সুমেরীয় সভ্যতা : পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত সভ্যতার আদিঅন্ত

0

সভ্যতার বিবর্তন ধারার ফল আজকের আধুনিক সভ্যতা। বন্যতা থেকেই সভ্যতার শুরু, সেই বন্যতা থেকে বর্বর সভ্যতা, বর্বরতা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন শুরু করে। পৃথিবীত বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার উদ্ভব মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন। মানবগোষ্ঠী তাদের জীবনযাত্রার সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা জীবন প্রবাহের মানোন্নয়ন করতে থাকে। বিশেষ সময়-কালের পরিপ্রেক্ষিতে তা সভ্যতা নামে অভিহিত হয়।

প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা।
প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা।

প্রাচীনকালে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের সভ্যতা গড়ে উঠে। মিশিরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা,ব্যবলনীয় সভ্যতা, এসেরীয় সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, সিন্ধু, হিব্রু, গ্রীক সভ্যতা এদের মধ্যে অন্যতম। এসকল সভ্যতার একটি অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতা। সুমেরীয় সভ্যতা যেমন প্রাচীন, পুরোনো, তেমনি এ সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ও এ সভ্যতা কে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার এ সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান।

সুমেরীয় সভ্যতাঃ

বর্তমান ইরাকের টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস (তৎকালীন দজলা ও ফোরাত) নদীর মধ্যবর্তী উর্বর স্থানে সুমেরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটে। পশ্চিম এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নবপোলয়ী পর্যায় থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে প্রথম যে সভ্যতা গড়ে উঠে তাই সুমেরীয় সভ্যতা। এ জন্যই সুমেরীয় সভ্যতা কে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার স্রষ্টা বলা হয়।

অথচ ২০০০ বছরের ও বেশি সময় ধরে সুমেরীয় সভ্যতার নাম অতল গহ্বরে তলিয়ে ছিলো। ১৮৩৪ সালে প্রত্মতাত্ত্বিক গবেষকরা সর্বপ্রথম এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। অধ্যাপক ক্রামারের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ এই অধিবাসীদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। ধারণা করা হয় ৫০০০ থেকে ৪০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে সুমেরীয়দের বসতি ছিলো। তবে অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক গগবেষকরা মনে করেন এখানে সভ্যতার সূচনা হয় ৪০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে এবং এ সভ্যতা ধ্বংস হয় ২৪০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে।

ধর্ম, আইন, লিখনপদ্ধতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় এ সভ্যতা বেশ কিছু অবদান রাখে, যা পরবর্তী অনেক সভ্যতা এ সুমেরীয় সভ্যতাকে অনুকরণ করে তাদের মানোন্নয়ন করে।

সুমেরীয় আদি বাসস্থানঃ

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গবেষণা করে যেটুকু তথ্য জানা যায়, তাতে অধিকাংশই একমত হয়েছেন সুমেরীয়দের আদি বাসস্থান সুমের ছিলোনা। তাদের অনেকের মতে, সুমেরীয়দের একটি দল ৪০০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের দিকে উত্তর পূর্বাঞ্চল বিশেষত এলামের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উর্বর ভূমির দিকে অগ্রসর হয়েছিলো।

সুমেরীয়দের সুমেরে আগমণের পথ
সুমেরীয়দের সুমেরে আগমণের পথ।

মূলত উৎস ভূমিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুমেরীয়দের এক গোষ্ঠী উর্বর কৃষি ভূমির সন্ধ্যানে অগ্রসর হয়ে মেসোপোটেমিয়া এসেছিলো। কৃষিকাজের সুযোগ সুবিধা থাকায় এরা মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণের নিন্মাঞ্চলে বসতি গড়ে তুলে। এ উর্বর ভূমিতে কৃষির উপর ভিত্তি করে প্রাচীনকালে অনেক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। সুমেরীয়দের নামানুসারে এ অঞ্চল সুমের নামে পরিচিত ছিলো।

সুমেরীয় সভ্যতার অবদানঃ

সভ্যতার প্রাথমিক ধারণা শুরু হয় মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী সুমেরীয়দের থেকে। উর্বর কৃষি ভূমিতে এসে জীবন যাপনের সাথে সাথে জীবনের প্রয়োজনে অনেক কিছু অর্জন, নতুনত্ব সৃষ্টির প্রয়োজন হয়েছে। এছাড়া সুমেরীয়দের আবিষ্কারের মধ্যে থেকেই সভ্যতার এক অনন্য ধারা শুরু হয়।

লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারঃ

সুমেরীয় সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তাদের লিখনপদ্ধতি আবিষ্কার। লিখিতভাবে পাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ভাষা সুমেরীয় ভাষা। এ লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারের পুর্বে মিশরের সুমেরীয় লেখন ধারণা ছিলো চিত্রভিত্তিক। চিত্রভিত্তিক লিখনপদ্ধতি অনেক কষ্টসধ্য ছিলো। গবেষণা থেকে জানা যায়, লিপিতে পাওয়া সুমেরীয় ভাষা খৃষ্ট পূর্ব ৫১০০ থেকে ৪৯০০ এর মধ্যে লিখা হয়েছিলো। সুমেরীয় ভাষাতেই পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্যিক কাহিনী ‘গিলগামেশ’ রচনা হয়েছিলো।

প্রস্তর খণ্ডে সুমেরীয় ভাষায় লেখা।
প্রস্তর খণ্ডে সুমেরীয় ভাষায় লেখা।

সুমেরীয় লিখনপদ্ধতি কিউনিফর্ম নামে পরিচিত। CUNIFORM শব্দের অর্থ গোঁজ আকৃতির। মাটির তৈরি শ্লেটে খাগের কলম দিয়ে কৌণিক কিছু রেখা ফুটিয়ে তুলে চিহ্নের মাধ্যমে ভাষা প্রকাশ করতো বলে একে কিউনিফর্ম বলা হয়। সুমেরীয় ভাষা, সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায়, সুমেরীয় তাদের ভাষা লিখে প্রকাশ করার যে লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে তা ছিলো শব্দ নির্ভর। যেখানে তারা একটি চিহ্নের মাধ্যমে একটি শব্দ প্রকাশ করতো। পরবর্তীতে দেখা যায়, একটি চিহ্ন দিয়ে একটি শব্দ নয়, শব্দাংশ প্রকাশ করতো। তাদের প্রচলিত ভাষার নামেই শব্দের এ বৈশিষ্ঠ লক্ষ করা যায়। সুমেরীয় তাদের নিজেদের ভাষা কে বলতো ‘এমে.ঙির’। ‘এমে.ঙির’ শব্দের অর্থ স্থানীয় ভাষা। এখানে ডট দিয়ে দুটি শব্দকে যোগ করে এক শব্দ তৈরি করা হয়েছে।

সুমেরীয় লিখনপদ্ধতি পরবর্তীতে আক্কাদিয়ান সভ্যতা গ্রহণ করে। শব্দাংশ নির্ভর বলে এ লিখনপদ্ধতি ব্যাবহার করে ভাষা প্রকাশ করা সহজ ছিলো। বর্তমান বিশ্বের চীন ও জাপানের ভাষা এখনো অনেকটা সুমেরীয় লিখনপদ্ধতির গঠনের মত।

সুমেরীয় সভ্যতার সর্বত্র লিখনপদ্ধতির ব্যাবহার হয়েছে। তারা লিখন প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর এসব মাটির চাকতিগুলো রোদে অথবা আগুনে পুড়ে সংরক্ষণ করতো। পরবর্তীতে এ সভ্যতার প্রায় ৫০০০০ মাটির চাকতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সুমেরীয় ভাষায় ৫০০ এরও বেশি সাংকেতিক চিহ্ন ছিলো। এ জন্য এ লিখন পদ্ধতি সহজে সকলে শিখতে পারতোনা। ফলে শিক্ষা দীক্ষা সার্বজনীন না হয়ে পুরোহীত, কেরানি এদের দখলে ছিলো। সুমেরীয় সভ্যতার উরুকের জেমদাত এর নসর স্তরে এ লিখন পদ্ধতির নমুনা আবিষ্কৃত হয়। এ সভ্যতা তাদের কিউনিফর্ম লিখন পদ্ধতিতে উদ্ভাবনীর পরিচয় দিলেও তারা কোন বর্ণমালা আবিষ্কার করতে পারেনি।

সুমেরীয় সাহিত্যঃ

সুমেরীয় পৌরাণিক কাহিনী, স্তবগান, শোকগাথা ও সমসাময়িক ঘটনাবলীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুমেরীয় দের মধ্যেও সাহিত্য চর্চা ছিলো। তাদের লিখনপদ্ধতির মাধ্যতে তারা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলো বলে তাদের সাহিত্যের কিছু অংশ হলেও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সুমেরীয় গিলগামেশ মহাকাব্যের কাহিনী কে ব্যবলনীয়রা সাহিত্যকর্ম হিসেবে গ্রহণ করে ও গিলগামেশের অনুবাদ করে। এ কাব্যটি হেনরি লেয়ার্ড আসুরবানিপালের বিখ্যাত গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে জর্জ স্মিথ এ কাব্যের অনুবাদ করেন। সুমেরীয় সভ্যতার বড় অংশই এখনো পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি, এগুলো পাঠোদ্ধার হলে এ সভ্যতার সাহিত্য প্রতিভার আরো নতুন নতুন দিক আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।

সুমেরীয় ধর্মঃ

অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতার ধর্মের মত সুমেরীয়রা বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি সহ প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতো। তাই প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা তাদের দেব দেবী হিসেবে পূজা করতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো তাদের দেব-দেবী স্বতন্ত্র মানবীয় গুণাবলি দ্বারা বৈশিষ্ঠমণ্ডিত। তাদের ধারণা ছিলো, দেব-দেবীদের সেবা করার জন্যই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। শামাশ, এনলিল, ইশতার, নারগল, এনকি এরা ছিলো তাদের প্রধান দেব-দেবী।

সুমেরীয় উপাসক।
সুমেরীয় উপাসক।

সুমেরীয় দের প্রাচীন দেবতার নাম শামাস। তিনি মানুষের উপকার করতে উত্তাপ ও আলো দিতে পারেন। আবার ইচ্ছে করলে অধিক সূর্যতাপ দিয়ে মাটি পুড়িয়ে ফেলতে কিংবা কচি ঘাস মেরে ফেলতে পারতেন। এনলিল বৃষ্টি, বায়ু ও প্লাবনের দেবতা। ইশতার প্রেম ও উর্বরতার দেবী। নারগাল প্লেগ রোগের দেবতা। এনকি পানির দেবতা। এনকি আবার ইয়া নামেও পরিচিত ছিলো। এসব দেব-দেবী সূর্য দেবতা শামাশের মত ভালো মন্দ উভয়ই করতে পারতো বলে সুমেরীয়রা মনে করতো।

সুমেরীয়দের মধ্যে এছাড়াও নগর রাষ্ট্র ভিত্তিক ও দেব-দেবী ছিলো। যেমন উরুক নগরীর দেবী ছিলেন ইনিনি। কিশ ও নাগাস এর দেবতা ছিলেন বিষাদের দেবী নিনকারগাস।

জিগুরাট মন্দিরঃ

প্রত্যেক নগর রাষ্ট্রের একটি কেন্দ্রীয় মন্দির ছিলো। নগর রাষ্ট্রের প্রধান ধর্ম মন্দিরকে জিগুরাট বলা হতো। অধিকাংশ দেবতাই মন্দিরে অবস্থান করতেন। উর নগরীতে নির্মিত জিগুরাট মন্দির টি সুমেরীয় স্থাপত্যশিল্পের উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এটি উপাসনালয়ের পাশাপাশি একাধারে সেনা ছাউনি, কোষাগার, সচিবালয় হিসেবে ব্যাবহার হতো।

জিগুরাট মন্দিরের প্রতিলিপি।
জিগুরাট মন্দিরের প্রতিলিপি।

দেয়ালঘেরা কমপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলে ছিলো মন্দির। বেশিরভাগ মন্দিরের বৈশিষ্ট্য একই ছিলো। মন্দিরের প্রধান পাতেশী ছিলেন পুরোহিত রাজা। মন্দিরগুলো কেন্দ্র করে নগরের সামাজিক, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালিত হতো।

সুমেরীয় আইনঃ

আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সুমেরীদের অবদান ছিলো। স্থানীয় ঐতিহ্য, প্রথা, সেমেটিক গোষ্ঠীর রীতিনীতির সমন্বয়ে আইন প্রণীত হতো। রাজা ডুঙ্গি শুধু সমস্ত সুমেরীয় কে একত্রিত করে নগর রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করেন নি, বরং সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আইনগুলো সঠিক ভাবে সংকলনও করেন। যদিও সুমেরীয় সুসভ্য জাতি হলেও সুসংহত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি ছিলো এই সভ্যতা। প্রাচীর বেষ্টির এসব নগর ছিলো সম্পূর্ণ স্বাধীন। পরবর্তী ব্যাবিলনীয়, এসেরিয় ক্যালেডিয় এবং হিব্রু আইন সুমেরীয় আইনের ভিত্তিতে প্রণীত হয়। বিখ্যাত আইন গ্রন্থ হাম্বুরাবীর আইন সংকলন সুমেরীয় আইনের একটি উন্নত ও সংশোধিত সংস্করণ মাত্র।

অন্যান্য অবদানঃ

লিখনপদ্ধতি আবিষ্কার সুমেরীয়দের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। সুমেরীয়রা সর্বপ্রথম বছরকে ১২ মাসে, দিন-রাত্রিকে ঘন্টায় এবং ঘন্টাকে মিনিটে বিভক্ত করেছিলো। পানি ঘড়ি ও স্বর্ণ ঘড়ির আবিষ্কার সুমেরীয়দের দিন ও রাত্রির সময় নিরূপণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যা তাদের জীবনযাত্রার মান সহজ করে তুলে। সুমেরীয়রা সর্বপ্রথম ২৪ ঘন্টায় ১ দিন ও ৭ দিনে ১ সপ্তাহ নিয়ম প্রব্বর্তন করে। এছাড়াও সুমেরীয়রা জ্ঞান বিজ্ঞানে, শিল্পকলায়, স্থাপত্যবিদ্যায় অবদান রাখেন। এ প্রাচীন সভ্যতার অনেক তথ্যই এখনো অজানা রয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা গুলো  সঠিকভাবে বিস্তারিত জানার জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রতিনিয়ত গবেষনা করে যাচ্ছেন।

Source Featured Image
Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More