শীতপ্রধান দেশগুলোর শীতকালীন আবহাওয়া সম্পর্কে আমাদের সবারই কম বেশী ধারনা রয়েছে। ফেসবুক বা ইন্টারনেটের বদৌলতে অথবা অন্য কোন মাধ্যমে হয়তো আমরা শীতপ্রধান দেশগুলোতে কয়েক ইঞ্চি পুরো হয়ে জমা তুষার বা জমে যাওয়া চোখের পাপড়ির কথা শুনি মাঝেমাঝেই কিন্তু পৃথিবীর বুকে এমন স্থানও বিদ্যমান যেখানে তাপমাত্রা কমতে কমতে এক অংকের সংখ্যায়ও থেমে নেই, বরং নেমে গেছে মাইনাসের ঘরে। এইসব জায়গায় তাপমাত্রা এত বেশী কম যে সেখানে বিনা কাজে গাড়ির ইঞ্জিন চালু রাখা হয় যেন ঠাণ্ডায় গাড়ির ব্যাটারি মৃত না হয়ে যায়। আজকে আমরা জানবো বিশ্বের শীতলতম এমন ১০ টি স্থান সম্পর্কে।
১০. রজার্স গিরিপথ, মন্টানা, যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বের শীতলতম স্থানের তালিকায় ১০ নম্বর অবস্থানে আছে এই স্থান টি। অর্থাৎ এই তালিকার অন্যান্য স্থান গুলোর তুলনায় এটি কিছুটা উষ্ণতর। কিন্তু জানুয়ারি মাসে এর গড় তাপমাত্রা ১৪ এবং ৩৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মাঝেই অবস্থান করে। যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার এই গিরিপথ টি হেলেনা জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন এবং মন্টানা হাইওয়ে ২০০ একে ভেদ করে চলে গেছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৫,৬১০ ফিট। এই গিরিপথ টি গ্রেট ফলস এবং মিসউলা এর মধ্যবর্তী সবচেয়ে উত্তম গমনপথ হিসেবে বিবেচিত। এই স্থানটি বিখ্যাত মূলত এর অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রার জন্য। আলাস্কার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শীতলতম স্থান এই রজার্স গিরিপথ। ১৯৫৪ সালের ২০ জানুয়ারি তীব্র শৈত্য প্রবাহের সময় এই জায়গার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় -৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট (-৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) । তবে ভাল দিক হল গ্রীষ্মে এখানে সূর্য বেশ তপ্ত থাকে, এমনকি জুলাই মাসে তাপমাত্রা ৮৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে বলেও জানা যায়।
৯. স্ট্যানলি, আইডাহো
আইডাহো শহরে লোক সংখ্যা মাত্র ৬৩ জন, কেননা এখানকার শীতকাল বড়ই নিষ্ঠুর। এখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ডিসেম্বরে -৫৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট আর গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -১ ডিগ্রি ফারেনহাইট। শীতকালে বেশ উষ্ণ দিনেও এখানে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপর উঠে না। তবে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশ বাড়তে দেখা যায় এখানে, বিশেষ করে জুলাই এ তাপমাত্রা ৭৮.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠে থাকে। এমন কি এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তবে বেশিরভাগ জুলাইয়ের রাত গুলোই হয় বরফ জমা ঠাণ্ডা। তাই সব মিলিয়ে এখানকার গড় তাপমাত্রা ধরা যায় ৩৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আপনি যদি সূর্য বা সমুদ্র দেখতে চান তবে অবশ্যই আইডাহো আপনার গন্তব্য হওয়া উচিত নয়। তবে এখানে একজন মেয়র, একটি জাদুঘর রয়েছে, এমনকি তাদের নিজেদের একটি ব্যবসায়ী সমিতিও রয়েছে- মাত্র ৬৩ জন লোকের জন্য জায়গা টা তেমন খারাপও না, তাই না বলুন?
৮. প্রস্পেক্ট খাত, আলাস্কা
বর্তমানে জনবসতি শূন্য এই উপনিবেশ টি এককালে হাজারো নির্মাণ শ্রমিকের বসতি ছিল যারা ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ঐ খানে ট্রান্স আলাস্কান পাইপলাইন সিস্টেমের কাজে নিয়োজিত ছিল। তবে শ্রমিকরা যে ক্যাম্পটিতে বসবাস করতো সেটি এখন আর নেই, পাইপলাইনের কাজ শেষ হওয়ার পরই সেটা ভেঙ্গে ফেলা হয় তাই সেখানে প্রতিদিনকার -১৪.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার অত্যাচার কাউকে সহ্য করতে হয়না। এই খাতটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শীতলতম স্থান হিসেবে খ্যাত। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এখানে রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে যা রজার্স গিরিখাতের রেকর্ডকে ভেঙ্গে দিয়েছে। এই খাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় -৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সাব আর্কটিক জলবায়ুর দরুন এখানে শীতকাল অনেক লম্বা এবং গ্রীষ্মকাল অনেক ছোট। এখানে কিছু ভাল্লুক ও পালকবিহীন ঈগল পাখির বাস রয়েছে। কিন্তু মানুষের বসবাস উপযোগী বলে এই স্থান আমি মনে করিনা। কেননা অক্টোবর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত টানা ৬ মাস এখানে তুষারপাত হয় এবং ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসে ২৪ ইঞ্চি পুরো তুষারের স্তর জমে আলাস্কার এই খাতে।
৭. সালকার্ক ফোর্ট, কানাডা
পেলি নদী এবং ইয়কোন নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই জায়গাটি একটি সাবেক বাণিজ্যকেন্দ্র। কানাডার ইয়কোনে অবস্থিত এই স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে বেশ বিখ্যাত। এটি যৌথভাবে “সালকার্ক ফার্স্ট নেশন” ও ইয়কোন সরকারের ” পর্যটন ও সংস্কৃতি” বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। একসময় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কেন্দ্র ছিল কিন্তু ইয়কোন নদী পথ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝিতে এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এই স্থানটি পরিত্যক্ত হওয়ার আরও একটি কারণ হল এখানকার অতিরিক্ত শীতল আবহাওয়া। এখানে নৌকা আর বিমান ছাড়া চলাচলের আর কোন উপায় নেই। এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল -৭৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
৬. স্ন্যাগ, ইয়কোন, কানাডা
আমেরিকার শীতলতম স্থান আলাস্কা সম্পর্কে ত আমরা ইতোমধ্যে জানতেই পেরেছি, এবার জানা যাক উত্তর আমেরিকার শীতলতম স্থান সম্পর্কে। এখানকার সেই জায়গাটি হল কানাডার স্ন্যাগ গ্রামটি যেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল -৮১ ডিগ্রি ফারেনহাইট, ১৯৪৭ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি। তার আগে স্ন্যাগের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট যা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি। তখন ঐ গ্রামে সব মিলিয়ে ৮/১০ জন লোক বাস করতো যাদের মধ্যে কিছু ছিল সেখানকার অধিবাসী আর কিছু ছিল পশম ব্যবসায়ী। এমন কি সেখানে ১৫/২০ জন কর্মী সহ একটি বিমান বন্দরও ছিল, কিন্তু ১৯৬৮ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। স্ন্যাগে গবেষকরা একটি অদ্ভুত ধ্বনিতাত্বিক বিষয় খেয়াল করেছেন। সেখানে অনেক মাইল দূর থেকেও মানুষের কণ্ঠ স্পষ্ট শুনা যেত। এই অদ্ভুত বিষয়টির ব্যাখ্যা এখনও কেউ দেয়নি।
স্ন্যাগে বর্তমানে বার্ষিক গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪.৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং সর্বনিম্ন ১০. ৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
৫. উত্তর আইস, গ্রিনল্যান্ড
এটি উত্তর গ্রিনল্যান্ডে অবস্থিত একটি গবেষণা কেন্দ্র। এটি ব্রিটিশ উত্তর গ্রিনল্যান্ড অভিযানের মালিকানাধীন। এই অভিযানটি করা হয়েছিল ১৯৫২ ও ১৯৫৪ সালের মাঝে। এটি গ্রিনল্যান্ডের অন্তর্দেশীয় আইসের উপর অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৬৮০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই স্থানটি বিশ্বের শীতলতম স্থানের তালিকায় ৫ নম্বরে। এখানে রেকর্ড কৃত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৮৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
৪. ঐমিয়াকোন, রাশিয়া
যখনই শীতলতার কথা আসে তখনই রাশিয়া একাই যেন সব রেকর্ড নিজের দখলে নিয়ে নেয়। ঐমিয়াকোনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয় -৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট যা এই পৃথিবীতে সকল স্থায়ী জনবসতি গুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড। এই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ সালে। যদিও প্রতিদিন এত নিম্ন তাপমাত্রা থাকেনা এখানে তবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এখানকার গড় তাপমাত্রা সবসময় মাইনাস পঞ্চাশের ঘরে বা তার আশেপাশেই থাকে। এমন কি জানুয়ারি মাসে এখানে গড় তাপমাত্রা -৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তবে এত কম তাপমাত্রা হওয়া সত্ত্বেও এখানে প্রায় ৫০০ জন লোকের বাস এবং এই জায়গাটি এই লিস্টে উল্লেখিত অন্যান্য স্থান গুলির তুলনায় বেশ বড়ও। এখানে জুন মাসে দিন প্রায় ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হলেও ডিসেম্বর মাসে দিন মাত্র ৩ ঘণ্টা স্থায়ী। মজার বিষয় হল এখানে বাচ্চারা তুষার পাতের জন্য কোন ছুটি পায়না কারণ এখানে সারাবছরই তাপমাত্রা অনেক কম থাকে এবং তুষারপাত হতেই থাকে। তাই তাপমাত্রা -৬১ ডিগ্রি ফারেনহাইটে না নামলে কোন তুষারপাতের ছুটি পায়না স্কুলের বাচ্চারা।
২১ ঘণ্টা স্থায়ী সূর্যালোক বিহীন দিন এবং তীব্র প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা এখানকার বাসিন্দারা বরাবরই আন্তর্জাতিক কৌতূহলের কেন্দ্রে অবস্থান করে। এখানকার তীব্র শীত এখানে বসবাসকারী মানুষগুলোর বিলুপ্তি ঘটাতে সম্ভব তারপরও তারা কিভাবে এই বৈরি পরিবেশে টিকে আছে সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। তীব্র শীত যখন পড়ে তখন এখানকার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য হয় মাংস কারণ এত ঠাণ্ডার মধ্যে কোন শাক সবজি বা অন্য শস্য উৎপাদন করা সম্ভব হয় না।
৩. ভারখোইয়াস্ক, রাশিয়া
যদি জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবীর শীতলতম দেশ কোনটি, তবে অবশ্যই উত্তর টা হবে রাশিয়া। একটু আগেই যেমন টা বলেছিলাম যে শীতলতার অনেক রেকর্ড একা রাশিয়ারই দখলে, তারই আরেকটা প্রমাণ হল এই ভারখোইয়াস্ক শহরটি। রাশিয়ার সাখা প্রজাতন্ত্রের এই শহরটি শীতকালে অতিরিক্ত নিম্ন তাপমাত্রা এবং শীত ও গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ফেব্রুয়ারি, ১৮৯২ সালে, -৯৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
১৩১১ জন লোকের বসবাস এই শহরে, এখানে রয়েছে একটি নদী বন্দর, একটি বিমান বন্দর ও একটি বল্গাহরিন পালন অঞ্চল। ঐমিয়াকোন আর ভারখোইয়াস্ক ছাড়া শুধুমাত্র এন্টার্কটিকায় এত নিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এবং পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী তাপমাত্রার ব্যাপ্তির রেকর্ড ও ভারখোইয়াস্কের যা ১৮৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
২. প্লেটো স্টেশন, এন্টার্কটিকা
ভস্টকের পর এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান। প্লেটো স্টেশন একটি অচল আমেরিকান গবেষণা কেন্দ্র যা কেন্দ্রীয় এন্টার্কটিকায় অবস্থিত। এখানে শীতলতম মাস হল জুলাই এবং রেকর্ড কৃত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ফারেনহাইট স্কেলে -১২৩.১ ডিগ্রি। এখানে গ্রীষ্মকাল অতি সংক্ষিপ্ত এবং শীতকাল অন্ধকার আর হিমশীতল।
১. ভস্টক, এন্টার্কটিকা
এন্টার্কটিকা কি পৃথিবীর শীতলতম স্থান গুলির মধ্যে অন্যতম একটি? অবশ্যই, এটি তাদের মধ্যে অন্যতম এবং ভস্টক স্টেশন তারই একটি উদাহরণ কেননা এই জায়গার তাপমাত্রা পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এই স্টেশনটি একটি রাশিয়ান এন্টার্কটিক গবেষণা কেন্দ্র। এখানে শীতলতম মাস হল আগস্ট এবং এখানে রেকর্ডকৃত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -১২৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
তবে মজার বিষয় হল পৃথিবীর অন্যতম রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান হল এই ভস্টক। মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সূর্যের মুখ না দেখেও দক্ষিণ আফ্রিকার রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান গুলোর তুলনায় ভস্টকে সূর্যের আলো পাওয়ার পরিমাণ বেশী। কারণ ডিসেম্বর মাসে এখানে গড়ে ২২.৯ ঘণ্টা সূর্য আলো দেয়। আবার অক্ষবর্তী রাতে ০ ঘণ্টার দিন ও অবশ্য হয় এখানে।