১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ (শেষ পর্ব)

0

দ্বিতীয় পর্বের পর – যুদ্ধ মানেই সভ্যতার রক্তাক্ত দেহের উপর মৃত্যুর তাণ্ডব নৃত্য নয়। প্রতিটি যুদ্ধের পিছনেই রয়েছে জটিল প্রেক্ষাপট ও সামনে রয়েছে সুদূরপসারী ফলাফল। মানব ইতিহাসের অসংখ্য যুদ্ধের মধ্যে ১৯৬২ সালের ২০শে অক্টোবর থেকে ২১শে নভেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া চীন-ভারত যুদ্ধ আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য হলেও তার ছায়া একবিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ এশীয় এবং বৃহদার্থে এশীয় ভূরাজনৈতিক সমীকরণে খুব স্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়।

সহজ ভাষায় ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের নেপথ্যে প্রধান কারণ ছিল বিবাদপূর্ণ সীমান্ত। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী ‘ডুরান্ড রেখা’ হোক কিংবা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যবর্তী ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ হোক বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব বিবাদপূর্ণ সীমান্তের বিবাদের সূত্রপাত সেই ব্রিটিশ শাসনামলে। ব্রিটিশরা তাদের সুবিধা মত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সীমারেখা ব্যাবহার করেছে। কিন্তু ব্রিটিশরা চলে গেলেও রয়ে যায় তাদের সৃষ্ট সীমান্তবিভ্রাট। ব্রিটিশদের হাত থেকে নব্য স্বাধীন দেশগুলো নিজ সুবিধামত সীমানাকে বৈধ হিসেবে দাবি করে এসেছে। যেমন চীন-ভারত সীমান্তের ওয়েস্টার্ন থিয়েটারে ভারত জনসন রেখাকে এবং চীন ম্যাকার্থি-ম্যাকডোনাল্ড রেখাকে বৈধ হিসেবে দাবি করে। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে স্বীয় দাবীকৃত রেখায় প্রতি দেশের নিজ অংশে অধিক অঞ্চল পরে।

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ
Source: globalaffairspressdotcom.wordpress.com

কিন্তু একটু গভীরে ঢুকলেই দেখা যাবে যে, চীন-ভারত যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিল অদূরদর্শী ভারতীয় নেতৃত্ব, সুনির্ধারিত নীতিমালার অভাব এবং ভারতের প্ররোচনামূলক পদক্ষেপ। বসবাস-অযোগ্য সুউচ্চ মরুভূমি আকসাই চিন ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক কিংবা ভৌগলিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারতের অংশ ছিল না। তাছাড়া এই স্থানটির কোন কৌশলগত তাৎপর্যও ভারতের কাছে ছিল না। অপরদিকে চীনের কাছে জিনজিয়াং ও তিব্বতের মধ্যে যোগাযোগের জন্য আকসাই চিন ছিল অপরিহার্য। ভারতের কাছে সুযোগ ছিল আলোচনার মাধ্যমে আকসাই চিনে কিছুটা আপস করে চীনের সাথে বিরাজমান সকল সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্যার শান্তিপূ্র্ণ সমাধানের। কিন্তু সেসময় চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং উভয় বিশ্ব পরাশক্তির সাথে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক নেহেরুকে এক মারাত্মক জুয়ায় মেতে ওঠার সাহস জোগায়। সম্মুখ নীতি ছিল তাঁর অর্বাচীন স্পর্ধার চরম পরিচায়ক। স্পষ্টতই শত্রুর সংকল্প নিয়ে তাঁর যতটা সন্দেহ ছিল, মিত্রের আশ্বাসের উপর তাঁর ততটাই আস্থা ছিল।

যুদ্ধের উস্কানি দেওয়া যতটা না নীচতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি না নেওয়া ততোধিক নির্বুদ্ধিতা। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারত দুটি কাজই যথেষ্ট পারদর্শীতার সাথে করতে সফল হয়। ১৯৫৯ সালে দালাইলামাকে রাজনৈতিক আশ্রয়দান এবং সম্মুখনীতির অংশ হিসেবে বারবার সীমানা লঙ্ঘনের মত পদক্ষেপ ছিল চীনের ধৈর্য ও শক্তি পরীক্ষার প্রয়াস। তবে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মৈত্রীতার মোহে এতটাই মোহাচ্ছন্ন ছিল যে চীনের সাথে সম্মুখ সমরের যেকোন সম্ভাবনাই তারা বাতিল করে দেয়। তাদের অন্ধ বিশ্বাস ছিল ভারতকে আক্রমণের স্পর্ধা কখনো চীনের হবে না, কেননা তখন উভয় বিশ্ব পরাশক্তির সাথেই চীনের সম্পর্ক ছিল বেজায় খারাপ।

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ
Source: Reuters India

কিন্তু ১৯৬২ সালের ১৬ই অক্টোবর শুরু হয়ে ২৮শে অক্টোবর পর্যন্ত চলা কিউবান মিসাইল সংকট সকল সমীকরণ পালটে দেয়। চীনের চতুর নেতা মাও জেডং তার সমাজতান্ত্রিক বন্ধুদের সাথে সখ্যতার খাতিরে অনেক আগেই কিউবাকে ঘিরে একটি ভয়াবহ সংকটের আভাস পেয়েছিলেন। তিনি সে অনুযায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। তিনি জানতেন এরূপ সংকটময় সময়ে দূর প্রাচ্যের কোন ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাবার ফুরসত যুক্তরাষ্ট্র বা সোভিয়েত ইউনিয়নের হবে না। তিনি পরিকল্পনা করেন ভারতকে আকস্মিক তীব্র আক্রমণের মাধ্যমে দ্রুত ভৌগলিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করে মিসাইল সংকট শেষ হবার আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। অপরদিকে ভারতীয়রা যতক্ষণে বুঝতে পারে চীনের প্রকৃত অভিসন্ধি কি ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। সীমান্তে অপ্রস্তুত ভারতীয়দের উপর আকস্মিক চৈনিক হামলায় একের পর এক ভারত নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল চীনের হাতে চলে যেতে থাকে। হিমালয়ের প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করবার মত প্রশিক্ষণ কিংবা প্রস্তুতি কোনটিই ভারতীয় সৈন্যদের ছিল না। একই সাথে দুই শত্রু- চীন এবং হিমালয়ের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হচ্ছিল। ভারতীয়দের কাছে সর্বোত্তম পন্থা ছিল অগ্রসরমান চৈনিকদের উপর বিমান হামলা। কিন্তু মার্কিনীদের উপদেশে চৈনিকদের পাল্টা বিমান আক্রমণের ভয়ে ভারত বিমান বাহিনী ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে সিআইএ কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে সেসময় চৈনিক বিমানবাহিনীর ভারতের উপর হামলা করার মত সামর্থ্য ছিল না। ভারতের পক্ষে বিমান হামলা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত। এসময় নেহেরু মরিয়া হয়ে কেনেডির কাছে ১২ স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান ও একটি আধুনিক রাডার ব্যবস্থা চেয়ে দুটি চিঠি লেখেন। কিন্তু কিউবান মিসাইল সংকট নিয়ে ব্যস্ত কেনেডি প্রশাসন এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস কিটি হক(USS Kitty Hawk) বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু কৌশলী চীন সময়মমত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে কোন তৃতীয় শক্তির জড়িত হওয়া রোধ করে।

এই যুদ্ধ মোকাবিলায় ভারত শুধু সামরিক ভাবেই ব্যর্থ হয়নি, রাজনৈতিক ভাবেও ব্যর্থ হয়। কিভাবে শত্রুর মোকাবিলা করা যায় তার পরিকল্পনা না করে ভারতীয় রাজনীতিবিদরা একে অপরকে দোষারোপেই বেশি মেতে ছিলেন। এরূপ পরিস্থিতিতে যেখানে দ্রুত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন সেখানে তর্ক-বিতর্কের বেড়াজালে সৃষ্ট দীর্ঘসূত্রিতায় ভারত কোন পদক্ষেপই সময়মত নিতে পারেনি। নেহেরু নেতৃত্বাধীন সরকার যুদ্ধের পূর্বজ্ঞান করতে, প্রস্তুতি নিতে এবং সংকটময় সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। ভারতের গণতন্ত্রই যেন ভারতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ
Source: thehindu.com

চৈনিকরা যুদ্ধে তাদের সকল লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। পশ্চিমে আকসাই চিন সম্পূর্ণরূপে চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং তিব্বতে চীনের আধিপত্য নিয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ভারত সম্মুখনীতি পরিত্যাগ করে। যদিও চীনের ভারত আক্রমণ মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রথম বিশ্বের কাছে আর এক সমাজতান্ত্রিক আগ্রাসন হিসেবে পরিগণিত হয়, বিশ্ব দরবারে চীন আবির্ভূত হয় এক নতুন শক্তি হিসেবে।

১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজয় ভারতের সামরিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সবার সামনে তুলে ধরে। চীনের এরূপ বিশ্বাসঘাতকতায় ভারত বুঝতে পারে দক্ষিণ এশীয়ায় শুধুমাত্র পাকিস্তানই ভারতের একমাত্র শত্রু নয়। ভারতের সামরিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং সীমান্তে ঘন-ঘন অনুপ্রবেশ ও সংঘর্ষের ঘটনা বেড়ে যায়। ভারতবিরোধী চীন-পাকিস্তান জোটের উদ্ভব হয়। এখনো এই জোটের মূল ভিত্তি ভারতবিরোধীতা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় এবং তাদের ভূমিকাও হ্রাস পায়। ভারতীয় নেতৃত্বাধীন নন অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্ট(ন্যাম/NAM)-এর কা্যকারিতা নিয়েও সবার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে সব থেকে বেশি সমালোচনার শিকার হন জওহরলাল নেহরু। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভারত এবং চীন শীতল যুদ্ধের নিরপেক্ষ তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, যা পরিণত হয় তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুলে। চীনের সাথে সমস্যা সমাধানে তাঁর কোন সুনির্দিষ্ট নীতি ছিল না। তাঁর মত বিচক্ষণ ব্যক্তি কেন চৈনিক হুমকিকে গুরুত্ব দেননি তা আজও অনেকের প্রশ্ন।

এ যুদ্ধের ফলে ভারতীয়রা বুঝতে পারে যে তুখড় কূটনীতি কখনো আত্মনির্ভরশীলতার বিকল্প হতে পারে না। মূলত এই যুদ্ধের পরাজয়ের কারণেই ভারত সামরিক বাহিনীর ব্যাপক আধুনিকায়ন এবং সামরিকখাতে স্বনির্ভরশীলতার প্রয়াস শুরু করে। পরাজয়ে ভারতীয়দের মধ্যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। অনেক বিশ্লেষকের মতে, বর্তমানে যে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের সাথে আমরা পরিচিত তার ভিত নিহিত ১৯৬২ সালের যুদ্ধে।

১৯৬২ সালের যুদ্ধই মূলত আগামী কয়েক দশকে চীন ভারতের মধ্যবর্তী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। দালাই লামার অরুণাচল প্রদেশে সফর কিংবা নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপে ভারতের সদস্যপদলাভে চীনের বাধা সর্বত্রই ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের ছায়া খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More