ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ (Elizabeth I)-এর আরেক নাম “ভার্জিন কুইন।“ কারণ তিনি ছিলেন চিরকুমারী। সে সময়ের সম্ভ্রান্ত অনেক ডিউক ও ব্যারন তাঁর পাণিপ্রার্থী ছিলেন। এদেরই একজন ব্যারন থমাস সিম্যুরের সাথে তাঁর ঘনিষ্টতাও ছিলো কিছুকাল। তবুও কখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন নি তিনি। বিয়ে নিয়ে কুইন এলিজাবেথের মন্তব্য ছিলোঃ “I would rather be a beggar and single than a queen and married.”
কিন্তু কেন? ঐতিহাসিকদের মতে, তাঁর চিরকুমারী থাকার মূল কারণ ছিলো ভয়। হ্যাঁ, ভয় ! পরকীয়ার অভিযোগে শৈশবে নিজের মায়ের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হতে দেখেছিলেন। প্রশ্নবিদ্ধ সেই মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছিলেন স্বয়ং এলিজাবেথের পিতা রাজা অষ্টম হেনরি! ধারণা করা হয় শৈশবের সেই দুঃসহ স্মৃতি থেকেই তাঁর মনে প্রেম-ভালোবাসার প্রতি ভীতি তৈরি হয়েছিলো। আর এই অযাচিত ভয়ের কারণেই তিনি আজীবন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা এই ভয়ের নাম দিয়েছেন ফিলোফোবিয়া (Philophobia).
“ফিলোফোবিয়া” শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ “ফিলোস” ও “ফোবোস” থেকে। “ফিলোস/ফিলিয়া” অর্থ আসক্তি বা, ভালোবাসা; আর “ফোবোস” অর্থ ভয় বা, আতঙ্ক। সহজ ভাষায় ফিলোফোবিয়া মানে প্রেমে পড়ার ভয়! মনোবিজ্ঞানীরা একে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবেঃ “the irrational and unwarranted fear of falling in love.”
শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও ফিলোফোবিয়া মোটেও দুর্লভ কিছু নয়! ভালো করে খুঁজলে আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে, যাদের মনে বিবাহ বা প্রেম-ভালোবাসার প্রতি অনীহার পেছনে লুকিয়ে আছে স্রেফ ভয়। সেই ভয়ের কারণ হিসেবে মনোবিজ্ঞানীরা অতীতের প্রচণ্ড মানসিক আঘাতকে দায়ী করেছেন। সেটা হতে পারে প্রথম প্রেমের ব্যর্থতা, অথবা অন্য কারো প্রেমঘটিত বিরহ খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা, পিতামাতার দাম্পত্যকলহ কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ। তাছাড়া প্রেমের ব্যাপারে ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতা, অথবা ব্যক্তিগত হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকেও ফিলোফোবিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণে ফিলোফোবিয়া-আক্রান্ত ব্যক্তির মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, সকল সম্পর্কের পরিণতিই বোধহয় বিচ্ছেদ!
ফিলোফোবিক ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে সে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সেই সাথে নিজের অনুভূতিকে দমন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। ফলে যার প্রতি সে আকৃষ্ট হয়, তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এছাড়াও রোমান্টিক নাটক, সিনেমা, গান ইত্যাদি পুরোপুরি বর্জন করে। প্রেম ও বিবাহসম্পর্কিত যেকোনো আলাপচারিতা এড়িয়ে যায়। বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা কাপলদের দেখা পাওয়া যায় এমন জায়গা যেমনঃ পার্ক, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল ইত্যাদি এড়িয়ে চলে। এভাবে এক সময় নিজের অজান্তেই চারপাশের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ফিলোফোবিক ব্যক্তি নিজেও জানে যে, তার এ ভয় সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অমূলক। কিন্তু অতীতের ট্রমার কারণে ভয়ের বৃত্ত থেকে সহজে বের হতে পারে না। ফলে ক্রমাগত মানসিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে চরম অস্থিরতায় দিন কাটায়। এই সংকটময় অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু কার্যকরী উপায় বের করেছেন। যেমনঃ কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি, এক্সপোজার থেরাপি বা সিস্টেমিক ডিসেন্সিটাইজেশন, হিপনোথেরাপি, এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ ইত্যাদি। এগুলোর যেকোনো এক কিংবা একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করে ফিলোফোবিয়া নামক অস্বস্তিকর ভীতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব!
পর্ব দুই – অদ্ভুত যতো ভয়ভীতিঃ পর্ব দুই।। ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ
তথ্যসূত্রঃ The Anxiety & Phobia Workbook: by Edmund J. Bourne, Fearof.net: the ultimate list of phobias & fears, Healthtopia, Wikipedia, Cognifit: Health, Brain & Neuroscience.