পিরামাসের খোঁজে: ফারাও ২য় রামেসিসের হারিয়ে যাওয়া রাজধানী

0

পিরামাস। ফারাও ২য় রামেসিসের রাজধানী।প্রাচীন মিশরের বিস্ময়গুলোর মাঝে অন্যতম এই পিরামাস নগরী। ফারাও রামেসিস তার সম্পদের বড় একটা অংশ ব্যয় করেছিলেন এই নগরীর পত্তনে-সমৃদ্ধিতে। তারপর হঠাৎই হারিয়ে যায় এককালের সমৃদ্ধ এই নগরী- যেন কখনো অস্তিত্বই ছিলো না। লোকগাঁথাই হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের একমাত্র জানানদাতা।

পত্তনের প্রায় তিন হাজার বছর পর যখন শেষমেশ পিরামাস পুনঃআবিষ্কৃত হলোও তা প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসের অন্যতম অদ্ভুত এক ধাঁধা সামনে নিয়ে এলো। পুনঃআবিস্কৃত এই পিরামাস অবস্থান ছিলো ভুল একটা জায়গায়। এমন এক জায়গায় যেখানে ফারাও ২য় রামেসিসের পক্ষে রাজধানীর নির্মাণ সম্ভবই না, ২য় রামেসিসের জীবনদশায় যে জায়গার অস্তিত্বই ছিলো না।

ফারাও ২য় রামেসিসের রাজধানী

তিন হাজার বছর আগের কথা। ফারাও ২য় রামেসিসের রাজক্তকাল। ফারাও ২য় রামেসিসকে বলা হয় প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক। তিনি তার রাজক্তকালে সমস্ত মিশক জুড়ে অসংখ্য মন্দির-ভাস্কর্য-স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় নীল নদের তীরে আবু সিম্বল মন্দিরের কথা।তবে ফারাওয়ের এ সকল নির্মাণের মাঝে সেরা, তার রাজধানী। পরিকল্পিতাবে গড়ে তোলা অসংখ্য ভাস্কর্য-স্মৃতিস্তম্ভের এক শহর, যার নামকরণও করা হয়েছিলো ফারাউের নামে। পিরামাস।

তখনকার দিনেই প্রায় তিরিশ লাখ লোকের বসতি ছিলো এই শহরে। কিন্তু পত্তনের মাত্র কয়েক শতাব্দী পরই হঠাৎই পিরামাস হারিয়ে যায়। যেন এমন কোনো নগরীই ছিলো না।বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের কথা, প্রত্নতত্ত্ববিদরা দ্বিধায় পড়েন আদৌ কি পিরামাস নামে কোনো নগরী ছিলো না এটা নিছকই লোকগাঁথার অংশ? এই দ্বিধার একটা বড় কারন ততদিনে প্রাচীন মিশরের গুরুত্বপূর্ণ সব নগরী খুঁজে পাওয়া গেলেও মাত্র পিরামাস রহস্যেরই কোনো কূল কিনারা হয় নি। কিন্তু পিরামাসের খোঁজ থেমে থাকে নি। বরং প্রত্বতত্ত্ববিদদের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এক্ষেত্রে আশার বিষয় ছিলো, প্রাচীন নথিসমূহে থাকা পিরামাসের পূর্ণ বিবরণ।প্রাচীন নথি অনুযায়ী,

১) পিরামাসে ফারাও বিশালাকার এক সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন এবং এই শহর থেকেই তার সিরিয়া অভিযান পরিচালিত হয়।

২) পুরো নগরী জুড়ে ফারাও ২য় রামেসিসের অসংখ্য ভাস্কর্য ছিলো এবং প্রতিটি ভাষ্কর্যেই ফারাউের বক্তিগত প্রতীক খোদাই করা। যার অর্থ ‘দেবতা আমুনের প্রিয়জন রামেসিস’।

1ফারাউ ২য় রামেসিসের ব্যক্তিগত প্রতীক
ফারাউ ২য় রামেসিসের ব্যক্তিগত প্রতীক

৩) দেবতা আমুনের মন্দির। নথি অনুসারে পিরামাসে দেবতা আমুনকে উৎসর্গ করে নির্মিত অসংখ্য মন্দির তৈরি করা হয়।

৪) ফারাও ২য় রামেসিস পিরামাসে নিজের জন্য এক বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেন।

৫) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পিরামাসের অবস্থান। নথি অনুযায়ী পিরামাসের অবস্থান ছিলো ‘নীল ডেল্টা’ এর সবচেয়ে পূর্বের শাখার তীরে, যেখানে ফারাওয়ের জন্ম।

তো দেখা যাচ্ছে, প্রত্বতত্ত্ববিদরা জানতেন পিরামাসকে খোঁজে পেতে তাদের ঠিক কি খুঁজতে হবে এবং কোথায় খুঁজতে হবে। যা কাজ অনেকটাই সহজ করে দেবার কথা।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা মোটেও এমন ছিলো না। সমস্যাটা তৈরি হয় ‘কোথায় খুঁজতে হবে’ নিয়ে।

২য় রামেসিসের সময় থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়কালে নীল ডেল্টার শাখাগুলো অনেকবার তাদের দিক পরিবর্তন করেছে। ওই সময়কার সবচেয়ে পূর্বের শাখা নদী এখন বিলুপ্ত। যেখানে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের প্রযুক্তি তিন হজার বছর আগের এই শাখা নদীর অবস্থান খুঁজে বের করতে যথেষ্ট ছিলো না।ফলাফলে পিরামাস সন্ধান আরো কঠিন হয়ে দাড়ায়।

 

পিরামাস
নীল ডেল্টা

পিরামাস সন্ধানের প্রথম সাফল্য আসে ১৯৩০ সালে। বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ প্রত্নতত্ত্ববিদ পিয়েরে মন্টে টানিসে নীল ডেল্টার পূর্বের শুকিয়ে যাওয়া টাইটনিক শাখা অঞ্চলে কিছু ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। টানিস নীল ডেল্টার তুলনামূলক বিচ্ছিন্ন একটা অঞ্চল। বৈরী আবহাওয়ার কারনে এর আগে তেমন কাজও হয় নি।মন্টের আবিষ্কৃত এই ধ্বংসাবশষের সবগুলোতেই ফারাও ২য় রামেসিসের ব্যক্তিগত প্রতীক খোদাই করা ছিলো। সন্দেহ থাকে না এগুলো ২য় রামেসিসের সময়কালের এবং পিরামাসের নগরেরই।অবশেষে পিরামাস নগরীর সন্ধান পাওয়া গেল। অন্তত মন্টে তাই বিশ্বাস করতেন। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো টানিসে মন্টে পিরামাসের যে ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন তার সব ভাষ্কর্যই ছিল অসম্পূর্ণ। তিন হাজার পরে কোনো নগরীর ধ্বংসাবশেষে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলেও টানিসের ভাষ্কর্যের ক্ষেত্রে মাত্রাটা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। কোনো ভাষ্কর্যেরই ভিতের অংশ টানিসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। সুতরাং কিছু প্রশ্ন থেকেই যায় যা এই মন্টের পিরামাসই সেই পিরামাস কিনা তা নিয়ে।যার উত্তরের জন্য প্রত্নতত্ত্ববিদদের আরো তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়।

১৯৬৬ সালে অস্ট্রিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ম্যানফ্রেড বিটেক তার অভিযান শুরু করেন। টানিসের পিরামাস নিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো যাচাইয়েই সিদ্ধান্ত নেন। বিটেক মূলত নীল ডেল্টার শাখাগুলোর গতিপথ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এই লম্বা সময়টার মাঝে নীল ডেল্টার শাখাগুলো অসংখ্যবার তাদের গতিপথের পরিবর্তন করেছে।বর্তমানে এর শাখার সংখ্যা মাত্র দুইটি হলেও ইতিহাসের একেক সময় সংখ্যাটা একেক রকম ছিলো।

বর্তমান নীল ডেল্টা এবং এর শাখাসমূহ
বর্তমান নীল ডেল্টা এবং এর শাখাসমূহ

বিটেক নীলের এখন পর্যন্ত সক্রিয় হওয়া এবং বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সকল শাখা নিয়ে নীল ডেল্টার ম্যাপ তৈরি করেন।পরবর্তী কাজ ২য় রামেসিসের সময় নীলের কোন শাখা সক্রিয় ছিলো তা খুঁজে বের করা।

ম্যানফ্রেড বিটেকের তৈরি করা নীল ডেল্টার ম্যাপ
ম্যানফ্রেড বিটেকের তৈরি করা নীল ডেল্টার ম্যাপ

২য় রামেসিসের সময় সক্রিয় নীলের শাখা খুঁজে পেতে বিটেক যেটার সাহায্য নেন তা হচ্ছে মৃৎশিল্প।প্রাচীন মিশরের শহরগুলো গড়ে ওঠেছিলো নীলের তীরে। নীলের তীরে গড়ে ওঠা এই শহরগুলোর মৃৎশিল্পের ধ্বংসাবশেষ সেখানে এখনো পাওয়া যায় এবং এদের কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে শহরের সময়কাল সম্পর্কেও জানা সম্ভব। এ থকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যাবে ২য় রামেসিসের সময় নীলের কোন কোন শাখা সক্রিয় ছিলো – সবচেয়ে পূর্বের শাখাই বা কোনটা।

বিটেকের সঠিকপথেই ছিলেন এবং যা তিনি আবিষ্কার করেন তা চমকে দেবার মতই। টানিসে পাওয়া ধ্বংসাবশেষ যে পিরামাসেরই সন্দেহ নেই কিন্তু ২য় রামেসিসের সঞয় টানিসের বিলুপ্ত নীলের টাইটনিক শাখাটির জন্মই হয় নি। মন্টের আবিষ্কৃত পিরামাস ছিলো ভুল জায়গায়। তাহলে আসল পিরামাস কোথায়? টানিসে এর ধ্বংসাবশেষ এলোই বা কিভাবে?

বিটেক তার ম্যাপ এবং কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে এটা বের করতে সক্ষম হন ২য় রামেসিসের সময় সবচেয়ে পূর্বে নীলের কোন শাখাটি সক্রিয় ছিলো। প্রাচীন পলুজিয়াক শাখা। বিটেক নিশ্চিত হন পিরামাসও এই বিলুপ্ত শাখার তীরে কোথাও অবস্থিত। কিন্তু কোথায়?

এই পর্যায়ে বিটেক জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ এডাগার পুশের সাথে কাজ করা শুরু করেন।তারা আবিষ্কার করেন পেলুজিয়াক শাখার তীরে কন্তিরে ২য় রামেসিসের সময়কালে সবচেয়ে বড় জনবসতি ছিলো। বিটেক এবং এডগার ধারণা করেন এখানেই হয়ত হারিয়ে যাওয়া পিরামাসের অবস্থান।

কন্তিরের অবস্থান টানিসের ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে। যখন এডগার পুশ প্রথমবার কন্তিরে আসেন প্রাচীন কোনো বসতির কোনো চিহ্নই সেখানে ছিলো না। না কোনো ভাষ্কর্য না কোনো প্রাচীন মন্দির না অন্যকিছু। তার উপর কন্তির এক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল।এমন এক জায়গায় পিরামাস খুঁজে পাবার বিষয়টা অসম্ভবই মনে হয়। দুই প্রত্নতত্ত্ববিদ তবুও হাল ছাড়েন না। ছোট একটা দল নিয়ে খনন কাজ শুরু করেন। মাত্র তিনদিন আর মাটির ১০ সেন্টিমটার খুড়ার পরই সাফল্যের দেখা মিলতে থাকে। ছোট ছোট অনেক প্রমানই বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে বড় সাফল্যটা আসে দশমদিনে। বিটেক-এডগার বিশালাকার এক ঘোড়াশালের সন্ধান পান যা এক সামরিক ঘাঁটির অংশ। অর্থাৎ এখানে বেশ বড় এক সামরিক ঘাঁটি ছিলো ঠিক যেমনটা প্রাচীন নথিতে বর্নণা করা হয়েছে। এতদূর আসার পরও খনন কাজ আরো এগিয়ে নেবা সম্ভব হয় না। কারণ কন্তির ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। এ ধরণের জায়গায় খনন কাজ সত্যিই অত্যন্ত দূরহ। অন্যপথ ভাবতে হয় বিটেক- এডগারকে। সম্পূর্ণ নতুন এক প্রযুক্তির সাহায্য নেন তারা। ইলেক্ট্রোমেগনেটিক স্ক্যানার তখন সদ্য আবিষ্কৃত অপরীক্ষিত এক প্রযুক্তি। এমনকি বিটেক নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না এটা কাজ করবে। কিন্তু ইলেক্ট্রোমেগনেটিক স্ক্যানার তার সক্ষমতার পরিচয় ভালোভাবেই দেয়।কন্তিরে প্রাচীন স্থাপনাগুলোর ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন থাকার কথা যদি তা সত্যই হারিয়ে যাওয়া পিরামাস হয়ে থাকে। ইলেক্ট্রোমেগনেটিক স্ক্যানার মাটির নীচে ঠিক এটাই খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। সমগ্র অঞ্চল জুড়েই এরকম প্রাচীন মন্দির, ভাষ্কর্য, দেয়াল, রাস্তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। শেষপর্যন্ত প্রমাণিত হয় কন্তিরই ২য় রামেসিসের হারিয়ে যাওয়া পিরমাস নগরী।

ইলেক্ট্রোমেগনেটিক স্কেনে পাওয়া পিরামাস নগরীর ধ্বংসাবশেষ
ইলেক্ট্রোমেগনেটিক স্কেনে পাওয়া পিরামাস নগরীর ধ্বংসাবশেষ

পিরামাস রহস্যের অনেকটাই সমাধান হয়। তবে প্রশ্ন থেকেই  যায় – টানিসে, ৩০ কিলোমিটার দূরে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ কিভাবে পৌঁছালো?

কন্তিরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা নগরীর যে কাঠামো আবিষ্কার করেন তাতে দেখা যায়, পিরামাস নগরের কাঠামো অনকেটা বর্তমান সময়ের ভেনিসের মত। নীল নদ থেকে অসংখ্য কৃত্রিম শাখার মাধ্যমে নদ থেকে পানি নগরীতে প্রবেশ করেছিলো। এই নদই ছিলো নগরীর জীবনীশক্তি আবার এই নদই নগরীর ধ্বংসের কারন।

ফারাউ ২য় রামেসিসের মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরই নীলের পলুজিয়াক শাখা পুরোপুরি শুকিয়ে যায় এবং নতুন টাইটনিক শাখার জন্ম হয়। পলুজিয়াক শাখা শুকিয়ে যাওয়ায় পিরামস বসবাসের অনুপোযগী হয়ে পড়ে। তবে তারপরও এই নগরীর বাসিন্দারা কিন্তু নগরীকে পরিত্যাক্ত করে নি বরং অভিনব এক কাজ করে। নগরীর প্রতিটি ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে প্রতিটি ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে টেনিসে নগরী পুনঃনির্মাণ করে।এ কারণেই টানিসে পিরামাসের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় যদিও তা পিরামাস ছিলো না।

মন্টের হাত ধরে শুরু হওয়া ‘পিরামাস রহস্য সমাধান’ বিটেক- এডগারের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সমাপ্ত হয়। খুঁজে পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া পিরামাস।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More