আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে উদ্ভব হয়েছে হাজার হাজার জনগোষ্ঠীর। এক এক ধরনের জনগোষ্ঠীর ছিল এক এক রকমের প্রথা । এসকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু কিছু জনগোষ্ঠী যারা ছিল বর্বর ও হিংস্র। শত্রুকে পরাজিত করার পর তাদের মাথা কেটে সংরক্ষণ করা ছিল তাদের নেশা, অন্যভাবে বলতে গেলে প্রথাও। এরকম ৫ টি জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আজ ইতিবৃত্ততে থাকছে একটি লিখা। আশা করছি সেইসকল বর্বর জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কিছু ধারনা পাঠকরা আজ পাবেন। প্রথমেই আসছি HEADHUNTING বা মাথা শিকার কি এই ব্যাপারে। হেডহান্টিং হচ্ছে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করার পর সেই ব্যক্তির মাথাকে বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করা। ঐতিহাসিক সময়ে ওশেনিয়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা, মেসোমিয়ারিকা এবং ইউরোপের বেশ কিছু অংশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হেডহান্টিং প্রথা প্রচলিত ছিল। চলুন কথা না বাড়িয়ে জেনে নেয়া যাক সেইসব মাথা শিকারি জনগোষ্ঠীর পরিচয়।
১. ‘মাওরি’ জনগোষ্ঠী
মূলত মাওরিদের উৎপত্তি পূর্ব পলিনেশিয়ায়। পলিনেশিয়ানদের মধ্যে কিছু ঔপনিবেশিকরা তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি তৈরি করে যা পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডে পৌঁছানোর পর মাওরি নামে পরিচিত হয়েছিল। তাই অনেকের মতে নিউজিল্যান্ড এর আদি অধিবাসীদের বলা হয়ে থাকে ‘মাওরি’। ধারনা করা হয় আনুমানিক ১২৫০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নিউজিল্যান্ড এ পৌঁছানোর পর মাওরিরা পলিনেশিয়ান প্রথা অনুযায়ী একটি উপজাতি গোষ্ঠী গঠন করে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শক্তিশালী যোদ্ধাদেরও উত্থান হয়েছিলো। মাওরির অন্যতম সেরা ও ভয়ঙ্কর যোদ্ধা হিসাবে ‘হঙ্গি হিকা’ এর নাম আছে সবার উপরে। ধারনা করা হয় ১৭৭৮ সালে হঙ্গি হিকার জন্ম হয়।
মাওরিদের মাথা শিকার ও সংরক্ষণ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য –
শত্রুদের হত্যা করার পরে বর্বর মাওরি জনগোষ্ঠী অত্যন্ত যত্নসহকারে মাথার মগজ ও চোখ অপসারণ করত। এরপর মাথার খুলির ক্ষতমুখগুলি আঁশ, মোম ও আঠার মাধ্যমে বন্ধ করে পুরো মাথাটিকে সিদ্ধ করা হতো চুলাতে। কয়েকদিন রোদে শুকানোর পড়ে পুরো মাথাটিতে হাঙ্গরের তেল ব্যাবহার করে সংরক্ষণ করা হত।
অনেকের মতে শত্রুর মাথা সংরক্ষণ এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পরবর্তীতে তারা যাতে ঐ ব্যক্তিকে নিয়ে উপহাস করতে পারে। এক ধর্মপ্রচারক মাওরির জনগোষ্ঠীর প্রধান কে শত্রুপক্ষের প্রধানের কাটা মাথা হাতে নিয়ে বলতে শুনেছেন “তুমি পালাতে চেয়েছিলে তাইনা! কিন্তু আমার জনগোষ্ঠী তোমাকে পাকড়াও করেছে এবং তোমাকে রান্না করেছে। তোমার পিতা কোথায়! তাকেও রান্না করা হয়েছে। তোমার ভাই কোথায়! তাকে খাওয়া হয়েছে। তোমার স্ত্রী কোথায়! ঐ যে সে বসে আছে, সে এখন আমার স্ত্রী।
তোমার সন্তানরা কোথায়! তারা এখন আমার ভৃত্য”। এছাড়াও কাটা মাথাগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে তারা মত্ত হয়ে উঠত উদ্ভট খেলায়।
মাথা সংরক্ষণের পাশাপাশি নরমাংস ভক্ষণ করাও তাদের আরও একটি প্রথা। যদিও এই প্রসঙ্গে অনেক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। কিছু ঐতিহাসিকবিদদের মতে ইউরোপিয়ানরা বিভিন্ন চিত্রকর্মতে মাওরি জনগোষ্ঠীকে নরমাংস ভক্ষক হিসাবে তুলে ধরেছে। কিন্তু মাওরিদের ইতিহাস ও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও প্রমাণ থেকে ধারনা পাওয়া যায় যে তারা যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করার পর তাদের মাংস ভক্ষণ করত। অনেকেই মনে করতে পারে যে ক্ষুধা নিবারণের জন্য হয়ত তারা নরমাংস ভক্ষণ করত। কিন্তু বেপারটি আসলে সেরকম কিছু না। মাওরিদের মতে এই নরমাংস ভক্ষণ করা ছিল শত্রুদের অপমান করার অন্যতম প্রধান উপায়।
২. ‘জাইভারও’ জনগোষ্ঠী
দক্ষিণ আমেরিকান ভারতীয় লোকেরা ‘জাইভারও’ নামে পরিচিত। জাইভারও জনগোষ্ঠী আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব ঢালে বসবাস করত। মাথা-শিকার ও কাটা মাথাকে তার প্রকৃত আয়তনের থেকে আরও সঙ্কুচিত করার দিক থেকে সবচেয়ে কুখ্যাত জনগোষ্ঠী হিসাবে এরা বহুল পরিচিত। এরা এমন ভাবে শত্রুর মাথা সঙ্কোচন করে থাকে যে যদি আপনি একটি কমলা হাতে নেন তাহলে জাইভারওদের দ্বারা সঙ্কুচিত হওয়া শত্রুর মাথাটির আয়তন হবে আপনার হাতের কমলাটির মত। সাধারণত বছরে ১ বার তারা মাথা শিকার করে থাকে।
জাইভারওদের মাথা শিকার ও সঙ্কুচিত করা প্রসঙ্গে কিছু তথ্য –
এরা সাধারণত প্রতি হামলার জন্য তাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী কোন ঘর কে বেছে নেয়। তারপর আক্রমণ করে প্রথমেই বাড়ির পুরুষদের হত্যা করে, বয়স্ক মহিলাদেরকে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে হত্যা করে এবং ঐ বাড়ির অল্পবয়স্ক মহিলাদেরকে তাদের নববধূ হিসাবে গ্রহণ করে।
যাদের হত্যা করা হয় তাদের কাটা মাথাগুলো সংগ্রহ করা হলে প্রথমে তার মাথার খুলিটি উলম্বভাবে কেটে ফেলে। তারপর মাথার খুলি এবং চোয়ালের হাড় অপসারণ করা হয়। কাটা মাথাটিকে প্রথমে গরম করা হয় এবং পরে গরম পাথর ও বালির সঙ্গে মিশ্রিত করে সমগ্র মাথাটিকে একটি কমলার আকার এর মত সঙ্কুচিত করে ফেলা হয়। এরপর মাথা ও ঠোঁট কে একসাথে সেলাই করা হয়।
জাইভারওরা বিশ্বাস করে যে অন্যদের মাথা কেটে নেয়ার মাধ্যমে তাদের এক ধরনের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা অর্জিত হয়। জাইভারও জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাথা কেটে সংরক্ষণ করার জন্য কিছু খণ্ড খণ্ড উপদল ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উপদলটির নাম ছিল ‘শুয়ার’। বর্তমানে মাথা কেটে সংরক্ষণ করার রীতিটি আর চর্চা হয়না, তবে তারা এখনও পর্যটকদের কাছে বিক্রয় করার জন্য কিছু প্রতিরূপ তৈরি করে থাকে।
৩. ‘দ্য মেরিন্ড-অ্যানিম’ জনগোষ্ঠী
ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া প্রদেশটিতে একসময় ভয়ঙ্কর জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল যাদেরকে বলা হতো দ্য মেরিন্ড-অ্যানিম জনগোষ্ঠী বা মেরিন্ড-অ্যানিম। মাথা শিকার ও সংরক্ষণ এর দিক থেকে তারা বিখ্যাত ছিল। তাদের কাছে কারো মাথা কেটে ফেলার অর্থ ছিল তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা তাদের নিজেদের দখলে নিয়ে আশা। কারণ এই জনগোষ্ঠীর মতে মাথা হচ্ছে সকল প্রকার আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। প্রতি বছর তারা তাদের নিজেদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু বড় বড় দল তৈরি করে এই মাথা শিকারে অংশগ্রহণ করার জন্য। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই মেরিন্ড-অ্যানিম জনগোষ্ঠীর মাথা শিকার প্রসঙ্গে তেমন কোন ধারনা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে ‘ভেন বাল’ নামক এক ব্যক্তি এই মাথা শিকারের বিষয়টি খোলাসা করেন।
‘দ্য মেরিন্ড-অ্যানিম’ জনগোষ্ঠীর মাথা শিকার ও সংরক্ষণ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য –
- প্রথমত এই মাথা শিকার তাদের কাছে একটি আনন্দদায়ক খেলার মত।
- তারা নরমাংস ভক্ষক। তারা শত্রুর মাথা শিকারের পর নরমাংস ভক্ষণের উৎসবে মত্ত হয়।
- ‘দ্য মেরিন্ড-অ্যানিম’ জনগোষ্ঠীর শিশুদের নামকরণের একটি প্রথাও এই মাথা শিকার ও সংরক্ষণের সাথে জড়িত। প্রত্যেকটি বাচ্চার নামকরণ করা হয় কাটা মাথাওয়ালা ব্যক্তির নামের সাথে মিল রেখে। এবং ঐ কাটা মাথাটি ততদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয় যতদিন না ঐ শিশুটির মৃত্যু হয়।
৪. ‘দ্য সেলটস’ জনগোষ্ঠী
লৌহ যুগের ইন্দো-ইউরোপীয় সেলটিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীদের বলা হতো সেলটস। মূলত তাদের মাথা শিকারের অন্যতম কারণ ছিল ধর্মীয়। কিন্তু পরবর্তীতে অনেকেই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে এবং তারপরও তারা এই মাথা শিকারের প্রথাটি থেকে বের হয়ে আশতে পারেনি। প্রাচীন রোমান ও গ্রিকদের মতে সেলটসরা বর্তমান সময়কার শিকারিদের মত মাথা শিকারের পর সেই মাথাগুলোকে পেরেকের সাহায্যে দেয়ালের সাথে ঝুলিয়ে রাখত এবং কাটা মাথাগুলোকে তারা যুদ্ধে যাওয়ার সময় ঘোড়ার গলায় ঝুলিয়ে রাখত। সেলটসরা ছিল ভয়াবহ যোদ্ধা ও মদ্যপায়ী। প্রতি যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে তারা তাদের মনোরঞ্জনের জন্য বড়সড় মদের আসরের ব্যবস্থা করত।
‘ দ্য সেলটস’ জনগোষ্ঠীর মাথা শিকার ও সংরক্ষণ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য-
প্রতিষ্ঠিত কোন প্রতিপক্ষের সাথে জয় পেলে সেলটসরা তাদের প্রতিপক্ষের মাথা কেটে নিয়ে আসত। প্রত্যেকটি কাটা মাথা তাদের কাছে ছিল পুরস্কারস্বরূপ।
তারপর কাটা মাথাটিকে তারা দারুবৃক্ষ দিয়ে সুবাসিত করে জনসম্মুখে সেই মাথাগুলি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করত ।
অন্যান্য মাথা শিকারি জনগোষ্ঠীর মত তাদের বিশ্বাস ছিল যে একজন ব্যক্তির আত্মা তাদের হৃদয়ে ছিল না বরং সেটি ছিল তাদের মাথায়।
৫. ‘দ্য সাইথিয়ানস’ জনগোষ্ঠী
মূলত সাইথিয়ানসরা ছিল ইরানী ইউরেশীয় যাযাবর জনগোষ্ঠী যারা কালো সাগর ও ককেশাস পর্বতমালার উত্তরে বসবাস করত। পরবর্তীতে তারা মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ রাশিয়া ও ইউক্রেনে স্থানান্তরিত হয় ও একটি ধনী এবং শক্তিশালী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে যা বর্তমানে ‘ক্রিমিয়া’ নামে পরিচিত। ইউরোপের সাইথিয়ানসরা ছিল চমৎকার অশ্বারোহী ও বর্বর মাথা শিকারি জনগোষ্ঠী। তাদের বর্বরতার জন্য প্রাচীন দার্শনিক হেরোডোটাসও এই জনগোষ্ঠীর নাম তাঁর লিখায় উল্লেখ করেছেন। পার্সিয়ান অনেক শাসক তখন এই জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদের জন্য জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। তখন অনেকেই বলত যে “তারা যুদ্ধ করার জন্যই বাঁচত এবং বাঁচার জন্যই যুদ্ধ করত” ।
‘দ্য সাইথিয়ানস’ জনগোষ্ঠীর মাথা শিকার প্রসঙ্গে কিছু তথ্য-
মূলত তারা ঘোড়ার পিঠে চেপে তীর ও ধনুকের সাহায্যে শিকার করত। তারা ছিল নিখুঁত লক্ষ্যভেদী।
শিকারের পর তারা শত্রুর গলা কেটে মাথাটি নিয়ে নিত। এই ব্যাপারে নারী, পুরুষ, বয়স্ক বা শিশু কাউকেই তারা কোন ছাড় দিতনা। পরবর্তীতে তারা মাথার খুলিগুলোকে পেয়ালা হিসাবে ব্যাবহার করত।
সাইথিয়ানসরা নরবলিতে বিশ্বাসী ছিল। এমনকি নিজ জনগোষ্ঠীর লোকদেরকেও নরবলি দেয়া হতো।
তারাই ছিল একমাত্র উপজাতীয় জনগোষ্ঠী যারা পশুপাখির আদলে স্বর্ণের বিভিন্ন গহনা তৈরি করত।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://www.theclever.com
২. https://en.wikipedia.org
৩. http://listverse.com
lamisil 250mg ca – buy griseofulvin pills purchase grifulvin v generic