কি বলব অবিশ্বাস্য একটা ম্যাচ! ফুটবলপ্রেমীদের জন্য স্মরণীয় একটা রাত। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ কেন এত বড় একটা মঞ্চ ফুটবলে এই ম্যাচেই তার প্রমাণ। আর বড় ম্যাচ মানেই বড় দলগুলোকে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে মেলে ধরতে হবে। একটা মিলিসেকেন্ডের ভুলে শেষ হয়ে যেতে পারে ৯০ মিনিটের সব পরিশ্রম। হতে হবে নিখুঁত। তো দেখা যাক, কিভাবে মাদ্রিদ এই কণ্টকময় পথ পার করল।
এওয়ে লেগে ২-১ গোলে এগিয়ে থাকাই মাদ্রিদ ছিল কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে। কিন্তু পার্থক্যটা খুব বেশি নয়। আর কার্ভা, ইস্কোর ইনজুরিও মাদ্রিদকে কিছুটা ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়। হ্যাঁ, এইটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বায়ার্নেরও ইনজুরির সমস্যা ছিল। তবে রিয়াল আর বায়ার্নের এই ইনজুরির মধ্যে বড় পার্থক্য হল, ইনজুরির জন্য বায়ার্নের কোন প্লেয়ারকে নিজের পজিশন ছেড়ে খেলতে হয় নি। কিন্তু রিয়ালের এই সমস্যাটা ছিল। স্কোয়াডে কোন অভিজ্ঞ রাইটব্যাক না থাকায় আর নাচো ফিট না থাকায় জিদানের শেষ সম্বল ছিল এই ভাসকেস। জিদান জানত, ভাসকেসকে রাইটব্যাক হিসেবে খেলালে আক্রমণভাগ দুর্বল হয়ে যাবে কিন্তু এ ছাড়া কি তার হাতে আর ভাল কোন বিকল্প ছিল? হাকিমি বড় ম্যাচের জন্য পরীক্ষিত না। বরং টটেনহাম আর লীগ ম্যাচেই দেখেছি সে কিভাবে শিশুসুলভ ভুল করেছে।
খেলা শুরুর আগেই মোটামুটি সবাই বুঝতে পেরেছিল মাদ্রিদের সব থেকে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এই ম্যাচে ডান প্রান্ত। রিবেরীর সাথে আলাবার জুটি এইটাও নিশ্চিত করল যে, এই ডান প্রান্তে পুরো রাজত্ব করবে বায়ার্ন। বাস্তবতা বলেও তাই।
৪২% আক্রমণ শুধুমাত্র ডান প্রান্তেই। ভাবা যায়, ম্যাচের অর্ধেক আক্রমণ হয়েছে শুধু মাত্র ডান প্রান্তেই। রিবেরী, আলাবার জুটি ভাসকেসের জন্য অনেক বেশি চাপ ছিল। কারণ ভাস্কেস, রাইট ব্যাক না। তাই প্রথমেই সে যে সমস্যাটা পড়েছিল। সে বুঝতে পারছিল না কার রান আপ মার্ক করবে। কোথায় মার্ক করবে। এবং ম্যাচের সম্ভবত ১৫-১৭ মিনিটের দিকে সে গিয়ে জিদানের সাথে কথাও বলে। এর পরেই জিদান, মদ্রিচ কে বলে ডান প্রান্তে থাকতে ভাসকেসকে সাহায্য করার জন্য। সোজা কথায়, মাদ্রিদের ফলস ব্যাক হিসেবে কালকে খেলেছে মদ্রিচ। তার টাচগুলো দেখলেই সেইটা বুঝা যায়।
ছবিতে খেয়াল করলে দেখা যায়, মদ্রিচের সব টাচ পিচের ডান প্রান্তে। যেখানে মদ্রিচ সেন্ট্রালি মিডের কন্ট্রোল নিতে পছন্দ করে। সে জায়গায় সেন্ট্রালী সে কোন বলই পায়নি। আর এর ফলে যে সমস্যাটা হল, মাদ্রিদের মিডে ক্রিয়েটিভিটি হারাল। কোভাচিচ আর ক্রুস যখন বারবার বল পাচ্ছিল। তারপর তারা আর কোন পাসিং অপশন পাচ্ছিল না। আমার মতে কোভাচিচকে খেলানো জিদানের এইখানে বড় একটা সিদ্ধান্ত ছিল। জিদান আগে থেকে অনুমান করেছিল, খেলা হবে ডান প্রান্তে। ক্যাসে যদি থাকত, মিডে ক্রিয়েটিভিট আরো কমে যেত কারণ ক্যাসে হাই প্রেসে দুর্বল। কিন্তু কোভাচিচের সলো রান দেওয়ার প্রবণতা আছে। খুব সম্ভবত, এইটাই জিদানকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। যেহেতু মদ্রিচের থেকে কোন সাহায্য সে পাচ্ছিল না। সে বারবার সলো রান দিয়ে বলটা সামনে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে এসেনসিও ডিপে থেকে খেলা বিল্ড করার চেষ্টা করলেও থিয়াগোর কড়া মার্কিং এ সেইটাও সম্ভব হচ্ছিল না।
মদ্রিচ ডান প্রান্তে সাহায্য করার জন্য গেল। এইবার সমস্যা শুরু হল হাফ স্পেসে। হেইঙ্কেন্স আগে হয়ত অনুমান করেছিল জিদান এমন কিছু করবে, আর জানত মদ্রিচ পিছনে চলে যাওয়া মানে মিডের কন্ট্রোল বায়ানের হাতে। বায়ান মদ্রিচের ফেলে আসা হাফ স্পেসের কন্ট্রোল নিতে শুরু করল।
ছবিটার দিকে ভাল করে তাকালে দেখা যাবে, ভাস্কেস এমন একটা পজিশনে যেখানে না সে রিবেরীকে কভার করছে না সে দ্বিতীয় বলটা পাবে। এবং মদ্রিচ রাইটব্যাকএ। আর পুরো ম্যাচ জুড়েই বায়ার্নের রিয়ালের এই দুর্বলতা ব্যবহার করে গেছে। দুইটা হাফ স্পেসেই কি পরিমাণ স্পেস পরে আছে। দেওয়ার মত কেউ নেই।
ম্যাচের ৩ মিনিট। বায়ার্নের গোল। আমরা দেখার চেষ্টা করি, এইখানে কি হয়েছিল, বায়ার্ন কাগজে কলমে খেলছিল ৪-২-৩-১ এ। থিয়াগোর দায়িত্ব ছিল এসেন্সিও রান কভার করা। সত্য কথা বলতে, এসেনসিও এর মত গতিময় প্লেয়ারকে সে খুব ঠাণ্ডা মাথায় নিয়ন্ত্রণ করেছে যেইটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। থিয়াগো কে এই পজিশনে খেলানোয় আরেকটা সুবিধা পেয়েছিল হেইনকেস। ব্যাক থেকে বিল্ড আপে যখন বায়ার্নের পায়ে বল ছিল, তারা ৪-৩-৩ তে এটাকিং শুরু করল। Classic formation for dominating mid।
মুলার এবং রিবেরী ওয়াইড পজিশনে। এখন সমস্যা হল, এই দুইজনই বারবার তাদের পজিশন বদল করছিল তাদের ফুলব্যাকের সাথে। এবং এইটা মাদ্রিদের ডিফেন্ডারদের মধ্যে বিভ্রান্তি করছিল কে কাকে মার্ক করবে তা নিয়ে। প্রথম গোলটা তে দেখা যায়, মুলারের পায়ে যখন বল তখন তার আশে পাশে কেউ ছিল না। মুলার যথেষ্ট সময় নেয় স্পেস পাই ক্রস করার জন্য। এখন তাকে মার্সেলো প্রেস করতে গেলে কিমিচ মার্সেলোর ফেলে আসা স্পেসে দৌড় দেয়। এই জায়গায় এসেনসিও উচিত ছিল কিমিচকে মার্ক করা। কিন্তু সে এতটা মনোযোগী ছিল না। বায়ার্ন প্রথম গোল পেয়ে গেল। জিদান তখন খুবই রাগান্বিত এসেনসিও এর উপর।
২ মিনিটেই গোল পেয়ে বায়ার্ন একটু ডিপে আসল। এই দিকে, এখনো ডান প্রান্ত দিয়ে রিবেরী, আলাবা জুটি রোলার কোস্টার চালাচ্ছে। আর হাফ স্পেস কভার দিচ্ছে হামেস। সোজা কথা, বায়ার্নের সব বেস্ট প্লেয়ার এখন ফোকাসড এই উইং এ। মদ্রিচ, ভাস্কেসকে তখন রিবেরী, আলাবা, হামেসদের আন্ডারলেপ রান ওভারলেপ রান সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যেতে হচ্ছিল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পুরো ম্যাচে এই প্রান্তে বায়ার্ন ১ বনাম ২ সিচুয়েশন পেয়ে আসছিল। এইখানে জিদানের কিছুই করার ছিল না। ফুল ফিট কার্ভাই যেখানে রিবেরীর গতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল। সেখানে হাফ ফিট নাচো যে এসেই খুব ভাল খেলত বলা যায় না। আর ধরা খাওয়ার ভয়ে, ভাস্কেস আলাবার ফেলে আসা স্পেসের সুবিধেও নিতে পারছে না। বায়ার্নের বাম প্রান্ত তখন পুরো খোলা। একবার বলের যোগান দিতে পারলেই ঠিকমত গোল হয়ে যাবে। রোনালদো কয়েকবার রানিং বিহাইন্ড দ্যা ডিফেন্স দিয়ে চেষ্টাও করেছিল কিন্তু হামেলসের দৃঢ়তায় বড় কোন সমস্যায় পড়তে হল না বায়ার্নকে।
ম্যাচের ১০ মিনিট। মাদ্রিদ কিছুটা মিডের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছে। এইবার শুরু হল বলের প্রান্ত বদল করা। মাদ্রিদের গোল হওয়ার আগে দেখবেন মার্সেলোর কাছে বল যাওয়ার আগে এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ৩-৪ বার বল প্রান্ত বদল করে গিয়েছে স্পেসের জন্য আর এর ফলে ম্যাচের হিরোই করে বসল মারাত্মক ভুল। কিমিচ ভুল করে বসল ট্র্যাকব্যাক করতে মার্সেলোর রান। কোভাচিচের সুন্দর লং পাসে মার্সেলো যে টাইম আর স্পেস পেল তাতে পিন পয়েন্টে ক্রস করতে না পারলে ব্যর্থতা ছাড়া কিছু বলা যায় না। এবং সময়োপযোগী রানে বেঞ্জুর ক্লাসিক হেড। খেলা ১-১। এর কিছু সময় পর মাদ্রিদ আরো কিছু সুযোগ সৃষ্টি করেছিল কিন্তু সুবিধা নিতে পারেনি। হেইঙ্কেসও ফরমেশনে অথবা খেলায় কোন চেঞ্জ আনল না।
সেকেন্ড হাফ। ক্ল্যাসিক প্রেসিং হাই অন দ্যা পিচ। অনেকের মতে গোলকিপারের ভুল ধরছে আবার অনেকের মতে টলোসোর। আমার মতে, ভুলটা দুইজনেরই “Understanding and lack of game awareness”।
৩ বনাম ৩ । (১ আউট অফ স্ক্রিন)। ছবি দেখেই বুঝা যাচ্ছে খেলোয়ারদের শেইপ এবং ডিসটেন্স। টলিসোর কোন পাসিং অপশন নেই। তাকে বাধ্য করা হয়েছে গোলকিপারকে পাস দিতে ইভেন বল ক্লিয়ার করার মত স্পেসও তার নেই। এই জায়গায় সে দুইটা জিনিস করতে পারত। মরি বাঁচি করে বল আউট অথবা ব্যাক পাস। সে সেকেন্ড অপশনটা বেচে নিল কিন্তু গোলকিপার রেডি ছিল না। এবং টলিসোও খেয়াল করে নি বেঞ্জুর পজিশনটা। উলেরিখ তার জীবনের সব থেকে বড় ভুলটা করল। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে বলটা ছেড়ে দিল। বেঞ্জু গোল। ২-১।
জিদানের প্ল্যান সাকসেস। এখন যেইটা করতে হবে সেইটা হল লীডটা ধরে রাখা। এবং বায়ান ব্যাক থ্রিতে চলে গেল এবং মাদ্রিদের ডি বক্সে ওভারলোড করা শুরু করল। তাদের দুই ফুল ব্যাক এখন পিচের উপরে। এবং ডিবক্সে মিডফিল্ডাররা ঢুকা শুরু করল। জিদান ডিফেন্সিভ মুডে চলে গেলে সরাসরি। ৪-৫-১। এই দিকে বায়ার্ন এখনো সেই একই ট্যাকটিস ফলো করেই চলছে। মাদ্রিদের দুর্বল প্রান্ত দিয়ে বারবার আঘাত দিচ্ছে।
৬২ মিনিট সুলের ক্রস মাদ্রিদের বাম প্রান্ত থেকে। ঘরের ছেলে হামেসের গোল। ২-২।
৭৩ মিনিটে সাব বেঞ্জু আর কোভাচিচ। নামানো হল ক্যাসে আর বেলকে। আর এসেনসিও কে বলা হল রাইট সাইডে ভাস্কেস, মদ্রিচকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এখনো আগের সমস্যা রয়েই গেল। এসেন্সিও কোন ক্লু নাই তার পিছনে কে ওভারল্যাপ দিচ্ছে। জিদান, মদ্রিচ দুইজনেই রাগান্বিত এসেন্সিও এর উপর এইভাবে বারবার আলাবাকে স্পেস ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
৮৮ মিনিটে নামানো হল নাচোকে। কোন রকমে আর ১০ টা মিনিট অনেকটা বলা যায় গা বাচিয়ে খেলল মাদ্রিদ। এই হল কালকের ম্যাচের মাদ্রিদ বনাম বায়ার্নের খেলা।
সন্দেহ নেই, দুই লেগ মিলিয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল দল ছিল বায়ার্ন। কিন্তু ফুটবলে বেটার টিম কখনো জিতে না। জিতে ইফেক্টিভ টিম। এইজন্য লিভারপুলের ক্লপ বারবার হেরে যায় মরিনহোর বাস ট্যাকটিসের কাছে। ভাল দল মানেই কিন্তু কার্যকরী দল না। মাদ্রিদ আগে থেকে জানত, তাদের কষ্ট করেই জিততে হবে, মনোবল চাঙ্গা রাখতে হবে সবসময় এবং সত্য কথা বলতে মাদ্রিদের প্রতিটা প্লেয়ার কালকে অনেক কষ্ট করেছে। কিন্তু এই কষ্টটা অনেক সহজ হয়ে যায় যখন আপনি দল হিসেবে খেলবেন। এইজন্যই মদ্রিচ নিজের পজিশন ছেড়ে লুকাসকে সাহায্য করতে একটুও কার্পণ্য করেনি। নিজের খেলা ত্যাগ করে সে দলের জন্য খেলেছে। আর এইভাবে একটা চ্যাম্পিয়ন দল গড়ে উঠে। পুরো দুই লেগে ভাল খেলেও শুধু মাত্র ২টা বড় ভুলে বায়ার্নকে আজকে বাদ পড়তে হল আর এই কাজটাই রিয়াল করেনি। এইটাই হল কার্যকরী দল আর ভাল দলের মধ্যে পার্থক্য। মাদ্রিদ বিশ্বাস করেছিল তারা ভুল করবে না, প্রতিপক্ষ করবে আর সেইটার সুযোগ নিবে এবং সেইটাই তারা করে দেখিয়েছে। ম্যাচ শেষে টনি ক্রুসের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়, “Maybe over the 2 games we weren’t the better team… But we were the more effective team.”
সব শেষে Bixente Lizarazu এর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই। “As a psychologist, Zizou reminds me of two greats- Aimé Jacquet and Ottmar Hitzfeld. They both knew how to manage their players’ heads. When you coach a big club, you don’t have to explain how to play football.They already knew those things. You just need to put them in the best place so that they can maximize their potential.”