সেইবার ই মাথায় প্রথম ভূত চাপল, “না গেলে ত হইতেই আছে না এইবার।”
ভূতটা চাপাইছিল ছোটভাই অর্ক।
“এহন পর্যন্ত লালনমেলায়ই গেসো না মিয়া!! কি হইবো এই জীবন দিয়া??”
আসলেই ত, যেই লালন-লালন নিয়া পইড়া থাকি আমাদের জেনারেশনের অনেকেই, সেই লালনের আখড়া আমাদের দেশেই। মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। একবারো যাই নাই, বয়স আমার ২৩ হইয়া গেছে। কেম্নে!!! মানাই যায় না-এমন এক অবস্থা।
মেলা শুরু হইতে আরো দুদিন বাকি আছে, অর্ক বলল। মনে মনে ভাবলাম এইবার যাইতেই হইব। টাকা মেনেজ করে ফেলতে হবে আগে, তাইলে যাওয়া হবে। আম্মুকে সরাসরি বললাম টাকা লাগবে কিছু, কুষ্টিয়া যাব। টাকা দাও।
তুই না আগের সপ্তাহেই কই থেইকা ঘুইরা আইলি!! এখন আবার কুষ্টিয়া??
কুষ্টিয়া যাবি ক্যান?
লালন মেলায় যামু।
আম্মুর মুখের অবস্থা কেমন ছিল তা আর মনে না করি। পারলাম না টাকা ম্যানেজ করতে অন্য কোনো ভাবেও। আজ রাতেই সবাই মিলে রওনা হওয়ার কথা। মিটিং টাইম-রাত ৮:২০, ময়মনসিংহ স্টেশন। রাত ৮ টা নাগাদ স্টেশনে পৌছাইলাম। এর-ওর কাছ থেকে ১৭০ টাকা জোগাড় করে নিয়ে। প্লান হইল, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যমুনা এক্সপ্রেসে উঠে যমুনা সেতু পূর্ব পর্যন্ত যাব। ট্রেন অইটুক পর্যন্তই যাবে। আমরা ট্রেন থেকে নেমে কুষ্টিয়াগামী কোনো বাসে অথবা খুলনাগামী কোনো ট্রেনে উঠব। সবাই একে একে চলে আসল। ট্রেনও চলে আসল সময় মতই। টিকিট করি নাই তাও ট্রেনের ফার্স্টক্লাস এ গিয়ে বসলাম সবাই। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে যেটা জানতাম, এই ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশন ছাড়ার পর তেমন একটা চেকিং হয় না, ফার্স্টক্লাস এ ত আরো না। ট্রেন এ ভিড়ও তেমন নাই। গান বাজনা, হই হুল্লোড় করতে করতে চলে আসলাম বঙ্গবন্ধু পূর্ব স্টেশন। ট্রেন উলটা ব্যাক করবে আবার। স্টেশনে নেমে হাইওয়ের দিকে এগুলাম বাসের জন্য। বাস থামছে না। চা খেতে বসলাম। একজন যাত্রী দেখলাম তাড়াহুড়ো করে চা খেয়ে দৌড়ে গেল স্টেশনের দিকে। উঁকি দিয়ে দেখি একটা ট্রেন দাঁড়ায়ে আছে। কখন ট্রেন আসল একেবারে টেরই পাইনি কেউ। আমরাও দৌড়। ট্রেন যাবে খুলনা। ঈদ স্পেশাল ট্রেন। রাত তখন দেড়টা। যারা যাচ্ছি কারো কাছেই বিশেষ কোনো টাকা নেই। সর্বোচ্চ টাকা ৭০০ নিয়ে সফরসঙ্গী ছোটভাই অর্ক। যতটুকু সময় থাকা যায়, থেকে ফিরে আসব-এইটাই প্লান। প্লাটফরমে গিয়েই প্রথমে ট্রেনের টিটি আর পুলিশ খুঁজতে লাগলাম পূর্ব পরিকল্পনা মত। কারণ টিকিট না কাটা তখন আমাদের ফ্যাশন এবং ঐ মুহূর্তে যথেষ্ট প্রয়োজনীয়ও বটে। কাজ হাসিল হল। দুই পুলিশের সাথে তাড়াহুড়ায় ঠিক করলাম ৪ জন ১০০ টাকা দিব, কুষ্টিয়ার আশেপাশের কোনো স্টেশনে নামায়ে দিবে। কোনো ভাবেই রাজি হয় না। ট্রেনও ছেড়ে দেয় দেয়। ২০০ টাকায় চুক্তি সেড়ে আমরা ট্রেনে গিয়ে উঠলাম। জায়গা মত কিছু খালি সিটে আমাদের বসিয়েও দেয়া হল। ব্যাস!! জমে গেল সফর।
শরীর তখন টগবগ করছে উত্তেজনায়, শেষমেষ তাহলে প্লান মতই হচ্ছে সবকিছু। এই ট্রেনযাত্রাটা খুব উপভোগ্য ছিল। চাঁদের আলোয় চারিপাশ ফকফকা। এরই মধ্যে দ্রুতগতিতে ট্রেন চলে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠঘাট পেড়িয়ে। ভোর নাগাদ কুষ্টিয়ার পোড়াদহ স্টেশনে নামলাম। বেশ কিছু বাউলবেশী যাত্রীও নামল আমাদের সাথে। সূর্য উঠে নাই তখনো। স্টেশনের আশপাশ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বয়সের বাউল ঘরানার লোকের সাথে কথাবার্তা হল। আলো ফুটতেই নাস্তা সেড়ে ১৫০ টাকায় একটা সিএনজি ঠিক করে সোজা ছেউড়িয়ার লালন আখড়ায় চলে এলাম। প্রচুর লোকজন। এখানে ওখানে নিজের অস্থায়ী আবাস তৈরি করছে মোটা পলিথিনের সামিয়ানা দিয়ে। জায়গায় জায়গায় বাউলেরা আসর জমিয়েছে গানের। সবেমাত্র সকাল হল আখড়ায়। পুরো জায়গাটার এদিক ওদিক চষে ফেললাম ঘন্টা খানিকের ভেতরে।
-এখন হোটেলে যাই চল। ঘুম হয় নাই রাতে। ঘুমানো দরকার।
-হোটেলে মানে? আগেই কইলাম না এইখানেই থাকব, তাদের সাথে, তাদের মত করেই।
আগে থেকেই প্লান ছিল কোনো বাউল ধরে তার সাথেই আসন গেড়ে, খেয়ে, বাজিয়ে, নেচে, ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিব।
অর্ক যখন পলিথিন কিনতে গেল আমাদের অস্থায়ী আবাস গাড়ার জন্য, ত্রিদিবের খুশি দেখে কে!! রানাও তখন ঠান্ডা। দুটি গাছের সাথে পলিথিন বেঁধে মাটিতে আরেক পলিথিন পেতে মাথায় ব্যাগ রেখে শুয়ে পড়লাম সবাই।
-পিঁপড়া!!
-আরে হ বেডা, কামড়ায়া ফাডায়ালছে।
১০ মিনিটের মাঝেই উঠে পড়লাম। এইখানে থাকা যাবে না। নতুন জায়গা বের করতে হবে। কিছুক্ষণ পর এক বুড়ো চাচার সাথে দেখা, সেও কোথায় থাকবে চিন্তা করছে। আমাদের পেয়ে বুড়োর বুকে প্রজাপতি উড়তে শুরু করল। সবাই মিলে চলে গেলাম আখড়ার পাশের মাঠের মঞ্চে।
-এইখানেই আইজ দিন-রাতটা কাটায়া দেই। চলো।
হুড়মুড়িয়ে জায়গাটার খানিকটা দখল করলাম। চারপাশে তাকালাম। মাঠের পুরোটাতেই ছোট ছোট ঘরের মত করে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বাউল, সূফী, গায়করা স্থায়ী আসন গেড়েছেন। সুরে-স্বরে পুরো এলাকা মাতোয়ারা। আমাদের সাথেই মঞ্চের উপরও বেশ কয়েকটি আস্তানা। চাচার সাথে লুঙ্গি পড়ে চলে গেলাম কালী নদীর ঘাটে। গোসল সেরে এসে সবাই ঘুম।
ঘুমের ভেতর কিছু সুর-কন্ঠ তাড়া করে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো মিষ্টি সুবাস এসে মস্তিষ্কে বাসা বেঁধে ফেলেছে, আর সরবে না। ঘুম ভাঙল অনবরত সিংগার ধ্বনিতে।
আর কত ঘুমাবা মিয়া!! উঠো। আমি জাইগা জাইগা তোমাদের জিনিস পাহাড়া দিতাসি।
উঠে পড়লাম ঘুম থেকে। মনে হল এক ঘুমেই অন্য জগতের কোনো ময়দানে এসে হাজির হলাম যেখানে চারপাশে অজস্র ভ্রমর ঘর করেছে কোনো অমৃতরসের আশায়। আমরাই বয়সে সবচেয়ে ছোট সেখানে কিন্তু দাদা-কাকার মত বা তার চেয়ে বয়সী সবাইকেই মনে হচ্ছে যেন শিশু। শিশুর মত নেচে-গেয়ে যাচ্ছে, হাসছে, অভিমান করছে, তাকাচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমাদের সবার মনই ফুরফুররে তখন। মাঠের ভিতরেই এক ছাপড়ায় ২০ টাকায় ভাত, ডিম, ভর্তা খেয়ে এসে আসনে বসলাম। গান গেলাম, শুনলাম, হাতে-পায়ে বাজিয়ে শরীর দোলালাম, চেয়ে থাকলাম কান পেতে। যারা এসেছে তারা সবাই এ জায়গার বাউল নন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন সবাই। আমাদের পাশেই দাদু ঘোচের দুজন বাউল আস্তানা গেড়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।
-কই থেইকা আইছো দাদু?
-ময়মনসিংহ।
তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
আমিও তার চোখ ধরে চলে গেলাম তার যৌবনের ময়মনসিংহ শহরে। দাপিয়ে বেড়ালাম চড়পাড়া, ব্রিজ মোড়, চর নিলক্ষীয়া আর খাদিজা বিবিকে। আমি বারেবারেই টের পাচ্ছিলাম কোনো কোমল, খুব সত্য কিছু ভর করছে এসে আমার উপর। আমাকে মুগ্ধ করে দিচ্ছিল বাউলদের গল্প, চাহনি, আস্ফালন গুলো। এই বুড়ো, এই শিশু, এই যুবা হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার।
শুন্য দৃষ্টি নিয়ে যখন বসে আছি, কানে এসে ভর করল এক জাদুকরী গলা। মনে হচ্ছিল আমি লিখেছি, গেয়েছি এই গান কোনো হিজলবনে হারাতে হারাতে। পুরো ময়দান কাপিয়ে দোতারা-সুর-স্বর এসে আমায় শুণ্যে ভাসিয়ে দিল।
“আমি তাইতে পাগল হলেম না।
হলেম না। হলেম না।
মনের মত পাগল পেলাম না।”
ওখানে একটা অলিখিত নিয়ম হল, গুরু/সাধু ধরে আস্তানা বানাতে হয়। এক একলা ষাটোর্ধ বাউলের শিষ্যত্ব নিলাম ওখানে থাকা সময়টুকুর জন্য। তার খাওয়া, টুকটাক খরচ আর সিদ্ধির খরচটা আমরা বহন করলাম। রাতে আবার পুরো জায়গাটা চষতে লাগলাম। হাল্কা শীত শীত বাতাস পুরো মাঠ জুড়ে। কালী নদীর উপরে ছড়ানো-ছিটানো হাল্কা কুয়াশা। আলো-আঁধারগুলো চোখে গেঁথে যাওয়ার মত। ঘাটের পাশে বসে বারবার মনে হচ্ছিল, আসলাম। তবে এত দেরিতে!! আরো আগেই আসার দরকার ছিল। হাতে কালাইয়ের রুটি নিয়ে পানির দিকে চেয়ে থেকে সূরের কুয়াশায় মিশে যেতে থাকলাম। আমার ঐ একবারই যাওয়া।
ছিলাম আর ১ দিন। মেলা তখনো চলছে। পয়সা শেষ সবারই। সবাই রওনা দিয়ে দিলাম যার যার পথে। রানা ঢাকায়, অর্ক আর ত্রিদিব ময়মন্সিংহ আর আমি রাজশাহীর ট্রেনে উঠে পড়লাম।
সময়ের ফাঁকফোকরে আর বেরুতে পারি নি। আর যাওয়ায় হয় নি।বলে রাখা ভাল এ বছরের লালন স্মরণোৎসব শুরু হচ্ছে ১৬ই অক্টোবর। চলবে ১৮ অক্টোবর, ২০১৭ পর্যন্ত।
ঢাকা থেকে খুলনা/যশোর/ঝিনাইদহ গামী বাসে কুষ্টিয়া চলে আসা যায়। বাস থেকে নেমে ২০ মিনিট হাটার পথ অথবা একটা রিক্সা নিয়েও চলে আসা যায় কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার লালন শাহের মাজার বা আখড়ায়। ট্রেনে করে আসলে নামতে হবে কুষ্টিয়ার কালাদহ অথবা মিরপুর স্টেশনে। ঢাকা ছাড়াও সারাদেশের সব জেলার সাথেই কুষ্টিয়ার সড়ক যোগাযোগ হয়েছে।
থাকার ব্যবস্থা: আমাদের মত করে থাকার দরকার নেই। হোটেল ভাড়া করে নিবেন, যতক্ষণ খুশি এখানে থেকে আবার হোটেলেই ফিরে যেতে পারবেন।
কি খাবেন: মাঝারি, ভাল সব ধরণের খাবার হোটেলই পাবেন কুষ্টিয়ায়। যেখানে থাকছেন তার আশেপাশে দেখে শুনে ঢুকে পড়ুন। ছাত্র ভাইয়েরা দল বেধে অথবা দু-একজন মিলে গেলেও চেষ্টা করবেন যেকোনো খাবার শেয়ারে খাওয়ার জন্য। কুষ্টিয়ায় পিক সিজন মানে ট্যুরিস্ট সিজন এইটা। খাবারের দাম অনেক জায়গায়ই বেশি নিতে পারে তাই। যেকোনো খাবার হোটেলে মেন্যু এবং দাম জেনে জেনে খাওয়ার অভ্যাস করুন।
বিশেষ উপদেশ: লালন মেলায় এবং আপনার আশেপাশে বেশ কিছু দালাল/ধান্দাবাজ গোছের লোক থাকবে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও ফোন সাবধানে রাখুন। আরেকটা কথা, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, সেবন, বহন থেকে দূরে থাকবেন।
যারা গিয়েছেন এর আগেও তারা ত জানেনই কেমন আমেজ এ কয়টা দিনের। যাদের একবারও যাওয়া হয়নি হাতে সময় থাকলে চোখ বন্ধ করে গাড়িতে চেপে পড়ুন। নিরাশ হবেন না কোনো দিক দিয়েই।
ছবিঃ Collected