আরব বসন্তঃ ইতিহাসে মরীচিকাময় এক রক্তাক্ত বিপ্লব

5

পৃথিবীর ইতিহাসে যেসকল বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে তার অধিকাংশই সাধিত হয়েছে বিপ্লবের মাধ্যমে। তাই বিপ্লবকে প্রগতির জন্য এক আশীর্বাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রেনেসাঁ,শিল্প-বিপ্লব,বলশেবিক বিপ্লবকে এখনো পৃথিবীর ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন বিপ্লব হিসেবে ধরা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সকল বিপ্লব সমর্থনকারী ব্যক্তির মনে বিপ্লব মানেই হল সাধারণ মানুষের মুক্তি,অধিকার প্রতিষ্ঠা,ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসও অনেকটা তাই সমর্থন করে। কিন্তু কখনো কখনো এর বিপরীতও হতে পারে। অর্থাৎ মানুষের মুক্তি, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা নাও হতে পারে। তারই সাক্ষ্য বহন করে একবিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় বিপ্লব “আরব বসন্ত”। আরব বসন্ত যে লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল অর্থাৎ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের অধিকার রক্ষা ও স্বৈরশাসনের অবসান করা এসবের সব কিছুই আজ প্রায় মরীচিকা। তবে আরব বসন্তের মাধ্যমে আরবে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা সত্য।

 

আরব বসন্তের সূত্রপাতঃ  

ডিসেম্বর ২০১০ বুয়াজিজি নামক এক শিক্ষিত মুদি দোকানদার প্রকাশ্য নিজ শরীরে আগুন লাগিয়ে দেন। আর এটি ছিল তৎকালীন তিউনিসিয়ার বিদ্যমান দুর্নীতি,অপশাসন,মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদ। বুয়াজিজি ছিলেন একজন শিক্ষিত যুবক পড়াশুনা শেষ করে চাকরীর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন চাকুরী না পেয়ে স্বল্প পুঁজি নিয়ে মুদি দোকান নিয়ে বসেন। কিন্তু পুলিশের দুর্নীতি ও ঘুষের স্বীকার হয়ে তার এই সামান্য ব্যবসাও পণ্ড হয়ে যায়। ফলে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরেও ন্যায় বিচার না পেয়ে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে বেন আলী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এই আগুন নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে সকল তিউনিস প্রতিবাদীর রক্তে। ফলে আন্দোলন দানা বাঁধে। ২৬ ডিসেম্বর বোয়াজিজি মৃত্যুবরণ করলে এই আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। প্রথমে এই আন্দোলন সমগ্র তিউনিসিয়া কে উত্তাল করে তোলে। পরবর্তীতে তা সীমান্ত ছাড়িয়ে মিশর,সিরিয়া,ইয়েমেন,বাহরাইন,ইয়েমেন,লিবিয়াসহ প্রায় সমগ্র আরব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়েই বেন আলীর পতন হয় এবং একইসাথে তথাকথিত অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানদের পতনও শুরু হয়ে যায়।

আরব বসন্তের সূত্রপাতকারী বোয়াজিজি; Source: popularresistance.org

 

আরব বসন্তের বিস্তারঃ

৪ জানুয়ারি ২০১১ থেকে তিউনিসিয়ায় আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে ১৪ জানুয়ারি বেন আলী তার দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি নেন এবং পালিয়ে সৌদি আরবে আশ্রয় নেন।এতে আপাত দৃষ্টিতে বিদ্রোহীরা সফলতা লাভ করলে এর ঢেউ পার্শ্ববর্তী দেশেও আঘাত হানে। প্রথমেই এই খড়গ উঠে মিশরের উপর। মিশরে প্রায় ৩০ বছর ধরে একক শাসন পরিচালনা করে যাওয়া হুসনী মোবারকের সরকারের অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মিশরের সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে এবং তাহারীর স্কয়ারে একত্রিত হয়।

আরব বসন্তের সময় তিউনিশিয়া

 

ফলে বাধ্য হয়ে হুসনী মোবারক কে ১১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা থেকে নেমে আসতে হয়। এতে জনগণ উল্লাসে ফেটে পড়ে। প্রায় একই সময়ে অন্যদিকে লিবিয়ার সাধারণ জনগণও দীর্ঘস্থায়ী একনায়ক  মোয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। কিন্তু গাদ্দাফি এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি আন্দোলনকারী জনগণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে তিনি আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি বরং আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীদের কে ইউরোপ ও আমেরিকা জোট অস্ত্র সরবরাহ করে ফলে লিবিয়াতে গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে। এই অবস্থা দীর্ঘ নয় মাস চলার পর ২০ অক্টোবর গাদ্দাফি পরাজিত ও নিহত হন। অপরদিকে সিরিয়ার সরকার বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু বাশার আল আসাদ বিদ্রোহীদের কে মাথা তুলে ধারাতে দেননি। ফলে বাশার আল আসাদ বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকে যা আজও বিদ্যমান রয়েছে। একইভাবে ইয়েমেনে স্বৈরাচারী শাসক আব্দুল্লাহ সালেহের পতন গটে এবং ক্ষমতায় আসেন আব্দুরাব্বে মানসুর। বাহরাইনে বিদ্রোহ দেখা দিলেও তা ব্যাপকতা লাভ করতে পারেনি। তবে সেখানেও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। এছাড়াও আরবের অন্যান্য অঞ্চলেও এর প্রভাব ছড়িয়ে পরছিল যদিও ঐসব অঞ্চলে এই বিপ্লব ততটা সাফল্য লাভ করতে পারেনি।

 

আরব বসন্তের ফলাফল কি ছিল?

অনেকটা ঢাক-ঢোল পিটিয়েই পশ্চিমা মিডিয়া তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া বিপ্লব কে আরব বসন্ত হিসেবে প্রচার করে এবং এই বিপ্লবকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। আরব বসন্ত শেষ হয়ে যাওয়ার সাত বছর পরে এসে এখন অনেকেরই জানার ইচ্ছা যে আসলে আরব বসন্ত তার কাঙ্ক্ষিত দাবী পূরণ করতে পেরেছে কিনা? বা আরব বসন্তের প্রভাব কতটুকু?

যে তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র ,সুশাসন ও মানবাধিকারের আলো জ্বালানোর জন্য নিজের শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন বুয়াজিজি সেখানে এখনো পূরণ হয়নি বুয়াজিজির স্বপ্ন। ১৪ জানুয়ারি ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বেন আলী পদত্যাগ করার পর গনতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতায় আসেন ঘানুচি। তিনিও পরিবর্তিত হয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেজি সাঈদের আগমন হয়। কিন্তু তিউনিসিয়ার জনগণের জীবনমানের কোন উন্নতি হয়নি। এখনো সেখানে সাত লক্ষ লোক বেকার। তার উপরে মুদ্রাস্ফীতি ও সাধারণ জনগণের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ। সব মিলিয়ে তিউনিসিয়া খুব ভাল অবস্থানে নেই।

 

মিশরে মোবারক কে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুড গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় আসেন। মুহাম্মদ মুরসী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুই বছর শাসন পরিচালনার পর সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেন এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিসির উত্থান হয়। ফলে মিশরে আবার জনগণের স্বাধীনতা খর্ব হয়। এদিকে মুরসীসহ তার দলের বহু নেতা কর্মী এখন জেলে দিনাতিপাত করছে।

মিশরে আরব বসন্ত

লিবিয়াতে অবস্থা আরও খারাপ। গাদ্দাফি থাকা কালে লিবিয়াতে গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকলেও লিবিয়ার সাধারণ জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণ ও জীবন যাত্রার মান নিশ্চিত ছিল। কিন্তু আরব বসন্তের পর লিবিয়াতে গৃহ যুদ্ধ দেখা দেয়। লিবিয়ার সাধারণ জনগণের হাতে পশ্চিমারা অস্ত্র তুলে দেয় এবং ন্যাটোর হস্তক্ষেপের কারণে লিবিয়ার কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে  বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর শাসন গড়ে উঠে যা বর্তমানেও বজায় রয়েছে। ফলে লিবিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপর্যস্ত।

একইভাবে সিরিয়া তে আজ হাজার হাজার নারী শিশুর রক্তের স্রোত আরব বসন্তের মূল্য দিচ্ছে।আরব বসন্তের সূচনালগ্ন  হতে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ কে উৎখাত করার জন্য সাধারণ জনগণ বিদ্রোহ করে তাদের কে মার্কিনীরা অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে আন্দোলন কে আরও বেগবান করে তোলে। অপরদিকে যখন বাশার পরাজিত হওয়ার পথে তখনই তার পাশে এসে দাঁড়ায় রাশিয়া ও ইরান ।ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়। যা আজও জীবিত। ফলে আরব বসন্ত সিরিয়ার সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার পরিবর্তে তাদের স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস করে দিয়ে কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার তাজা প্রাণ।

একইভাবে ইয়েমেন ও বাহরাইনে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। জন্ম নিয়েছে নতুন জঙ্গীগোষ্ঠী বিপর্যস্ত হয়েছে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা। কিন্তু ফিরে আসেনি আরব বসন্তের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। নিশ্চিত হয়নি সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার।

 

আরব বসন্তের ফল হিসেবে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, Source: foreignpolicy.com

আরব বসন্ত ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূলা ঝুলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসা, তেল আমদানি ও তাদের মদদ-পুষ্ট শাসকের ক্ষমতায় বসানোর একটি এজেন্ডা মাত্র। যা আজ বর্তমান বিশ্বের সামনে স্পষ্ট। যদিও তারা তাদের এই এজেন্ডা তে বহুলাংশে সফল। মধ্যপ্রাচ্যকে আরও কতদিন এই আরব বসন্তের মূল্য পরিশোধ করতে হয় তাই এখন দেখার বিষয়।

 

তথ্যসূত্রঃ

https://ourislam24.com/2016/08/03/%E0%A6%86%E0%A6%B0%E0%A6%

http://www.prothomalo.com/international/article/755809

http://old.dhakatimes24.com/2016/03/04/104362

http://archive.ittefaq.com.bd/index.php?ref=MjBfMDZfMTNfMTRfMV80XzFfMTM3NjUy

Leave A Reply

Your email address will not be published.

5 Comments
  1. cialis online cheap says

    What i do not realize is in reality how you are
    now not really much more neatly-favored than you may be now.

    You are very intelligent. You realize thus considerably on the
    subject of this topic, produced me in my view imagine it from
    so many numerous angles. Its like men and women don’t seem to be interested
    except it’s something to accomplish with Girl gaga! Your personal stuffs outstanding.
    Always care for it up!

  2. zedeseido says

    propecia vs generic For example, disseminated carcinoma cells attempting to reach the brain parenchyma must traverse the blood brain barrier; similarly, endothelial cells lining pulmonary microvessels normally create a largely impermeable barrier

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More