প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূলপর্বে উঠেছে, সেই সঙ্গে জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে ওঠার রেকর্ড গড়েছে দেশটি। এমনি নানা সাফল্যের মাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে ইউরোপের এই ছোট রাষ্ট্র আইসল্যান্ড।
‘আইসল্যান্ড’ শব্দটি শোনামাত্রই মাথায় বরফে আচ্ছন্ন এক দৃশ্য ফুটে ওঠে। হয়তো যখন আপনি এই আর্টিকেলটির টাইটেল পড়ছেন তখনও সেরকম কিছুই মাথায় এসেছে। তবে বাস্তবে কিন্তু মোটেও তা নয়;বরং দেশটি নামে বরফে আবৃত ঠান্ডা কোনো জায়গা মনে হলেও দেশটি আসলে প্রাকৃতিক রুপে পরিপূর্ণ। কম্পিউটার বা মোবাইল স্ক্রিনে ওয়ালপেপার হিসেবে যে নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য আমরা দেখতে পাই, দেশটি যেন এরই এক বাস্তবিক রুপ । তো চলুন একনজরে দেখে নেয়া যাক আইসল্যান্ড সম্পর্কে জানা-অজানা এবং মজার কিছু তথ্য –
১. দেশটিতে কেবল ৩ লাখ ৩২ হাজার মানুষের বসবাস এখানে। এর মধ্যে প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক মানুষ আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক বা এর আশেপাশের এলাকায় থাকে।
২. প্রায় ১০০০ বছর আগে খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে ভাইকিং অভিযানকারীরা আইসল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে। আইসল্যান্ডবাসী তাদের ভাইকিং ঐতিহ্য নিয়ে বেশ গর্ব করে।
৩. বহু গ্রামীণ আইসল্যান্ডীয় অধিবাসী প্রাচীন নরওয়েজীয় পূরাণের নানা দৈত্য-দানব যেমন পরী, ট্রোল, ইত্যাদির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও সত্য।
৪. আইসল্যান্ডের রিকজাভিক বিশ্বের সার্বভৌম রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তরপশ্চিম-তম শহর।
৫. আইসল্যান্ডের পানি এতটাই বিশুদ্ধ যে কোনো প্রকার বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া ছাড়াই পানি প্রত্যেক ঘরে ঘরে সরবরাহ করা হয়।
৬. শীতের দিনে গোসল করার জন্য গরম পানি থেকে উত্তম আর কিছুই নেই। তবে আইসল্যান্ডে কিন্তু পানি গরম করার জন্য গ্যাসে ফুটোনো বা যন্ত্র ব্যাবহারের প্রয়োজন হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই এই দেশে গরম ও ঠান্ডা উভয় ধরনের পানি পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক গিজার বা হট স্প্রিং শহরের প্রায় প্রতি বাড়িতেই আছে।
৭. অনেকেরই ধারণা, আইসল্যান্ড এর আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা যেমনটি এর নাম শুনে মনে হয়। তবে বাস্তবে তা মোটেও সঠিক নয়। দেশটির আবহাওয়া মাঝারি ধরনের অর্থাৎ বেশি গরমও নয় আবার বেশি ঠান্ডাও নয়। ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত উত্তরে সুমেরুর কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উষ্ণ উপসাগরীয় সমুদ্রস্রোতের কারণে এখানকার জলবায়ু তুলনামূলকভাবে মৃদু।
৮. আইসল্যান্ডের আয়তন প্রায় ৩৯ হাজার বর্গ মাইল। যা প্রায় বাংলাদেশের আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ সমান।
৯. গড়ে প্রতি ৪ বছরে একবার আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়।
১০. আইসল্যান্ড একটি রুক্ষ দেশ। এখানে গাছের পরিমাণ খুবই কম, কোনো বন নেই। এর কারণ দ্বীপের তিন-চতুর্থাংশই উদ্ভিদ জন্মানোর অযোগ্য।
১১. ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আইসল্যান্ডে ‘বিয়ার’ অবৈধ ছিল। বিয়ার হচ্ছে এক ধরণের এলকোহোলিক বেভারেজ।
১২. ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘ কর্ম সপ্তাহ পালন হয় আইসল্যান্ডে। সপ্তাহে ৪৩.৫ ঘন্টা কাজ করে থাকে এরা।
১৩. প্রাচীন নরওয়ে দেশের ভাষা থেকে আইসল্যান্ডের ভাষার উৎপত্তি। মজার ব্যাপার হলো, প্রায় ১০০০ বছর পরও বর্তমানে তাদের ভাষা কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ অনায়াসে তারা হাজার বছর পুরোনো ভাষা পড়তে পারে কেননা ভাইকিংদের মুখের প্রাচীন নর্স ভাষার সাথে আইসল্যান্ডীয় ভাষার পার্থক্য খুবই কম।
১৪. আইসল্যান্ডে শিশুদের নিয়মিত ঘরের বাইরে ঘুমাতে দেয়া হয়। এর কারণ হলো ঘরের ভিতরের বায়ু সঞ্চালন অতটা ভালো নয় এবং ঘনবসতি বেশি হওয়ার শিশু জন্য পরিবেশ বেশ হুমকিস্বরুপ ।
১৫. আইসল্যান্ডীয়দের বংশনাম বাবার শেষ নামে দিয়ে হয় না, নিয়ম কিছুটা ভিন্ন। যেমন – ধরি, জন ইনারসসন নামের একজন ব্যক্তির ছেলে ওলফুর । পিতার নাম অনুযায়ী ওলফুরের শেষ নাম ইনারসসন হওয়ার কথা কিন্তু তা হবে জনসসন। অর্থাৎ বাবার প্রথম নাম হবে ছেলের উপাধি। জনসসন মানে হলো জন এর সন বা ছেলে। মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই।
১৬. তিমি মাছ প্রদর্শনীতে আইসল্যান্ড বিখ্যাত। এর থেকে সরকারি খাতে মোটা অংকের রাজস্বও যোগ হয়ে থাকে।
১৭. আইসল্যান্ডের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন মহিলা। তিনি সমকামী ছিলেন তবে তিনি তা গোপন করেননি।
১৮. অন্য যেকোনো দেশের থেকে এখানে প্রতি জনের মাথাপিছু কোকা-কোলা ক্রয় বেশি। বলাই যায়, আইসল্যান্ডীয়রা কোকা-কোলা প্রেমিক।
১৯. বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট (জাতিসংঘ প্রকাশিত) অনুযায়ী, আইসল্যান্ড পৃথিবীর তৃতীয়-সুখী দেশ।
২০. সারাবিশ্বে বিখ্যাত খাবারের রেস্তোরা ম্যাকডোনাল্ড’স। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই এর শাখা রয়েছে। তবে
আইসল্যান্ডে কোনো ম্যাকডোনাল্ড’স নেই।
২১. আইসল্যান্ডের প্রায় ৮৫ শতাংশ শক্তি নবায়নযোগ্য। অর্থাৎ জলবিদ্যুৎ শক্তি বা ভূতাত্ত্বিক জল সংরক্ষণ দ্বারা আইসল্যান্ডের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হয়।
২২. ২০১০ সালের এক গবেষণা বলা হয়েছে, আইসল্যান্ডের প্রায় ৯৭.৬% মানুষ ইন্টারনেট ব্যাবহার করে।
২৩. আইসল্যান্ডীয়রা হলো বই পোকা। এক জরিপে বলা হয়েছে, আইসল্যান্ডের ১০% মানুষ তাদের জীবনকালে একটি হলেও বই প্রকাশ করে। আইসল্যান্ডে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বই এবং পত্রিকা প্রকাশনী রয়েছে।
২৪. ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত রিকজাভিকে (আইসল্যান্ডের রাজধানী) কুকুরের মালিকানা নিষিদ্ধ ছিল। তবে পরবর্তীতে তা বাদ দেয়া হয়।
২৫. আইসল্যান্ডের পুলিশ তাদের সাথে অস্ত্র হিসেবে বন্দুক বহন করে না। এর কারণ সেখানে অপরাধ খুব কম হয় এবং বড় ধরনের কোনো অপরাধ প্রায় অস্তিত্বহীন।
২৬. আইসল্যান্ড দেশটি এতটাই পরিষ্কার যে সেখানে কোনো মশা নেই। কেবল মশা নয়, মানুষের সমস্যা সৃষ্টিকারী এমন পোকা-মাকড় এর সংখ্যা অনেক কম।
২৭. আইসল্যান্ডে সাপ, টিকটিকি বা কচ্ছপ পোষা তাদের আইনের বিরুদ্ধে।
২৮. দেশেটির জাতীয় ক্রীড়া হলো হ্যান্ডবল।
২৯. আইসল্যান্ডে কোনো সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনী নেই।
৩০. আইসল্যান্ড পৃথিবীর ১৮ তম বৃহত্তম দ্বীপ এবং ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ।
৩১. এটি বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। প্রায় ১০০০ বছর আগে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
৩২. দেশটি উত্তর আটলান্টিক এবং আর্কটিক মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত। তাই এখানে শীতকালীন রাত এবং গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘ হয়।
৩৩. আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক শহরে একটি যাদুঘর আছে যাকে লিঙ্গ যাদুঘর বলা হয়। অর্থাৎ এখানে প্রদর্শনী হিসেবে আছে বিভিন্ন প্রানীর লিঙ্গ। এখানে প্রায় ২০০ এর বেশি স্তন্যপায়ী প্রানীর লিঙ্গ আছে এবং এর মধ্যে একজন মানুষেরও আছে।
৩৪. আইসল্যান্ডের সংসদ ৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সংসদ এর মধ্যে একটি ।
৩৫. আইসল্যান্ডবাসী আইসক্রিম খেতে বেশ পছন্দ করে। এমনকি শীতের সময়ও তারা আইসক্রিম খেয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেনো।
৩৬. আর্কটিক ফক্স হলো আইসল্যান্ডের একমাত্র স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রানী।
৩৭. আইসল্যান্ডে কোন ধরণের রেলওয়ে সিস্টেম নেই।
৩৮. মজার ব্যাপার হলো, এখানে মানুষ থেকে ভেড়ার সংখ্যা দ্বিগুণ।
৩৯. আইসল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো ‘হট ডগ’। রেস্টুরেন্ট,গ্যাস স্টেশন কিংবা রাস্তার পাশের স্টপ যেখানেই হোক না কেনো এটি সর্বত্র পাওয়া যায়।
৪০. ‘Hákarl’ যার অর্থ হলো পচে যাওয়া হাঙ্গর। এটি আইসল্যান্ডের জাতীয় খাবার।
তথ্যসূত্র: Island monitor, landlopers,
BuzzFeed, Wikipedia, and youtube