ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপ: বিশ্বসেরার মুকুট জয়ের গল্প

3

পুসকাসের হাংগেরি কিংবা জিকো-সক্রেটিসের ব্রাজিল-যাদের বলা হয় বিশ্বকাপ ফুটবল  ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ফুটবল দল। ফুটবল ইতিহাসের সেরা দল বিবেচনায় এই দলের সাথে আরও কয়েকটি নাম উঠে আসবে, যাদের মধ্যে ২০০২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দল অন্যতম। ২০০২ এর ব্রাজিলের সাথে পুসকাসের হাংগেরি কিংবা জিকোর ব্রাজিলের পার্থক্য হচ্ছে সফলতার মাপকাঠি তে। সবগুলো দলই ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল ছিল কিন্তু বাকী দল দুটির নামের পাশে ব্যর্থতার সিল লেগে গেলেও ২০০২ এর ব্রাজিল দল ইতিহাসকে লিখেছে নিজেদের মতো করে। “শক্তিশালী, সুন্দর এবং সফল” এই তিনটি তকমা একসাথে ধারণ করা যায় না, এই প্রচলিত কথাটিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই দলটি হয়েছিলো বিশ্বসেরা। সাথে মন জয় করে নিয়েছিলো হাজারো ফুটবল ভক্তদের।

এই দলটিকে বিশেষায়িত করতে চাইলে আপনাকে নতুন করে ডিকশেনারি হাতে নিয়ে বসতে হবে। যেকোনো বিশেষণই যেন তাদের জন্য কম। সুন্দর ফুটবল দিয়েও কিভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা যায়, তার অনন্য দৃষ্টান্ত এই দল। যদিও সবকিছুর সাথে আরও একটি জিনিসের সহায়তা ছাড়া সফলতা সম্ভব না। সেটি হচ্ছে ভাগ্য। নয়তো প্রায় সমশক্তির দল নিয়েও ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপে সফল হতে পারেনি ব্রাজিল। দোষ টা কি শুধুই ভাগ্যের? নাকি অন্য কোথাও সমস্যা ছিল?

২০০২ বিশ্বকাপ শিরোপা জয় উদযাপন করছে ব্রাজিল ফুটবল দল
২০০২ বিশ্বকাপ শিরোপা জয় উদযাপন করছে ব্রাজিল ফুটবল দল Source: Bukalapak

গল্পটা অবশ্য এতোটা সুন্দরভাবে শুরু হয় নি। বিশ্বকাপের আগে এই দলটিকে ভুগতে হয়েছিলো বাছাইপর্ব পাড় করার সময়। তারকা সমৃদ্ধ দলটিই হোঁচট খাচ্ছিল একের পর এক। মূল দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু খেলোয়াড় ইনজুরি আক্রান্ত থাকায় এবং সাথে কিছু খেলোয়াড়ের অফ ফর্মের কারণে বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যাবার অবস্থা হয়েছিলো দলটির। এমন অবস্থায় দলের দায়িত্ব নেন ফিলিপ স্কলারি। ধুঁকতে থাকা দলটিকে ট্র্যাকে আনতে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয়েছিলো তাকে। খুব বেশী সুবিধা করতে না পারলেও দল মোটামুটি দাঁড়িয়ে যায়। বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে তারা।

ব্রাজিল বিশকাপ ২০০২ স্কোয়াড (fifa.com)
ব্রাজিল বিশকাপ ২০০২ স্কোয়াড (fifa.com)

স্কোয়াড:

গোলকিপার:

মার্কোস

দিদা

রজারিও সেনি

ডিফেন্ডার:

কাফু

লুসিও

রকি জুনিয়র

রবার্তো কার্লোস

এডমিলসন

জুলিয়ানো বেলেত্তি

এন্ডারসন পলগা

জুনিয়র

মিডফিল্ডার:

রিকার্দিনহো

গিলবার্তো সিলভা

রোনালদিনহো

কাকা

জুনিনহো

রিভালদো

ক্লেবারসন

ভামপেতা

ফরওয়ার্ড:

রোনালদো

ডেনিলসন

এডিলসন

লুজিয়াও

কোচ: লুইজ ফিলিপ স্কলারি

ফর্মেশনঃ

খাতা কলমে দেখে ব্রাজিলের ফর্মেশন ৪-৩-৩ মনে হলেও, আদতে তা ছিল না। মাঠে তাদের ফর্মেশনটা কিছুটা চেঞ্জ হয়ে ৩-৫-২ তে রূপ নিতো। কেননা দুই উইং ব্যাক রবার্তো কার্লোস এবং কাফু রক্ষণের চেয়ে আক্রমণেই বেশী ব্যস্ত থাকতেন। তাদের ওভারল্যাপিং টা খুবই দরকার ছিল দলের জন্য, কারণ দলে কোন প্রকৃত উইংগার ছিল না। তাই এই রোল টা তারাই কাভার দিতো। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে লুসিও এবং রকি জুনিয়র থাকতেন, তাদের সামান্য একটু উপরে থেকে এডমিলসন ডিফেন্স কে পরিপূর্ণতা দিতেন দুই উইংব্যাকের অভাব পূরণ করে। হোল্ডিং মিডফিল্ডার হলেও ডিফেন্সেই বেশী সাপোর্ট দিতেন তিনি। মাঝমাঠ সামলাতেন গিলবার্তো সিলভা এবং জুনিনহো। মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ রেখে আক্রমণে বল সাপ্লাই দেয়াই ছিল তাদের মূল দায়িত্ব। আক্রমণ সামলাতেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা ত্রয়ী রোনালদো, রিভালদো এবং তরুণ রোনালদিনহো। আক্রমণে সৃজনশীলতা আনা সহ, চান্স ক্রিয়েশনের মূল কাজটা করতেন রোনালদিনহো। আর উপরে থেকে প্রতিপক্ষের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিতেন রিভালদো আর রোনালদো লিমা। দুইজনের সম্মিলিত ১৪ গোলই বলে দেয় কতো টা ভয়ংকর জুটি ছিল তাদের। দলের প্রত্যেকের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়া, কোচের অসাধারণ ট্যাকটিক্স সব মিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য ব্রাজিল দল সব ম্যাচ জিতার মাধ্যমে শিরোপা জিতে নেয় স্বাভাবিকভাবেই।

ব্রাজিল ২০০২ বিশ্বকাপের ফর্মেশন
ব্রাজিল ২০০২ বিশ্বকাপের ফর্মেশন (lineup11)

২০০২ ফুটবল বিশ্বকাপ ছিল টুর্নামেন্টটির ১৭তম আসর। প্রথমবারের মতো এশিয়া মহাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া আসরটি হোস্ট করেছিলো যৌথভাবে জাপান এবং কোরিয়া। আসরটি প্রথম থেকেই বিস্ময় উপহার দিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৯৮ ফিফা বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স এবং আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় এবং কোরিয়ার সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়া সহ আরও কিছু অবাক করার মতো ঘটনা ঘটে আসর টিতে। যদিও কিছু ম্যাচে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে সমালোচনার স্বীকার হয় আসরটি। সবমিলিয়ে খুবই উপভোগ্য একটি আসর ছিল এটি।

গ্রুপ পর্ব:

গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ছিল তুরস্ক, চীন এবং কোস্টারিকা। শক্তিমত্তার বিবেচনায় ব্রাজিলের জন্য সহজ গ্রুপ হলেও, টুর্নামেন্টের আগে ভুগতে থাকা ব্রাজিলের জন্য গ্রুপ পর্বই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

প্রথম ম্যাচ ছিল টুর্নামেন্টে চমক জাগানো তুরস্কের সাথে। সাধারণ মানের একটি দল নিয়েও কতোটা অসাধারণ খেলা সম্ভব তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই দলটি। শক্তিশালী ব্রাজিলের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছিলো তারা। অবশ্য ফল পেতে দেরীও হয় নি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ম্যাচের ৪৫ মিনিটে গোল করে দলকে লিড এনে দেন হাসান সাস। গোল শোধ দিতে দেরী করেনি ব্রাজিল। পাঁচ মিনিট পরেই রোনালদো লিমার গোলে সমতায় ফেরে ব্রাজিল। অনেক চেষ্টা করেও জয়সূচক গোলের দেখা পাচ্ছিলো না সেলেকাও রা। ম্যাচ যখন শেষ হবার পথে, তখনই ম্যাচে ৮৬ মিনিটের সময় ডি বক্সের বাইরে লুইজাওকে ফাউল করার জন্য বিতর্কিত পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দেন রেফারী। স্পট কিক থেকে গোল করে দলকে মূল্যবান তিন পয়েন্ট এনে দেন রিভালদো। ম্যাচ জিতলেও বিতর্কিত এই পেনাল্টি নিয়ে পরবর্তীতে জল ঘোলা হয় অনেক। ডি বক্সের বাইরে ফাউলের জন্য পেনাল্টি দেয়ায় রেফারীর বিরুদ্ধে একশন নেয়া হয়। এছাড়াও অভিনয় করে তুর্কিস ডিফেন্ডার কে লাল কার্ড খাওয়ানোর জন্য জরিমানা করা হয় ব্রাজিল তারকা রিভালদো কে।

তুরস্কের বিরুদ্ধে গোল করার চেষ্টায় রোনালদো
তুরস্কের বিরুদ্ধে গোল করার চেষ্টায় রোনালদো Source : kalentri 2018

দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ চীনের বিপক্ষে। এই ম্যাচটিতেই ব্রাজিল যেন ছন্দ ফিরে পেয়েছিলো। প্রতিপক্ষ সহজ হলেও দলের কনফিডেন্স ফিরে পাবার জন্য বড় ব্যবধানের জয় দরকার ছিল তাদের। প্রথম থেকেই সেভাবে খেলতে থাকে সেলেকাও রা। রবার্তো কার্লোস গোল উৎসব শুরু করেন এবং সেটা শেষ করেন রোনালদো। মাঝে রিভালদো এবং রোনালদিনহোর গোলে ৪-০ গোলের বড় ব্যবধান নিয়ে মাঠ ছাড়ে ব্রাজিল।

চীনের বিপক্ষে ফ্রি কিক থেকে দলের প্রথম গোল করছেন রবার্তো কার্লোস
চীনের বিপক্ষে ফ্রি কিক থেকে দলের প্রথম গোল করছেন রবার্তো কার্লোস (dailymail)

গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে কোস্টারিকার মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। ম্যাচের শুরু থেকেই আক্রমণের পশরা সাজায় তারা। ফল পেতেও দেরী হয়নি। ম্যাচের ১০ এবং ১৩ মিনিটের মধ্যে দুই গোল দিয়ে দলকে এগিয়ে নেন রোনালদো লিমা। বিশ্বকাপের আগেও নিজেকে হারিয়ে ফিরছিলেন তিনি। তাই এই সময়ে ফর্মে ফিরা দলের জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল। বাকি সময়ও আক্রমণাত্মক খেলে ব্রাজিল। মাঝখানে দুই গোল হজম করলেও ৫-২ গোলের বড় জয় নিয়েই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে তারা। ব্রাজিলের হয়ে বাকি গোল তিনটি করেন এডমিলসন, জুনিয়র এবং রিভালদো।

কোস্টারিকার বিপক্ষে গোল সেলিব্রেশন করছেন রোনালদো
কোস্টারিকার বিপক্ষে গোল সেলিব্রেশন করছেন রোনালদো (Buzón de Rodrigo)

দ্বিতীয় রাউন্ড:

বিশ্বকাপ শুরুর সময় আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিল দলটি। রোনালদো এবং রিভালদো সময়মতো ফর্মে ফিরায় দলও তখন উড়ছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রতিপক্ষ ছিল বেলজিয়াম। প্রথমে দুইদলই অনেক আক্রমণ করে, কিন্তু কেউই বল জালে জড়াতে পারছিলো না। রোনালদো সহজ সুযোগ পেয়েও সেটা হাতছাড়া করেছিলো। বেলজিয়ামের গোলরক্ষকও ব্রাজিল কে গোল বঞ্চিত করেছিলো কয়েকবার। অবশেষে ডেডলক ভাঙেন রিভালদো। ৬৭ মিনিটে গোল করে দলকে লিড এনে দেন। পরবর্তী তে ৮৭ মিনিটে গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন রোনালদো। এটি তার আসরের পঞ্চম গোল ছিল।

বেলজিয়ামের বিপক্ষে রিভালদো
বেলজিয়ামের বিপক্ষে রিভালদো (alamystock)

কোয়ার্টার ফাইনাল:

বড় স্টেজ, বড় মঞ্চ। মুখোমুখি ফুটবলের দুই পরাশক্তি ব্রাজিল এবং ইংল্যান্ড। উত্তেজনার পারদ টা তাই আগে থেকেই অনেক উপরে ছিল। ব্রাজিলের জন্য অপেক্ষা করছিলো কঠিন পরীক্ষা। খেলা শুরু হওয়ার পর যথারীতি আক্রমণ চালাচ্ছিল দুই দলই। প্রথমার্ধেই লুসিওর ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হওয়া বল পেয়ে যান মাইকেল ওয়েন। এগিয়ে আসা গোলকিপার মার্কোসের মাথার উপর দিয়ে চিপ করে বল জাড়িয়ে দলকে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত লিড। ইংল্যান্ড শিবিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সমতায় ফিরার জন্য একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে ব্রাজিল। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে রোনালদিনহো মাঝ মাঠ থেকে বল সাপ্লাই দেন ইংল্যান্ড বক্সের ডান

প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রিভালদোকে। কঠিন এঙ্গেল থেকে দর্শনীয় একটি গোল করেন তিনি। সমতায় ফেরে দল।

দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার পর ব্রাজিল আক্রমণের ধার আরও বাড়িয়ে দেয়। ৫০ মিনিটের সময় গোলবার থেকে ৩৫ গজ দূরে ফ্রিকিক পায় ব্রাজিল। ফ্রিকিক নিবেন রোনালদিনহো। ইংল্যান্ড ডিফেন্স তখন ব্যস্ত রোনালদো, রিভালদো, লুসিও দের থামাতে যাতে তারা রোনালদিনহোর ক্রসে মাথা ঠেকাতে না পারে। বুদ্ধিমান রোনালদিনহো খেয়াল করলেন ইংল্যান্ড কিপার সিমেন বল পাঞ্চ করার জন্য কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছেন। সুযোগ নিতে ভুল করলেন না তিনি। সরাসরি কিক করলেন, বল সিমেনের মাথার উপর দিয়ে নাগালের বাইরে দিয়ে জালে জড়াল। ব্রাজিল শিবির ফেটে পড়লো উদযাপনে। আসরের অন্যতম সেরা একটি গোল দেখল ফুটবল বিশ্ব। ২-১ গোলের লিড নিয়ে দল যখন কিছুটা স্বস্তিতে, ঠিক তখনই ঘটলো বিপত্তি।  ইংল্যান্ড প্লেয়ার মিলস কে ফাউল করায় রেফারী লাল কার্ড দেখান ম্যাচের হিরো রোনালদিনহো কে। বিতর্কিত এই সিদ্ধান্তের পর ব্রাজিল কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলে। যদিও ইংল্যান্ড খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলো না। কোচ রক্ষণ ঠিক রাখার জন্য রোনালদোর পরিবর্তে এডমিলসন কে নামান। বাকি সময়ে আর কোন গোল দিতে ব্যর্থ হয় ইংল্যান্ড। ২-১ গোলের জয় নিয়ে সেমি তে চলে যায় ব্রাজিল।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৫ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে গোল দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে রোনালদিনহো
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৫ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে গোল দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে রোনালদিনহো (pinterest)

সেমিফাইনাল:

সেমিফাইনালে ব্রাজিল আবারো মুখোমুখি সেই তুরস্কের সাথে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, রিভালদোর ড্রাইভ, সমালোচনা সবকিছু মিলিয়ে ম্যাচটি সেমিফাইনালের চেয়েও বেশী কিছু ছিল। তুর্কিস সাপোর্টারস রা মুখিয়ে ছিল এই ম্যাচটির জন্য, সাথে প্লেয়ার রাও। গ্রুপ পর্বের হারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল তারা। সেই প্রমাণ মাঠেও রেখেছিলো তুরস্কের খেলোয়াড় রা। যথারীতি খেলা শুরু হওয়ার পর ব্রাজিলের চেয়ে তুরস্কের পায়েই বল বেশী ছিল। কিছু সহজ সুযোগ মিস করায় প্রথমার্ধ শেষে স্কোরলাইন টা ০-০ ই থেকে যায়। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার ৪ মিনিট পরেই রোনালদোর অতিমানবীয় ফুটওয়ার্কে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে তুর্কিস ডিফেন্স। অসাধারণ একটি গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। এর মাধ্যমেই আসরে নিজের গোলসংখ্যাকে নিয়ে যান ৬ এ। এরপর অনেক চেষ্টা করেও গোল করতে পারেনি তুরস্ক। ১-০ গোলের জয় নিয়ে সপ্তম বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে চলে যায় তারা।

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেলে আসা তুরস্কের বিশ্বকাপ সফর শেষ হয়ে যায় এখানেই। ব্রাজিলের সাথে ম্যাচটিতেও নিজেদের বল পজিশন রেখেছিলো ৫৬%, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোনালদোর কাছে হেরে যেতে হয় তাদের। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে তারা।

তুরস্কের বিপক্ষে গোল দিচ্ছেন রোনালদো
তুরস্কের বিপক্ষে গোল দিচ্ছেন রোনালদো (guardian)

ফাইনাল:

ফাইনালের দুটি টিমই বিশ্বকাপ আসরের সেরা দুই দল। দুই দলেরই এটি সপ্তম ফাইনাল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথমবারের মতো ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছিলো দুই দল। দুইদলই নিঃসন্দেহে আসরের সেরা দল। একদিকে ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী সুন্দর ফুটবল অন্যদিকে জার্মানির যান্ত্রিক গতিশীল ক্লিনিকাল ফুটবল। পুরো ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষা করছিলো এই ক্লাসিক লড়াই দেখার জন্য। একদিকে আসরে ৬ গোল দেয়া রোনালদো অন্যদিকে ৫ গোল দেয়া ক্রুস। একদিকে রিভালদো, রোনালদিনহো দের নিয়ে গড়া সেরা এটাক অন্যদিকে একাই গোলবার সামলে রাখা অলিভার কান। উত্তেজনার পারদ যেন উচ্চতার সীমা ভঙ্গ করতে চাচ্ছিল।

ম্যাচ শুরু হল যথারীতি। ব্রাজিলের মূল তারকা রোনালদো হতাশ করল সবাইকে। প্রথমার্ধে তিন টি সুযোগ পেয়ে একটিও কাজে লাগাতে পারেননি। ডি বক্সের বাইরে থেকে ক্লেবারসনের বাঁকানো শট অলিভার কানকে পরাস্ত করলেও হেরে যায় বার পোস্টের কাছে। সব সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে হয়তো প্রথমার্ধেই খেলা নিজেদের দখলে নিয়ে নিতে পারতো ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে ৪৯ মিনিটে ৩৫ গজ দূরে ফ্রি কিক পায় জার্মানি। ন্যেবুলের বুলেট গতির সেই ফ্রি কিক ফিরে আসে বার পোস্টে লেগে। শুধু ফ্রি কিক নয়, মনে হচ্ছিলো জার্মানির বিশ্বকাপ স্বপ্ন ফিরে এলো বারপোস্টে আঘাত পেয়ে।

ফাইনালে গোল দেয়ার পর সেলিব্রেশনে রোনালদো
ফাইনালে গোল দেয়ার পর সেলিব্রেশনে রোনালদো (daily mail)

ম্যাচের ৬৭ মিনিটে ডি বক্সের বাইরে থেকে জোরাল শট নেন রিভালদো। তার সেই শট প্রতিহত করেন অলিভার কান, কিন্তু রিবাউন্সে বল পেয়ে যান রোনালদো। বল জালে জড়াতে এক মুহূর্তও দেরী করলেন না। ১-০ তে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। বিশ্বসেরা গোলকিপারের বুক থেকে বল ছুটে যাবে ভাবতেও পারেনি কেউ। গোল শোধ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যায় জার্মানি। তাদের কয়েকবার প্রতিহত করেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক মার্কোস। ৭৯ মিনিটে ডান প্রান্ত থেকে কাট ইন করে ঢুকে রিভালদো কে পাস দেন ক্লেবারসন। রিভালদো স্টেপ ওভার করে বল দিয়ে দেন রোনালদো কে। ফাকায় দাঁড়িয়ে থাকা রোনালদোর ডান পায়ের শট অলিভার কান কে ফাকি দিয়ে জড়িয়ে যায় জালে। ২-০। পুরো ব্রাজিল জাতি উল্লাসে ফেটে উঠে। এই গোলগুলো করতে না পারলে হয়তো রোনালদোর বুকটা ভারি হয়ে থাকতো সারাজীবন। পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা থেকে মাত্র ১১ মিনিটের দূরত্বে ছিল ব্রাজিল। শেষ এগারো মিনিটে গোল শোধ দেয়ার চেষ্টা করেও পারেনি জার্মানি। ফুলটাইম। ব্রাজিল ২- জার্মানি ০।

ব্রাজিলের পতাকা গায়ে জড়িয়ে মাঠে উদযাপনে মেতে উঠেন রোনালদো রা। অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে একাকী মানুষের মতো গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন অলিভার কান। ফুটবল কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর।

ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক আসর এই ফিফা বিশ্বকাপ। ১৯৩০ সালে ফিফা বিশ্বকাপের প্রথম আসর অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত সর্বমোট ২০ বার অনুষ্ঠিত হয় টুর্নামেন্ট টি। সর্বমোট ৮ টি দল এই শিরোপা জিতার গৌরব অর্জন করে। যাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ বার শিরোপা জিতে ব্রাজিল।

২০০২ বিশ্বকাপটি ব্রাজিলীয়দের মনে আজীবন গেঁথে থাকবে। এই আসরেই তারা তাদের পঞ্চম শিরোপা জিতে নেয়। চলে যায় সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শুধুমাত্র সাফল্যের জন্যই নয়, ব্রাজিলের নাম মানুষের মনে গেঁথে থাকবে তাদের শৈল্পিক ফুটবলের জন্য। ব্রাজিলের সুন্দর ফুটবল ছাড়া ফুটবল কখনোই পরিপূর্ণতা পেতো না।

ফাইনালে পরাজয়ের পর অলিভার কান
ফাইনালে পরাজয়ের পর অলিভার কান (mirror)

সুন্দর ফুটবলের জন্য বিখ্যাত ব্রাজিল ২০০২ এ সফলতা পেলেও পরবর্তী টুর্নামেন্ট গুলোতে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। ২০০৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৪ বিশ্বকাপে সেমি ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েই বিদায় নিতে হয় তাদের। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই পারফর্মেন্স খুব একটা খারাপ না হলেও, এগুলো ব্রাজিল নামের সাথে ঠিক মতো যায় না। পরবর্তী শিরোপার জন্য দেশটি অপেক্ষা করছে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে। ব্রাজিল কি এবার পারবে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে? শিরোপা জিততে পারুক আর না পারুক, ফুটবল ভক্ত রা সবসময়ই ব্রাজিলের শৈল্পিক দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দেখার জন্য বসে থাকবে টেলিভিশনের পর্দার সামনে।

Source Featured Image
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More