প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন হিসেবে লেক বা হ্রদ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। লেক হল বদ্ধ জলাশয়, যা নদীর মত প্রবাহিত হয়ে অন্য নদী বা সাগরের সাথে মিশে না। কিন্ত কিছু কিছু সময় এই লেক বা হ্রদ নদীর চেয়ে বড় হতে পারে। পৃথিবীর বৃহত্তম হ্রদ বৈকাল তারমধ্যে একটি। এই হ্রদ যেমন বিশ্ববিখ্যাত তেমনি তার সম্পর্কে যে তথ্য আছে তাও সকলের নজর কারতে সক্ষম। বৈকাল সম্পর্কে জানা অজানা সকল তথ্য থাকছে আজকের পর্বে।
বৈকাল হ্রদের অবস্থান, আয়তন ও উৎপত্তি
রাশিয়ার সাইবেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বৈকাল হ্রদের অবস্থান। এর উত্তর-পশ্চিম অংশ ইর্কুৎস্ক ওবলাস্ত এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশ বুরিয়াত প্রজাতন্ত্রে পড়েছে। বৈকালের আয়তন ৩১,৫০০ বর্গকিলোমিটার, দৈর্ঘ্য ৬৩৬ কিলোমিটার ও প্রস্থ প্রায় ৮১ কিলোমিটার। তবে এটি প্রায় ৫ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা অধিগ্রহণ করে আছে। এর গড় গভীরতা ৭৪৪ মিটার বা ২,৪৪২ ফুট। আর সর্বোচ্চ গভীরতা ১,৬৪২ মিটার বা ৫,৩৮৭ ফুট। এই বিশাল হ্রদটি কৃত্রিমভাবে তৈরি কোন হ্রদ নয়। বৈকাল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। ধারনা করা হয়-প্রায় ২৫/৩০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ঐ অঞ্চলের শিলাখন্ডের মধ্যে বড় ধরনের চ্যুতির ফলে বৈকালের অংশ নিচু হয়ে হ্রদের সৃষ্টি হয় আর তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পাহাড়ের রূপ ধারণ করে। এর পর কালের বিবর্তনে বর্তমানের রূপ ধারণ করে।
বৈকালের সম্পদ সমৃদ্ধতা
বৈকাল নামটিই এসেছে তিইউরস্কি ভাষার ‘বাই-কুল’ আঞ্চলিক শব্দ থেকে। যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘সম্পদশালী হ্রদ’। সম্পদের বিবেচনায়ও এটি পৃথিবীর অন্যতম হ্রদ। পৃথিবীর খাবার যোগ্য বিশুদ্ধ পানির ১৯ ভাগই এই হ্রদে অবস্থিত। এবং এর পানি এতটাই স্বচ্ছ যে খালি চোখে ৪০ মিটার পর্যন্ত পানির নিচের বস্তু অনায়েশে দেখতে পাওয়া যায়। বৈকালের পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্রও নজর কাড়ার মতো। কারণ বৈকাল অঞ্চলে প্রায় ১৭০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে যার দুই-তৃতীয়াংশই পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। বৈকালের তলদেশে রয়েছে ওমূল, গোলেমিংকা, স্যামন প্রভৃতি মাছ এবং নানাজাতের শামুক, শ্যাওলা প্রভৃতি প্রজাতি যা অত্যন্ত মূল্যবান ও কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যত্র বিরল। বৈকালের নিচে রয়েছে আরো বহু প্রকারে প্রাকৃতিক সম্পদ।
বৈকালের নজরকাড়া সব তথ্য
বৈকালের সাথে প্রায় ৩৬০ নদী একত্রিত হয়েছে। এদের পানি প্রবাহিত হয়ে বৈকালে এসে পতিত হয়। এদের মধ্যে মঙ্গোলিয়ায় উৎপত্তি লাভ করা সেলেঙ্গাই সবচেয়ে বড়, যার আয়তন ১০২৪ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে মাত্র একটি মাত্র নদীতে বৈকালের পানি পতিত হয়, যার নাম আঙ্গারা। বৈকালের মধ্যে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি দ্বীপ রয়েছে, যার মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপটি হল “ওলখন”। এ দ্বীপটির দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৪ কিলোমিটার। এই দ্বীপটিতেই সবচেয়ে বেশি পর্যটক সমাগম দেখা যায়। এবং এখানে স্থায়ীভাবে প্রায় ২ হাজার মানুষ বসবাস করে।
গ্রীষ্মকালে এখানকার গড় তাপমাত্রা থাকে ১৪ ডিগ্রী আর শীতকালে এই তাপমাত্রা -১৯ (অর্থাৎ শূন্যের নিচে ১৯ ডিগ্রী) তে নেমে যায়। যার ফলে এ সময় সমগ্র বৈকাল বরফের আস্তরণে ঢেকে যায়। তার এই আস্তরণ এতটাই শক্ত ও পুরু হয় যে-এর উপর দিয়ে ১৫ টন ওজনের গাড়ী অনায়েশে চলে যায়। ফলে এর উপর দিয়ে হাটা-চলা ও স্ক্যটিং করে চলা যায়। এবং বৈকালের পানি অতিরিক্ত স্বচ্ছ হবার কারণে বরফের আস্তরণের উপর দিয়ে ভিতরের চিত্র স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ফলে বৈকালের তলদেশের মাছের বিচরণ করা ও সবুজ পাথরের দৃশ্য পর্যটকদেরকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করে।
বৈকালের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ। ফলে বৈকালের আসে-পাশের অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ভূমিকম্প হয়। তাই বৈকালও ভূমিকম্প মুক্ত না,এর তলদেশে প্রায় সময়ই ছোট ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ সময়ই এই ভূমিকম্প বড় আকার ধারণ করে না। ফলে এই অপার সৌন্দর্যমন্ডিত হ্রদের তেমন বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয় না।
বৈকালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
“সাইবেরিয়ার মুক্তা” খ্যাত এই হ্রদের পূর্বপাশে বসত করে বুরিয়াত নামক অধিবাসী আদের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈকালের উপর নির্ভরশীল। তাদের মধ্যে অনেকেই বৈকালে মাছ শিকার করে তা হতে অর্জিত আয় দিয়েই জীবন নির্বাহ করে। বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন মাছ সরবরাহ করে থাকে বৈকাল হ্রদ। ফলে তা হতে বিশাল অঙ্কের মুদ্রা আয় হয়ে থাকে। বুরিয়াত ছাড়াও বৈকালের আশে-পাশে আরো বেশ কয়েক ধরনের আদিবাসী বসবাস করে। যাদের জীবন জীবিকা এই বৈকালের উপরই নির্ভর করে। তাই কোন কোন ক্ষেত্রে বৈকাল কে সাইবেরিয়ার আশীর্বাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর আশপাশের উদ্ভিদ ও বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাগজ ও ভেষজ ঔষধি কারখানা। সুতরাং বৈকালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। বৈকালের বিশালতা ও তার এসব গুরুত্বের জন্য মঙ্গোলিয়ার পাণ্ডুলিপিতে বৈকাল কে পূর্বাঞ্চলের সাগর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বৈকালের সন্ধান লাভ ও পরবর্তী ইতিহাস
বহুকাল ধরে রাশিয়া তথা ইউরোপের মানুষ এই বিশাল সাগর সদৃশ হ্রদের সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন। রাশিয়া এই অঞ্চলে তাদের রাজ্য সম্প্রসারিত করলে সর্বপ্রথম ১৬৪৩ সালে “ইভনিভ” নামক এক রুশ অনুসন্ধানী গবেষক এই হ্রদের সন্ধান পান। এর মাধ্যমেই প্রকৃতির অপরূপ বিস্ময় ও সৌন্দর্যের লীলাভূমি বৈকাল হ্রদ এবং তার অপার জীব-বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার পৃথিবীর মানুষের সামনে চলে আসে। এর পর থেকে বৈকালের অপরূপ লাবণ্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধতা ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্ববাসীকে কাছে টানতে শুরু করে। যতই দিন যাচ্ছে বৈকালের প্রতি মানুষের আবেদন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ রাশিয়া ক্ষমতায় আসার পর সবসময়ই বৈকালকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করেছে। ফলে বৈকালের সমৃদ্ধি চারদিকে খ্যাতি কুড়াতে সক্ষম হয়। এরই স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ সালে ইউনেস্কো বৈকালকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দেয়।
বৈকালের বর্তমান অবস্থা
বর্তমান শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্রকৃতির উপর যে হুমকি নেমে আসছে বৈকালও তার থেকে মুক্ত না। বৈকালের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার ফলে তা হতে নির্গত বর্জ্য ও কাঁচামালের উৎস হিসেবে বৈকাল কে ব্যাবহার করা হচ্ছে। এবং পার্শ্ববর্তী বিদ্যুৎ প্রকল্পও বৈকালের ক্ষতি সাধনে অবদান রাখছে। আর সবচেয়ে বড় হুমকি হল আবহাওয়ার ক্রম পরিবর্তন। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ধরুন অনেক জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে। আমুল নামের এক প্রকার মাছ সর্বশেষ বৈকালেই পাওয়া যেত কিন্ত বর্তমানে যেখানেও বিলুপ্তি ঘটছে। কারণ আমুল মাছ উষ্ণ পানিতে বাচতে পারে না। তাছাড়াও আরো কয়েক প্রকারের মাছ ও উদ্ভিদ হুমকির মুখে রয়েছে। ফলে বর্তমানে মাছের উৎপাদন কমে ২৫ থেকে ১০ মিলিয়ন টনে নেমে গেছে। এবং বৈকালে বিশেষ ধরনের শেওলার উপস্থিতি বেড়ে গেছে, আবার অপরদিকে বিরল প্রজাতির স্পঞ্জরা হারিয়ে গেছে। যা ভাবিয়ে তুলেছে বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় যে হ্রদ আর দূষণ নিতে পারছে না।
ফলে বৈকালকে বাচাতে ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে বিশেষ আইন প্রণয়ন করে বৈকাল কে রক্ষার চেষ্টা গ্রহণ করা হয়। বৈকালকে দূষণ মুক্ত করার জন্য তার তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা কাগজ মণ্ড কারখানা বন্ধ করা ও এখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বৈকালের পানির বিশুদ্ধতা বাড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি কূপ খনন করে তার মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিন সরকার বৈকালের জৌলুশ বজায় রাখার জন্য কয়েকবার বিবৃতি দিয়েছ। এবং তারা বলেছে যে বৈকালের বর্তমান দূষণ নিয়ে তারা উদ্ভিঘ্ন। ২০১২ সালে ২৬ বিলিয়ন রুবলের (রাশিয়ান মুদ্রা) একটি প্রকল্পতে বৈকাল হ্রদকে প্রধান স্থান দিয়ে বিল পাশ করে যাতে বৈকালের বর্তমান দূষণ কমানো ও একে আরো পর্যটন বান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। ২০১৩ সালে রাশিয়ার বাজেট হতে ১০০ মিলিয়ন বরাদ্দ দিয়ে বৈকালের একটি অঞ্চলকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে আধুনিক পর্যটন বান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য বিল পাশ করা হয়।
সকল বাধাবিপত্তিকে মোকাবেলা করে ও বিশ্বায়নের প্রভাব কে ইতিবাচক হিসেবে কাজে লাগিয়ে বৈকাল তার পর্যটকদের প্রতি তার আকর্ষণকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। বিশ্ব এগিয়ে যাবার সাথে সাথে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বিনোদনের স্পট হিসেবে নিজের দেশের গণ্ডিকে ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যটন স্পট আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তাই বৈকালের মত জগৎ বিখ্যাত স্পটসমূহ সমগ্র বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসুদেরকে আকৃষ্ট করছে। তাই ধারনা করা যায় যে বৈকালের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করার মাধ্যমে রাশিয়া তার পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করাসহ প্রাকৃতিক এক অনন্য সম্পদের রক্ষায় এগিয়ে আসবে। যার ফলে বহুকাল টিকে থাকবে এই ধরার স্বর্গতুল্য প্রকৃতির দান বৈকাল হ্রদ।
তথ্যসূত্র:
১. http://www.prothomalo.com/international/article/1400986/
২. http://bengali.ruvr.ru/2013_03_04/baikal-paribesh-karkhana/
৩. http://shadhinbangla24.com/bn/news/487576
৪. https://www.priyo.com/articles/world-s-deepest-lake-20171019/