বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ

0

বাংলাদেশের বীরশ্রেষ্ঠদের ইতিহাস যতো পড়বেন ততোই অবাক হবেন মাঝেমধ্যে ভুলে কোন একশন ইংলিশ মুভির স্ক্রিপ্ট পড়ছেন মনে করে। দুনিয়াতে স্বার্থহীন মানুষ যদি থাকে তবে দেশের বীরশ্রেষ্ঠরাই অন্যতম। অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেন নি।

তেমনই আরেকজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন যিনি মর্টার শেলের আঘাতে ডান কাঁধ হারিয়েও রাইফেল হাতে পিছ হতে কভার দিয়ে শেষ নিশ্বাস অবধি সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়েছিলেন।

হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের সামনে শেলের আঘাতে জর্জরিত এক ই.পি.আর সৈনিক মাত্র একটি রাইফেলের সীমিত গুলি দিয়ে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সক্ষম হয়েছিলেন বাকিদের বাঁচাতে।

তিনি একাই ছিলেন একশো যোদ্ধার সমান, একজন বীরশ্রেষ্ঠ। মাত্র একটা সাধারণ এলএমজি মেশিন গান দিয়ে এবং আহত হওয়ার পরে একটা রাইফেল দিয়ে এতোটা ক্ষতিসাধন করে তিনি শত্রুপক্ষের বিষোধগারে পরিণত হয়েছিলেন তা তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসার পরে বেয়নেট দিয়ে বিকৃত, নৃশংসভাবে খুঁচিয়ে চোখ উপড়ে ফেলার মতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

বাংলার সে বীর সন্তানটির নাম নূর মোহাম্মদ শেখ, যার জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার অন্তর্গত নড়াইল সদরের চন্ডীপুকুরস্থ মহিষখোলা গ্রামে।

একজন বলীয়ান, অকুণ্ঠ আর সাহসী একজন ই.পি.আর সৈনিক। পিতা মোহাম্মদ আমানত ছিলেন একজন কৃষক আর মাতা জেন্নাতুন্নেসা ছিলেন গৃহিণী তবে খুব অল্প বয়সেই পিতামাতাকে হারিয়ে ডানপিটে এই বালকের শিক্ষাজীবন শেষ হয় সপ্তম শ্রেণীতেই।

গানবাজনা, যাত্রাপালায় প্রচণ্ড শৌখিন ছিলেন আর গানের গলাও ছিল অসাধারণ তাঁর। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেঁচে নেন কৃষকের মেয়ে তোতাল বিবিকে। স্থানীয় আনসার বাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করলেও তাতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো। পরে চাকরীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ

শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তাঁর সাহসিকতা, উদ্যমতার কারণে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ই.পি.আর) এ যোগ দিয়ে। বহুদিন দিনাজপুর সীমান্তে নিজের কর্মজীবন পার করে অবশেষে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই তিনি যশোর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে বদলি হন এবং ওইসময়ে তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান

৭১ এর উত্তাল সময়। চারিদিকে ধ্বংসযজ্ঞ তাঁর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিলো। নিরীহ বাঙ্গালীর উপর হত্যাযজ্ঞ কতোটা নাড়া দিয়েছিলো তার একটা নমুনা তাঁরই ছেলের সাথে একটা ঘটনার মাধ্যমে বুঝা যায়।

মার্চে যেদিন ছেলের সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন নূর মোহাম্মদ তাঁর ছেলেকে নিয়ে সাইকেলে যাচ্ছিলেন। তাঁর হাতে থাকা একটা কঞ্চির খোঁচায় নূর মোহাম্মদ শেখের কপাল কেটে রক্ত বের হয় আর তা দেখে ঘাবড়ে যায় তাঁর ছেলে মোস্তফা কামাল আর বলে উঠে,
বাবা দেখো, কত রক্ত … !!
উত্তরে পিতা নূর মোহাম্মদ শেখ বললেন,
আরও কতো রক্ত ঝরবে … !!

কিশোর বালক মোস্তফা সেদিন বাবার কথা বুঝতে পারেনি, জানতে পারেনি তাঁর বাবা দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন মনে লালন করছেন। ওইটাই ছিল পিতা-পুত্রের শেষ দেখা

২৫ শে মার্চ ১৯৭১ … !! নূর মোহাম্মদ শেখ যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় ৮ নং সেক্টরে সরাসরি অধিনায়ক পদে যোগদান করেন এবং সুতিপুর গোয়ালহাটি গ্রামের সামনে স্থায়ী টহল স্থাপন করেন যা নিজেদের রক্ষার্থে অনেক প্রয়োজনীয় ছিল।

৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ … !! আগে হতেই গুটিপুর ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণের নতুন পরিকল্পনায় ব্যস্ত হানাদার বাহিনী যার জন্যে দুইজন সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে দৃঢ় বলয়ে পাহারা দিচ্ছেন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ।

সকাল তখন সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। গগনে সূর্যের তাপ তখনো অতোটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেনি।
টহলের দায়িত্বে থেকে প্রতিনিয়ত নজর রাখছেন শত্রুপক্ষের উপর কিন্তু বিধিবাম সেদিন নজরে পড়ে গেলেন তাঁরা।পাকবাহিনী মুহূর্তের মধ্যেই তিন দিক হতে ঘিরে ফেললো তাঁদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে। প্রচণ্ড রকমের গুলি বর্ষণ করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে হানাদার বাহিনী।

দুঃখের বিষয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদারকে ট্যাকল দিতে মুক্তিবাহিনীর কাছে ছিল একটি এল.এম.জি আর দুইটি রাইফেল তাছাড়া এম্যো প্রায় শেষের পথে। তাছাড়া তিনজন মুক্তিযোদ্ধার বিপক্ষে বিশাল হানাদার বাহিনীর দল যাদের প্রতিরোধে সামান্য গুলি কিছুই না কিন্তু নূর মোহাম্মদ শেখ চিন্তা করতে লাগলেন, প্রতিরোধ ব্যতীত পিছু হটলে বরং হানাদার বাহিনী অতিদ্রুত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে যা মোটেও সুখকর অভিজ্ঞতা হবে না। তাই যতক্ষণ সম্ভব প্রতিরোধ করতেই হবে। এতে বরং মূল ক্যাম্পের যোদ্ধারা পিছু হটতে পারবে বা মোকাবিলা করার সময় পাবে।

এতো চিন্তা ভাবনার মধ্যে হানাদার বাহিনীর গুলি করা বন্ধ হয়নি। ইতিমধ্যে অন্য যোদ্ধা নান্নু মিয়া গুলি খেয়ে আহত হলেন। এখন কিছুতেই চিন্তাভাবনায় সময় নষ্ট করা সম্ভব না। একদম তড়িৎ সিদ্ধান্তে নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নিলেন এবং হাতে তুলে নিলেন নান্নু মিয়ার হাতে থাকা এল.এম.জি’টা। শুরু করলেন গুলি চালানো।
এক কাঁধে নান্নু মিয়া আর অন্যদিকে এল.এম.জি হাতে দুর্বার গতিতে গুলি চালানোতে পাকবাহিনী অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়লো।

এ মুহূর্তে নূর মোহাম্মদ শেখ একটা বুদ্ধি স্থির করলেন। হাতের একটামাত্র এল.এম.জি নিয়ে একবার এই পয়েন্ট থেকে গুলি করে তো আবার অন্য পয়েন্টে চলে যান এবং গুলি করেন। এতে করে হানাদার বাহিনীর মনে ভ্রান্ত ধারণা হল মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় একজন নয় বরং আরও অনেকেই আছে। তারা স্তম্ভিত হয়ে গুলি করা কমিয়ে দিলো। এই সুযোগটা নূর মোহাম্মদ হাতছাড়া করলেন না বরং নান্নু মিয়াকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন।

তবে ভাগ্য নেহায়েত নিষ্ঠুর রূপে দেখা দিলো যখন আচমকা মর্টার শেলের গোলা এসে নূর মোহাম্মদের ডানপাশে পড়লো। শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে নূর মোহাম্মদের হাঁটু প্রায় ভেঙ্গে গেল এবং কাঁধে বিরাট এক ক্ষতের সৃষ্টি হল। দেশমাতৃকার মাটি সিক্ত হল তাঁর পবিত্র রক্তে কিন্তু সুর্যসন্তান এতটুকুতেই দমে যাওয়ার পাত্র নহে। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে দেখেও তিনি স্থির থাকলেন এবং সহযোদ্ধা সিপাহী মোস্তফা কামালকে অধিনায়কের দায়িত্ব সমর্পণ করে হাতে থাকা এল.এম.জি টা তুলে দিলেন নতুন অধিনায়কের হাতে এবং এস.এল.আর’টা চেয়ে নিলেন নিজের জন্য কারণ তিনি জানেন বড় ধরণের অলৌকিক কোনকিছু হওয়া ব্যতীত তাঁর মৃত্যু অনিবার্য সুতরাং মৃত্যুর পরে শত্রুপক্ষের হাতে এল.এম.জি গান’টা যাক তা তিনি চান না।

এবার তিনি সোচ্চার হয়ে আদেশ দিলেন মোস্তফা কামালকে,
মোস্তফা কামাল, তুমি নান্নু মিয়াকে নিয়ে দ্রুত সরে পড়ো। আমি শত্রুপক্ষকে যতোটা পারি দমিয়ে রাখবো।

যে কেউ এমন আত্মত্যাগের দৃশ্য দেখলে হতবিহব্বল হয়ে পড়বে স্বাভাবিক। সিপাহী মোস্তফা কামালও ব্যতিক্রম নয়। বিস্ময় কাটিয়ে বললেন,
আপনাকে এ অবস্থায় রেখে কেমনে যাই?

বলামাত্র আগ বাড়িয়ে আহত নূর মোহাম্মদকে কাঁধে তুলে নিতে চাইলেই গোঙিয়ে উঠলেন নূর মোহাম্মদ। শরীরটা তাঁর বড়ই নাজুক হয়ে পড়েছে। ক্ষতগুলো বেশ ভোগাচ্ছে কিন্তু প্রচণ্ড মনোবল তাঁকে তখনো অবধি বাঁচিয়ে রেখেছিলো আবার গোঙানি-স্বরে পাশের গাছের শেকড় আঁকড়ে ধরে ধমক দিয়ে বললেন,

আরে। করছ কি?? থামো, থামো। উঁহ, লাগছে! লাগছে! সরো মোস্তফা।

ঘাবড়ে গেলেন সিপাহী মোস্তফা কামাল, অনুতপ্ত হলেন এই ভেবে পাছে তিনি ক্যাপ্টেনকে আঘাত করে ফেললেন ভেবে।
নূর মোহাম্মদ বিষয়টা বুঝতে পেরে মোস্তফা কামালের হাত দুটি মুঠ করে ধরে ধীর স্বরে বলীয়ান-ভাবে বললেন,

আল্লাহর দোহাই মোস্তফা, ভালো করে শুনো। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, যেভাবে জখম হয়েছি তাতে আমার আর বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেভাবে রক্তপাত হচ্ছে তাতে এখন হতেই আমার শরীর ঝিমঝিম করছে, চোখেও ঝাপসা দেখছি। এমতাবস্থায় আমাকেও নিতে গেলে তোমরা দুজনও মারা যাবে। তিনজন মরে যাওয়ার চেয়ে দুজন বেঁচে থাকা কি ভালো নয়? দেশের স্বাধীনতাকে আনার জন্য তোমাদের বাঁচতে হবে। আমি বলছি, তোমরা সরে যাও।

মোস্তফা কামাল হতভম্ব, মন কিছুতেই তাঁর সায় দিচ্ছে না ক্যাপ্টেনকে ছেড়ে যেতে কিন্তু যেতে তো হবেই। নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে এলএমজি নিয়ে দ্রুত পিছু সরে যেতে লাগলেন।

পিছ হতে আহতাবস্থায় বীরবেশে নূর মোহাম্মদ শেখ একাই প্রতিরক্ষার দুর্গ গড়ে তুললেন। সে এক কঠিন যুদ্ধ যা কোন স্ক্রিপ্টের দুঃসাহসিক অভিযানকেও হার মানাবে।
এ যুদ্ধ দেশকে আরেকবার বিজয়ের মালা পড়ানোর যুদ্ধ। একটি মাত্র হালকা রাইফেল আর ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে যতোটা সম্ভব সামনে থাকা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে লাগলেন।

বেশিক্ষণ পারলেন না, প্রচণ্ড রক্তপাতের ফলে একসময় শরীর নেতিয়ে পড়লো তাঁর। শেষ নিশ্বাস অবধি রাইফেলের ট্রিগার চেপে ধরে শত্রুপক্ষকে যতোটা সম্ভব ঘায়েল করতে লাগলেন। বিলিয়ে দিলেন নিজেকে আর বাঁচিয়ে দিলেন সহযোদ্ধাদের।

নতুন জীবন ফিরে পেয়ে সহযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলেন পাকবাহিনীর উপর। এতোটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন তাঁরা যে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না হানাদার বাহিনী। তারা পিছু হটার সাথে সাথেই অন্যান্যরা নূর মোহাম্মদ শেখের সন্ধানে বেরলেন। এক ঝাড়ের মধ্যে নূর মোহাম্মদ শুয়ে আছেন দেশের মাটির উপর। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখা গেলো, পাক হায়েনারা মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি সমূলে ধ্বংস করতে না পারার ক্ষোভ এই বীর সন্তানের উপর ঝেড়েছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছিলো তাঁর দুটো চোখ, সেই চোখ যে চোখে স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন বাংলার।

মৃত্যুকে জয় করতে পেরেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ কারণ যারা দেশের জন্য, দশের জন্য জীবন দিতে পারে কে বলে তাঁরা মৃত? তাঁরা বেঁচে থাকে তাঁদের মধ্যে যাদের জন্যে অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন।
যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘তগমা-এ-জং’ ও ‘সিতারা-এ-হরব’ পদকে ভূষিত করেন এবং ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি প্রদান করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ স্মৃতিস্তম্ভ

মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। বাংলার স্বাধীন দেশের রূপকার এই বীর-সন্তানকে যশোরের কাশীপুর গ্রামে সমাহিত করা হয়। তিনি চলে গেলেন তবে তাঁর দ্বারা রচিত হল লাল সবুজের একটি ছোট্ট দেশের কাহিনী যার নাম বাংলাদেশ।

 

(বিভিন্ন তথ্যসূত্রের জন্য বিভিন্ন ব্লগ, আর্টিকেল এবং উইকিপিডিয়া হতে সাহায্য নেয়া হয়েছে)

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More