জরায়ুর নিচের অংশকে বলা হয় সারভিক্স (জরায়ু-মুখ)। এই সারভিক্সে ক্যান্সার হলে তাকে বলা হয় সারভাইক্যাল ক্যান্সার (জরায়ু-মুখের ক্যান্সার)। বর্তমানে সারা বিশ্বের নারীদের মধ্যে এটি ৪র্থ প্রধান ক্যান্সার। তবে বাংলাদেশে এর অবস্থান ২য় (স্তন ক্যান্সার ১ম)। এদেশের ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ-ই সারভাইক্যাল ক্যান্সারের শিকার হন। ২০১০ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৬ জন নারী সারভাইক্যাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন নারী এই রোগে মারা যান। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, সারভাইক্যাল ক্যান্সার এখনো পর্যন্ত মানবদেহের একমাত্র ক্যান্সার, যা ভ্যাক্সিনের (টিকা) মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই এই রোগ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা সবার জন্য জরুরী। কেননা আমাদের সামান্য একটু সচেতনতা পরিবারের নারী সদস্যদেরকে এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। তাহলে চলুন সারভাইক্যাল ক্যান্সার সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।
কারণঃ
এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য বেশ কিছু “রিস্ক ফ্যাক্টর” চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছেঃ-
১) বয়সঃ দুইটি বয়সে বেশি হয়। ৩৫ বছর এবং ৫০-৫৫ বছর। ৩০ বছর বয়সের আগে এই রোগ হয় না বললেই চলে।
২) বাল্যবিবাহঃ মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হলে, কিংবা অল্প বয়সে যৌনজীবন শুরু করলে এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৩) সন্তান প্রসবঃ যারা অল্প বয়সে সন্তান প্রসব করেন, অথবা অধিক সন্তান প্রসব করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি।
৪) সহবাসঃ অতিরিক্ত সহবাস এই রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৫) বহুগামিতাঃ যেসব নারী অথবা তাদের স্বামী বহুগামি, তাদের ঝুঁকি বেশি।
৬) অপরিচ্ছন্নতাঃ পুরুষ ও স্ত্রী জননাঙ্গের অপরিচ্ছন্নতার কারণে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
৭) আর্তসামাজিক অবস্থাঃ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই ক্যান্সারে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
৮) ভাইরাসঃ*** সাম্প্রতিক গবেষণায় দু’টি ভাইরাসকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়েছে। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) এবং হার্পিস সিমপ্ল্যাক্স ভাইরাস (HSV-2)। তবে প্রায় ৯৯% সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য HPV এককভাবে দায়ী। এখনো পর্যন্ত HPV-র প্রায় ১০০ ধরণের স্ট্রেইন আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬, ১৮, ৩১ এবং ৪৫ নম্বর স্ট্রেইন দিয়ে প্রায় ৮০% ক্যান্সার হয়ে থাকে। শুধুমাত্র ১৬ নম্বর স্ট্রেইন দিয়েই ৫০% ক্যান্সার হয়!
লক্ষণঃ
প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। রোগ বাড়ার সাথে সাথে যে লক্ষণগুলো প্রকাশিত হয়, সেগুলো হচ্ছেঃ-
১) অনিয়মিত ঋতুস্রাব
২) মেনোপজের ১ বছর পর মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত**
৩) সহবাসের পর রক্তপাত**
৪) দুর্গন্ধযুক্ত শ্বেতস্রাব**
তাছাড়া ক্যান্সারের কোষ শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে গেলে এগুলোর সাথে আরো কিছু উপসর্গ যোগ হয়ঃ-
১) প্রস্রাব এবং/অথবা পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া
২) পেটে এবং/অথবা কোমরে ব্যথা
৩) পেটে পানি জমা
৪) জন্ডিস ইত্যাদি।
এসব লক্ষণ, বিশেষতঃ তারকা(*) চিহ্নিত লক্ষণগুলোর যে কোনো একটি দেখামাত্রই দ্রুত রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। তারপর চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হবেন এবং ক্যান্সারের স্টেজ শনাক্ত করে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।
প্রতিকারঃ
বেশিরভাগ ক্যান্সারের মতো এটিও লক্ষণ প্রকাশের পরে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয় না। তবে দ্রুত শনাক্ত করা গেলে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১ম স্টেজে ধরা পড়লে গড়ে ৮৫% রোগী ৫ বছর কিংবা তারও বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ২য় ও ৩য় স্টেজের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬০% ও ৩৩% এবং সবশেষে ৪র্থ স্টেজে মাত্র ১০%-এ গিয়ে ঠেকে। সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতিগুলো হচ্ছেঃ-
১) সার্জারিঃ এটি শুধুমাত্র রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য প্রযোজ্য। এই পদ্ধতিতে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে বাদ দেয়া হয়।
২) কেমোথেরাপি
৩) রেডিওথেরাপি
৪) প্যালিয়েশনঃ যখন রোগী উপরোক্ত সব চিকিৎসাপদ্ধতির ঊর্ধে চলে যায়, তখন শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করে এবং প্রয়োজনে পায়খানা-প্রস্রাবের বিকল্প রাস্তা চালু করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।
প্রতিরোধঃ***
শুরুতেই বলেছি, সারভাইক্যাল ক্যান্সার প্রায় শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য! সুতরাং আগের সবকিছু ভুলে গেলেও নিজের এবং পরিবারের মঙ্গলের জন্য এই অনুচ্ছেদটি মনে রাখুন।
১) স্ক্রিনিংঃ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সারভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু আছে। ক্যান্সার হওয়ার আগেই ক্যান্সারপূর্ববর্তী অবস্থা শনাক্ত করার মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী রোগ শতভাগ নির্মূল করা সম্ভব।
*কিভাবে স্ক্রিনিং করা হয়? ভায়া(VIA), প্যাপ স্মেয়ার, কল্পোস্কোপি ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের জন্য ভায়া(VIA)-কে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
*স্ক্রিনিং কাদের জন্য জরুরী? ৩০ বছর ও এর অধিক বয়সী সকল মহিলাদের ভায়া টেস্ট করা উচিৎ। বাংলাদেশ সরকারের একটি শ্লোগান আছেঃ- “৩০ বছর হয়ে গেলে/ VIA করতে আসুন চলে”। তবে যাদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে, তাদের বয়স ২৫ বছর হয়ে গেলেই ভায়া টেস্ট করানো উচিৎ। এছাড়া বিয়ের ১০ বছর পুর্ণ হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ভায়া টেস্ট করানো উচিৎ।
* স্ক্রিনিং কোথায় করানো হয়? দেশের সকল সরকারি হাসপাতালে প্রশিক্ষিত নার্স অথবা মহিলা ট্যাকনিশিয়ান দ্বারা ভায়া টেস্ট করানো হয়।
*খরচ কত? ভায়া করাতে কোনো খরচ লাগে না। সরকার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভায়া করে দেয়।
*ব্যথা পাওয়া যায় কি? না! এটি সম্পূর্ণ ব্যথামুক্ত পদ্ধতি।
*কতোক্ষণ সময় লাগে? বেশি না। মাত্র কয়েক মিনিট!
*হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় কি? মোটেও না! বহির্বিভাগেই এই পরীক্ষা করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি চলে যাওয়া যায়।
*ভায়া করার পরে ভায়া নেগেটিভ হলে নীল রঙের একটি কার্ড দেয়া হয়। আর ভায়া পজেটিভ হলে গোলাপি রঙের একটি কার্ড দেয়া হয়।
*ভায়া পজেটিভ হলে কি করবেন? গোলাপি কার্ডটি নিয়ে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চলে যাবেন। তিনি কল্পোস্কোপি করবেন এবং তাতে সন্দেহজনক ফলাফল পেলে সারভাইক্যাল বায়োপ্সি নিয়ে আক্রান্ত টিস্যু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন।
*ভায়া নেগেটিভ হলে কি করবেন? ভায়া নেগেটিভ মানেই যে জীবনে আর সারভাইক্যাল ক্যান্সার হবে না, তা কিন্তু নয়! সুতরাং প্রতি ৩ বছর পর পর নীল কার্ডটি নিয়ে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে এসে ভায়া(VIA), করিয়ে যাবেন। ৫৫(কারো মতে ৬৫) বছর বয়স পর্যন্ত ভায়া নেগেটিভ থাকলে এরপর আর ভায়া করানোর প্রয়োজন নেই।
২) ভ্যাক্সিনঃ এখনো পর্যন্ত এটিই একমাত্র ক্যান্সার, যা টিকাদানের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাজারে দুই ধরণের ভ্যাক্সিন পাওয়া যায়। সারভ্যারিক্স (Cervarix) এবং গার্ডাসিল (Gardasil)। সারভ্যারিক্স বহুল জনপ্রিয়। এটি HPV-র ১৬ এবং ১৮ নম্বর স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। আর গার্ডাসিল ১৬ ও ১৮-র পাশাপাশি ৬ ও ১১ নম্বর স্ট্রেইনের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেয়। গার্ডাসিলের বাড়তি সুবিধা হচ্ছে, এটি সারভাইক্যাল ক্যান্সারের পাশাপাশি মেয়েদের জেনিটাল হার্পিসও প্রতিরোধ করে। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি!
*কখন টিকা নিবেন? টিকা নেয়ার আদর্শ সময় হচ্ছে জীবনের প্রথম সহবাসের আগে, তা সে বিবাহোত্তর হোক, কিংবা বিবাহপূর্বই হোক। তবে বাকিদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। কার্যকারিতা অনুযায়ী টিকাদানের উপযুক্ত মহিলাদেরকে তিনটি বয়সসীমায় ভাগ করা হয়েছেঃ-
প্রথম গ্রুপঃ ৯ থেকে ১৫ বছর। এই বয়সসীমার মধ্যে টিকা নিলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাই স্কুলগামী মেয়েদেরকে টিকাদানের জন্য বেশি করে উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
দ্বিতীয় গ্রুপঃ ১৬ থেকে ২৫ বছর। যদি আগে টিকা নেয়া না হয়ে থাকে, তাহলে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে টিকা নিলেও শর্তসাপেক্ষে সর্বোচ্চ সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।
তৃতীয় গ্রুপঃ ২৬ থেকে ৪৫ বছর। যেহেতু এই বয়সসীমার মধ্যে মেয়েদের যৌনজীবন শুরু হয়ে যায়, তাই বিবাহিত মেয়েদের টিকা নেয়ার আগে অবশ্যই ভায়া টেস্ট করানো উচিত। কারণ জরায়ুতে পরিবর্তন একবার শুরু হয়ে গেলে অথবা ক্যান্সার হয়ে গেলে এই টিকা কোনো কাজে আসে না।
আবারো বলে রাখি, যৌনজীবন শুরু হওয়ার আগেই এই টিকা নেয়া উচিৎ।
*কয়টি ডোজ নিতে হয়? মাত্র ৩ টি। ১ম ডোজ নেয়ার ১ মাস পর ২য় ডোজ এবং ৬ মাস পর ৩য় ডোজটি নিতে হয়।
*কতোদিন সুরক্ষা দেয়? একবার টিকা নিলে সাধারণতঃ আজীবনের জন্য সুরক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু মনে রাখা উচিৎ, টিকা নেয়ার পরেও নিয়মিত প্যাপ(PAP) টেস্ট করানো উচিত। কারণ সাবধানের মার নেই!
*এই টিকা কি সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়? দুঃখিত! ইপিআই শিডিউলে এখনো এই টিকা অন্তর্ভুক্ত হয় নি। ওষুধের দোকান থেকে কিনতে হয়। বাংলাদেশে সারভ্যারিক্স বেশ সহজলভ্য।
*দাম কতো? দাম একটু বেশি, তবে জীবনের চেয়ে বেশি নয়! প্রতি ডোজের মূল্য প্রায় ২ হাজার টাকা।
*গর্ভাবস্থায় এই টিকা দেয়া যাবে কি? না! তাতে মা ও গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তথ্যসূত্রঃ
*Jeffcoate’s Principles of Gynaecology (7th edition)
*National Household Database Bangladesh
*Undergraduate Lectures from Obs. & Gynae. dept., RpMC
*Statistical data: Wikipedia