গতপর্বে আমরা আমেরিকার ভৌগলিক আবিষ্কার ও বিদেশি শাসন বিশেষত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে প্রাসার ঘটে তা নিয়ে আলোচনা করেছি । এবং আরো দেখানো হয়েছিল যে আমেরিকার উপনিবেশসমূহ একসময় তাদের ব্রিটিশ প্রভুর শাসন শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থায় পৌঁছে যায় । এবার দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হবে যুদ্ধের প্রধান প্রধান ঘটনাগুলো নিয়ে । এবং একইসাথে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফলও তুলে ধরা হবে । এবং সবশেষে বিশ্লেষণী পার্টে দেখানো হবে যে, কেন ব্রিটেন তার অধীন আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে গেল ।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিঃ
১৭৭৪ সালে ফিলেডেলফিয়ায় এক সম্মেলনে ঔপনিবেশিক তেরটি রাজ্যের মধ্যে জর্জিয়া বাদে বারোট রাজ্য সম্মিলিত হয়ে ব্রিটিশদের কাছে নিজেদের অধিকার ও দাবী ঘোষণা করে অভিযোগের প্রতিকারের আবেদন করেন । কিন্তু আবেদনে কোন ফল না মেলায় ১৭৭৫ সালে তেরটি উপনিবেশ মিলে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । জর্জ ওয়াশিংটনকে করা হয় প্রধান সেনাপতি । এর আগে একটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন । ১৭৭৩ সালে চা আইনের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি আমেরিকায় চা রপ্তানি করে কয়েকটি জাহাজ প্রেরণ করেন । যখন বোস্টন বন্দরে চায়ের জাহাজ এসে থামে তখন কয়েকজন স্থানীয় আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানের ছদ্মবেশে জাহাজে উঠে চায়ের পেটিগুলি সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন । এই ঘটনা বোস্টন টি পার্টি নামে আজও পরিচিত।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান ঘটনাবলিঃ
১৭৭৫ সালে লেক্সিংটনে আমেরিকানরা সর্বপ্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় । এবং খুব সহজেই ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয় । আমেরিকানরা বাংকার হিল অবরোধ করলে ব্রিটিশ উইলিয়াম হো তা সহজেই ভণ্ডুল করে দেন এবং আমেরিকানদের পরাজিত করেন । ১৭৭৬ সালে জর্জ ওয়াশিংটন পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বোস্টন থেকে ব্রিটিশদের সম্পূর্ণভাবে তাড়িয়ে ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ।
ওদিকে ব্রিটিশ সেনাপতি উইলিয়াম নিউইয়র্ক ও লং দ্বীপ দখল করে নেন । অবশ্য খুব শীঘ্রই আমেরিকানরা ব্রিটিশদের নিউইয়র্ক থেকেও তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় । ১৭৭৭ সালে নিউ জার্সিও উদ্ধার করা সম্ভব হয় । সাবাটোগাতে ব্রিটিশ সেনাপতি বারগাইন আমেরিকান সেনাপতি গেটসের কাছে বিশাল সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় । এরমধ্যেই একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে যায় । ১৭৭৭ সালে আমেরিকার সাথে ফ্রান্সের এক চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স আমেরিকাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় । তৎক্ষণাৎ ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ড এর যুদ্ধ বেধে যায় । ঠিক একই সময়ে স্পেন ফ্রান্সের সাথে মিলে পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসে । কেননা একসময় বিশাল কানাডাকে ব্রিটেন স্পেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল । স্পেন ও ফ্রান্স মিলে জিব্রাল্টার অবরোধ করলে ঠিক একই সময়ে হল্যান্ড ইংল্যান্ড এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে থাকে । ভারতবর্ষেও মারাঠা উত্থান ও মুসলিম আফগানি আহমদ শাহ আবদালী ব্রিটিশদের বিপদাপন্ন করে তোলে । সুতরাং চতুর্দিকেই ব্রিটিশরা অসহায় ও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল । তবুও ব্রিটিশরা কোনভাবেই আমেরিকার মত একটি উপনিবেশ হারাতে চাচ্ছিল না ।
১৭৮১ সালে সেনাপতি লর্ড কর্নওয়ালিসকে প্রেরণ করে ব্রিটিশরা আমেরিকায় পরপর কয়েকটি সাফল্য অর্জন করলেও একই বছরের শেষ দিকে নিউইয়র্কে কর্নওয়ালিসকে আমেরিকান ও ফ্রেন্স সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হতে হয় । নিউইয়র্ক টাউনের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত ঘটনা সংঘটিত হয় । ১৭৮৩ সালে ভার্সাই নগরে ফ্রান্স, স্পেন ও আমেরিকার সাথে ইংল্যান্ডের ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । এই সন্ধির মধ্য দিয়েই ইংল্যান্ড আমেরিকার স্বাধীনতাকে চূড়ান্তভাবে স্বীকার করে নেয় ।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফলঃ
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জয়যাত্রা, অভিজাত শ্রেণির বিশেষ সুযোগ সুবিধা রহিতকরণ, অবাধ বাণিজ্য ও পুঁজিবাদের বিকাশ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মপালনের স্বাধীনতা স্বীকৃতি, দমন-নিপীড়ন তথা শোষণ অবিচারের মূলোৎপাটনই ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফল সরূপ । এছাড়াও কয়েকটি দিকে নিয়ে আলোচনা করতে হয় –
প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমেই এই প্রথম কোন উপনিবেশ তার প্রভু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জয়লাভ করে । মূলত এখান থেকেই ব্রিটিশ আধিপত্যের ক্ষয় শুরু হয় ।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে প্রাথমিকভাবে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক সংস্কৃতি চর্চার শুরু হয় । মানবতাবাদী ভাবধারার উন্মেষ ঘটে ।
তৃতীয়ত, বলা হয়ে থাকে যে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমেই ফরাসী বিল্পব সংঘটিত হয়, যা কিনা মানব ইতিহাসে আরেকটি তাৎপর্যবাহী ঘটনা ।
চতুর্থত, আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জন অন্যান্য উপনিবেশের জন্য একধরণের প্রেরণা হিসেবে কাজ করলো । পরবর্তীতে অন্যদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ উন্মেষে এটি ব্যাপক সাহায্য করেছিল । মোটামুটি এগুলোই ছিল আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল ।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয়ের কারণঃ
১. ভৌগলিক দূরত্ব ব্রিটশদের আমেরিকা শাসনে একটি বড় বাধা হিসেবে ছিল । আর যুদ্ধের সময় ঠিকমতো রশদ ও সৈন্য সরবরাহ করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল যা ব্রিটিশরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি । ফলে যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠে । মূলত ব্রিটিশরা ভাবতেই পারেনি যে আমেরিকানরা তাদের বিরুদ্ধে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে ।
২.উপনিবেশবাসীরা যুদ্ধ করেছিল তাদের পরিচিত ভৌগলিক পরিবেশে । এর ফলে তারা কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল কিন্তু ব্রিটিশরা তেমন কোন সুবিধা তো পায়নি বরং বিভিন্ন বাধাঁয় ছিল জর্জরিত ।
৩. যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আমেরিকা যেটা ভালোভাবেই পেয়েছিল । জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন একজন চৌকস, বুদ্ধিদীপ্ত ও জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত নেতা, আর ব্রিটিশ সেনাপতিরা সেখানে ছিলেন সম্পূর্ণ পেশাদার । সুতরাং দেখা যায় যে এর ফলে জাতীয়তাবাদের কাছে সকল শক্তি ম্লান হয়ে যায় ।
৪. আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ফ্রান্স ও স্পেন প্রচণ্ড রকম সহায়তা করে । কিন্তু ব্রিটিশদের দুর্দিনে কোন বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রই এগিয়ে আসেনি । ব্রিটিশদের যে এক বনে এক বাঘ অহংকারী মনোভাব ছিল তা তখন গুড়িয়ে যায় । এরমধ্য দিয়েই স্বাধীনতা লাভ করে আমেরিকা । যা সমগ্র বিশ্বপটই পরিবর্তন করে দেয় ।
তথ্যসূত্রঃ
১. এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটিনিকা
২. আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস
৩.ফরাসী বিপ্লব;আবুল কালাম
৪.ইউরোপের ইতিহাস; দিলীপ কুমার শাহা
৫.উইকিপিডিয়া
cheap terbinafine – fluconazole 100mg tablet order grifulvin v generic