাথে, সত্য আম্মারে সাথে। চোখ নাকের যতটা কাছে, আম্মার ঠিক আমার ততোটা কাছের কিন্তু হায় হায়!! একটা বিদ্রোহী দল তাঁকে হত্যা করবে”।
সিফফিনের যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে একটা আলাদা প্রবন্ধ লেখা সম্ভব। যদিও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত ছিল তবে ইসলামের বুকে এই যুদ্ধটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
কোরআন সংরক্ষণ ও সংকলন:
কোরআন যখন নাযিল হচ্ছিলো তখন এর কিছু কিছু আয়াতাংশ নাজিল হত যা নবীজি বারবার তেলোয়াত করতেন এবং সাহাবীদের শোনাতেন। সাহাবীরাও তেলোয়াত করতে করতে তা মুখস্থ করে নিতেন যা কাতিবরা লিপিবদ্ধ করে নিতেন। সেসময়ে দশজন ব্যক্তি কোরআন অন্তরে ধারণ করে রেখেছিলেন সম্পূর্ণ যার মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) অন্যতম।
হযরত আলী (রাঃ) র ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত:
মহানবী (সাঃ) এর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সকল ধরণের অপসংস্কৃতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবার আগে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতেন হযরত আলী (রাঃ)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) প্রায় বলতেন,
“যদি আলী না থাকত তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত”।
চতুর্থ খলিফা হিসেবে তিনি ছিলেন দৃষ্টান্ত। এর প্রেক্ষিতে একটি ঘটনা সংক্ষিপ্তাকারে জেনে নেয়া যাক।
সিফফিনের যুদ্ধের পর আলী (রাঃ) এর হারানো প্রিয় ও মূল্যবান বর্মটি দেখতে পেলেন বাজারে যা একজন অমুসলিম লোক বিক্রি করছিল ছিলো। তিনি কাছে গিয়ে বললেন বর্মটি তাঁর এবং সে যেনো ফিরিয়ে দেয়।
লোকটি বললো – “জ্বী না, আমিরুল মুমিনীন। এটি আমার বর্ম”।
আলী (রাঃ) পুরোই নিশ্চিত ছিলেন বর্মটি তাঁর কিন্তু লোকটি মানতে নারাজ। লোকটি আলী (রাঃ) কে ব্যাপারটি নিয়ে কাজীর দরবারে যাওয়ার পরামর্শ দিলে দুইজনে সেখানে উপস্থিত হোন।
তখনকার কাজী শুরাইহ (রাঃ) আলী (রাঃ) এর কাছ হতে সাক্ষ্যপ্রমাণ চাইলে তিনি বলেন সাক্ষ্য হিসেবে নিজ পুত্র ইমাম হাসান এবং ক্রীতদাস কাম্বররকে উপস্থিত করতে চাইলে কাজী সাহেব বলেন,
“কিন্তু পিতার পক্ষে সন্তানের সাক্ষ্য আমি গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করি না হে আমিরুল মুমিনীন”।
হযরত আলী (রাঃ) নিরুপায় হয়ে লোকটিকে বললেন,
“যাও, তুমিই এটি নিয়ে যাও কারণ আমার আর কোন সাক্ষ্য নাই”।
মুসলিম জাহানের এতোবড় একজন শাসক সামান্য একজন লোকের কাছে এভাবে ন্যায়পরায়ণ হওয়াটা তাকে বিস্মিত করে। চাইলে খলিফা পারতেন জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে তাকে শাস্তি দিতে।
লোকটি বলে উঠলো,
“কিন্তু আমি তো আছি, আমিই সাক্ষ্য দিচ্ছি যে বর্মটি আপনার। হায় আল্লাহ্! আমিরুল মুমিনীন আমার বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থী হয়েছেন কাজীর দরবারে! আবার তাঁরই অধীনস্থ কাজী তাঁরই বিরুদ্ধে আমার পক্ষে রায় দিলেন! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, যে দীন (ধর্ম) এমন সুন্দর শিক্ষা দেয় সেই দীন অবশ্যই সত্য। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কোন মাবুদ নাই এবং মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বান্দা এবং রাসুল”।
“হে কাজী! নিঃসন্দেহে বর্মটি আমিরুল মুমিনীনের। তাঁর যে বাহিনী সিফফীন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলো, আমি তাঁদের পিছে পিছে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখলাম ধূসর রঙের উটের পিঠ হতে বর্মটি পড়ে যায় এবং আমি তা তুলে নিই”।
হযরত আলী (রাঃ) লোকটির ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় খুশি হয়ে বর্মটি তাঁকে দান করেন এবং সাথে একটি ঘোড়াও উপহার দেন।
সেই লোকটি বেশ কিছুদিন পর আলী (রাঃ) এর পতাকা তলে খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং চরম বীরত্বের সহিত লড়াই করে নাহারওয়ান এর যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেন। (তথ্যসূত্র- তাবেঈদের ঈমানদীপ্ত জীবন।)
হযরত আলী (রাঃ) র মৃত্যু:
ইবনে মুলজাম কুফায় এসেছিলো নিহত খারেজী নেতাদের হত্যার প্রতিশোধে হযরত আলী (রাঃ) কে হত্যার উদ্দেশ্যে। এদিকে সে কুত্তাম নামের এক মহিলাকে বিয়ে করতে চায়। মহিলাটি বিবাহের শর্ত হিসেবে তিন হাজার দিনার, একটি কুঁড়েঘর, একজন পুরুষ দাস এবং হযরত আলীর মৃত্যু দাবি করেন। কুত্তাম আগে হতেই আলী (রাঃ) এর প্রতি প্রতিশোধপ্রবণ ছিলেন। কারণ তাঁর সৈন্যবাহিনী নরওয়ানের যুদ্ধে কুত্তামের ভাই এবং পিতাকে হত্যা করে।
৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ এর সেদিনে ছিল ১৭ বা ১৯ রমজান, শুক্রবার। হযরত আলী ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে কুফা শাহী মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলে উৎ পেতে থাকা ইবনে মুলজাম বিষমাখা তলোয়ার দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেন। মুলজিমের সঙ্গী ওয়ার্দান ঘটনাস্থল হতে পালিয়ে তার বাড়িতে চলে যায় এবং সেখানে গিয়ে হযরত আলীকে হত্যার দায় স্বীকার করে আশ্রয় চাইলে ওয়ার্দানের এক আত্মীয় আব্দ বিন নাজাবা বিন ওবায়েদ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করে। পরে ইবনে মুলজামকে আটক করা হয়। হযরত উমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) এর পর হযরত আলী (রাঃ) খলিফা হিসেবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
হযরত আলী (রাঃ) র কবর:
হযরত আলী (রাঃ) কে কুফার নিকট নাযাফ নামক স্থানে দাফন করা হয়। প্রায় শত বছর পর্যন্ত হযরত আলীর কবরস্থান গোপনে রাখা হয়। ইমাম সাদিক (রাঃ) এর আমলে খারেজীদের (হযরত আলী রাঃ এর বিরোধী) নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর সাহাবী সাফওয়ান (রহঃ) কে নির্দেশ দেন হযরত আলীর কবরস্থানের উপর গাছ লাগিয়ে চিহ্নিত করতে। গোপন রাখার কারণ হিসেবে জানা যায়, কবরস্থান চিহ্নিত করতে পারলে হযরত আলীর বিরোধীরা তাঁর প্রতি অবমাননাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করার আশংকা।
হযরত আলী (রাঃ) বাণী:
১. ক্ষমাই সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিশোধ।
২. কামবাসনাকে আয়ত্তে আনো, তোমার জ্ঞান নিখুঁত হবে।
৩. আল্লাহ্ তোমাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন তবে কেন অন্যের অধীনে পরাধীন হয়ে থাকবে?
৪. তাঁদের কখনোই নিরাশ করো না যাদের শেষ ভরসা তুমি।
৫. কখনো যদি কাউকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হও তবে তাঁকে বোকা ভেবো না বরং চিন্তা করো কতোটা বিশ্বাস সে তোমাকে করেছিলো।
৬. বোকাদের সঙ্গে তর্ক করা নিরর্থক।
৭. যে নিজে সতর্কতা অবলম্বন করে না, দেহরক্ষী তাকে রক্ষা করতে পারে না।
৮. জীবন দুইদিনের। একটি তোমার পক্ষে আর অন্যটি বিপক্ষে। জিতে গেলে অহংকার করো না এবং হেরে গেলে ধৈর্য ধরো। দুটি দিনই তোমার জন্য পরীক্ষার।
৯. নারীজাতি মহান রাব্বুল আলামীনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সৃষ্টি যার মধ্যে প্রকট আবেগ দ্বারা পূর্ণ, যাদের কাঁধে রয়েছে সমাজকে শিক্ষিত এবং সামনে অগ্রসর করার দায়িত্ব।
১০. অসৎ লোক কাউকে সৎ মনে করে না। সবাইকে নিজের মতো ভাবে।
১১. গোপন কথা যতক্ষণ তোমার কাছে আছে ততোক্ষণ তোমার কাছে বন্দী কিন্তু কারোও নিকট প্রকাশ করা মাত্র তার কাছে তুমি বন্দী হয়ে গেলে।
১২. যে সম্মুখে তোমার তারিফ করে সে তোমার দুশমন।
১৩. লোকের যেসব দোষ ত্রুটির উপর আল্লাহ্ পর্দা দিয়ে রেখেছেন তা তুমি প্রকাশ করার চেষ্টা করো না।
১৪. দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল নিজেকে সংশোধন করা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ অন্যের সমালোচনা করা।
১৫. পানির মতো হও যে নিজের পথ সৃষ্টি করে নিজেই, পাথর হইয়ো না যে অন্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৬. অন্যের বদভ্যাসের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে লোকচক্ষুর অন্তরালে সেই বদভ্যাসে লিপ্ত হওয়া ব্যক্তিরা সর্বাপেক্ষা আহাম্মক ব্যক্তি।
১৭. পাঁচটি জিনিস খুব খারাপ:
- আলেমের খারাপ কাজ।
- শাসকের লালসাবৃত্তি।
- বৃদ্ধের জেনাকারীতা।
- ধনীর কৃপণতা।
- নারীর নির্লজ্জতা।
মুসলিম জগতে ইসলামের চতুর্থ খলিফা এবং মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আলী ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী যা নবীজীর একটি উক্তির মাধ্যমে বুঝা যায়,
“আমি জ্ঞানের শহর হলে হযরত আলী সেই জ্ঞানের দরজা”।
হযরত আলী (রাঃ) এর শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যায় ইসলাম যুগের খলিফাদের শাসনামল। যুগে যুগে অনেক শাসক বিশ্বজুড়ে এসেছে কিন্তু ইসলামের এই চার খলিফা যে পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত বিরল।
buy terbinafine 250mg pills – buy fulvicin 250 mg pills griseofulvin for sale