গত পর্বে আমরা ফিলোফোবিয়া সম্পর্কে বলেছিলাম। আজ আরেকটি অদ্ভুত ভীতির কথা বলবো। বিষয়টা যতোটা মজার, নামটা ঠিক ততোটাই খটমটে। তাই শিরোনামে “প্যারাস্কেভিডেকাট্রায়াফোবিয়া” শব্দটা ব্যবহার করি নি। অবশ্য নামের মধ্যেই ধাঁধার উত্তর লুকিয়ে আছে। গ্রিক ভাষায় প্যারাস্কেভি অর্থ শুক্রবার, ডেকাট্রিস অর্থ তেরো, আর ফোবিয়া মানে ভীতি। পুরোটা জুড়ে দিলে দাঁড়ায় “১৩-ই শুক্রবারভীতি”। অর্থাৎ কোনো মাসের ১৩ তারিখ যদি শুক্রবার হয়, তাহলে ঐদিনে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শুনতে গাঁজাখুরি মনে হলেও এই অদ্ভুত আতঙ্কে ভোগা লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। খোদ আমেরিকার প্রায় ৮% লোক ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থের আতঙ্কে ভোগে। সংখ্যার হিসেবে সেটা আনুমানিক ১৭ থেকে ২১ মিলিয়ন!
ভয়ের কারণটা এবার বলি। জ্যোতিষশাস্ত্রে ১৩ সংখ্যাকে বলা হয় অশুভ সংখ্যা! অনেকের ধারণা, বারোতে সবকিছু পূর্ণ হয়। যেমনঃ ১২ মাস, ১২ যোডিয়াক সাইন, ১২ অলিম্পিয়ান, যীশুর ১২ ভাবশিষ্য, বনী ইস্রাঈলের ১২ গোত্র ইত্যাদি। বারোর পরে যা আসে, তা নাকি অযাচিত এবং অশুভ! প্রাচীন রোমানরা বিশ্বাস করতো, ১২ জন মহান যাদুকর সর্বদা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়, এদের সাথে ১৩ তম সঙ্গী জুটলে সে স্বয়ং শয়তান! তাই অনেকের মতে ১৩ শয়তানের সংখ্যা! একারণে অনেকেই ১৩ সংখ্যাটি এড়িয়ে চলেন। জেনে অবাক হবেন, ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক হোটেলে 12th ফ্লোরের পরে 14th ফ্লোর লিখা থাকে, মাঝখানে 13th ফ্লোর নেই! শুধু তাই নয়, ১৩ নম্বর গলি, ১৩ নম্বর বাড়ি ইত্যাদিরও অস্তিত্ব নেই অনেক জায়গায়! ইংল্যান্ডের মাত্র ২৮% রাস্তায় ১৩ নম্বর বাড়ি আছে!
এ তো গেলো তেরোর ভয়! কিন্তু শুক্রবারের সাথে তেরোর সম্পর্ক কোথায়? গবেষকরা ধর্মগ্রন্থ ঘেঁটে এই প্রশ্নেরও উত্তর বের করেছেন। যীশু খ্রিস্টকে যেদিন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, সেদিন নাকি ছিলো শুক্রবার! এর আগের রাতে যীশুর বিখ্যাত নৈশভোজে (দ্য লাস্ট সাপার) তাঁর ১৩ জন শিষ্য উপস্থিত ছিলেন। ১৩ নম্বর শিষ্যটির নাম ছিলো জুডাস, যে কিনা যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো! তাছাড়া নূহের মহাপ্লাবনের দিনটিও নাকি ছিলো শুক্রবার! আদম নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন শুক্রবারে! কাবিল হাবিলকে হত্যা করেছিলো এই শুক্রবারে! নর্স পুরান অনুযায়ী, ১২ জন নর্স দেবতা ভালহাল্লায় বসে একসাথে নৈশভোজ সারছিলেন। তখন ১৩ নম্বর সভাসদ লোকি সেখানে হাজির হয় এবং আনন্দের দেবতা বাল্ডারের হত্যাকান্ড ঘটায়।

এ তো গেলো ধর্ম আর পুরাণের গল্প! এবার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক! ঐতিহাসিকদের মতে, ১৩০৭ সালের ১৩ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজা ৪র্থ ফিলিপ শতশত নাইট টেম্পলারকে বন্দী করে নির্মম অত্যাচার করেন। সে দিনটি ছিলো শুক্রবার! ১৯৪০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বাকিংহাম প্যালেসে ৫ টি জার্মান বোমা আঘাত হানে এবং প্রাসাদের চ্যাপেলটি পুরোপুরি ধ্বসে যায়। সেদিনও ছিলো শুক্রবার! ১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর শুক্রবার চিলির একটি যুদ্ধবিমান আন্দিজ পর্বতমালা থেকে চালকসহ উধাও হয়ে যায়। ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি শুক্রবার কস্তা কনকর্ডিয়া ক্রুজ নামের একটি জাহাজ ইতালির পশ্চিম উপকূলে নিমজ্জিত হয়ে ৩০ জন যাত্রীর মৃত্য হয়। ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় সন্ত্রাসীরা প্যারিসের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে ১৩০ জনকে হত্যা করে। এরকম অনেক কাকতালীয় ঘটনার কারণে বহু ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানদের কাছে “ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ” একটি অশুভ দিন। তাই এই দিনে তারা ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ রাখে, বিমানভ্রমণ করে না, জাহাজে চড়ে না, কাজে যায় না, অনেকেই সারাদিন ঘর থেকেও বের হয় না! স্বয়ং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এই ফোবিকদের তালিকায় ছিলেন। তিনি ১৩ জনের ভোজসভায় কখনোই বসতেন না, ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থে বিমানেও চড়তেন না। অবশ্য এতো কিছু করেও যে নিয়তি এড়ানো যায় না, তার প্রমাণ নিউ ইয়র্কের ডাজ বাক্সটার নামের এক নাগরিক। ফ্রাইডে দ্যা থার্টিন্থের ভয়ে তিনি ১৯৭৬ সালের ১৩ আগস্ট সারাদিন ঘরের বিছানায় শুয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে সেদিনই তাঁর বেডরুমের মেঝে ধ্বসে পড়ায় তিনি মারা যান। প্রতিদিনের মতো বাইরে বের হলে হয়তো তিনি বেঁচেও যেতে পারতেন! But death waits for us all in Samarra!
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থে বিশ্বজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ডক্টর ক্যারোলিন ওয়াট এই বিষয়টিকে “self–fulfilling prophecy” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কোনো ব্যক্তি যদি নির্দিষ্ট একটি বিষয় সম্পর্কে অমঙ্গলের আশঙ্কা করে, তবে ঐ বিষয়ের মুখোমুখি হওয়ামাত্রই তার দেহে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ বেড়ে যায়, প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চিন্তাধারায় বিঘ্ন ঘটে। ফলে নিজের অজান্তেই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে! ব্যাপারটা অনেকটা এরকম—কাউকে যদি বলা হয় সে অভিশপ্ত, আর ঐ ব্যক্তি যদি এই কথা বিশ্বাস করে বসে, তাহলে সে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। তার রক্তচাপ বেড়ে যাবে এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতায় একসময় সে মারাও যেতে পারে। অর্থ্যাৎ “সে অভিশপ্ত”– এই বিশ্বাসই তাকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। এটাই self–fulfilling prophecy. যা-ই হোক, এই অমূলক ভয় অনেক দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিন বিনিয়োগ ও বেচাকেনা এতোই কমে যায় যে, একেকটি ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থে পুরো আমেরিকা জুড়ে ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার! বিষয়টা এতোই গুরুতর যে, বেশ কয়েকটি দেশে ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থের ভয় নির্মূলের জন্য ঐ দিনে রেড ক্রস ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে ক্যাম্পেইন পর্যন্ত করা হয়!
অবশ্য এই ফোবিয়া থেকে লাভবানও হওয়া যায়! এদিন আমেরিকায় বিমানভাড়া অনেক কমে যায়। সুতরাং চাইলেই যেকেউ এদিন ইকোনোমি ক্লাসের দামে ফার্স্টক্লাসে ভ্রমণ করতে পারেন। অশুভ দিনে কে-ই বা বিয়ে করতে চায়! তাই এ দিন বিয়ের বুকিং দিলে ইংল্যান্ডে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত খরচ বেঁচে যায়! বেশ কিছু ওয়েডিং ভেন্যু এই দিনে ১৩% ছাড় দেয়! তাছাড়া এসব দেশে ১৩ নম্বর বাড়ি বা ফ্ল্যাট খুবই কম দামে কেনা যায়। ১৯০৭ সালের ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে ওয়াল স্ট্রিটের কিছু ব্যবসায়ী শেয়ারবাজার তছরূপ করে দিয়েছিলো।
এবার আসুন এ দিনটি সম্পর্কে জেনে নিই। ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ সব মাসে আসে না। যেসব মাস রবিবার দিয়ে শুরু হয়, শুধুমাত্র সেসব মাসের ১৩ তারিখেই শুক্রবার পড়ে। প্রতি বর্ষপঞ্জিতে সর্বনিম্ন ১ টি থেকে সর্বোচ্চ ৩ টি ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ থাকতে পারে। দুইটি ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ মাস এবং সর্বনিম্ন ১ মাসের ব্যবধান থাকতে পারে। গড়ে ২১২ দিনে একটি করে ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ আসে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এ বছরের জানুয়ারি এবং অক্টোবর মাসে ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ এসেছিলো। পরবর্তী ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থের জন্য আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে! ততোদিন পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকুন! আর পারলে এ ধরণের কুসংস্কার থেকে দূরে থাকুন!
তথ্যসূত্রঃ Wikipedia, Telegraph, The Anxiety & Phobia Workbook: Edmund J. Bourne, Fearof.net: the ultimate list of phobias & fears.