লোকমুখে শোনা যায় উক্ত পরিত্যক্ত শহরটির সন্ধানে যে যায় সে আর ফিরে আসে না!! যদিও বা ভাগ্যবলে ফিরেই আসে তবে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ!! কারণটা সম্পর্কে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে তারা বলে, ওই শহর অভিশপ্ত। বিশেষ করে সাদা চামড়ার অধিকারীরা ওইখানে গেলে আর রক্ষে নেই।
রহস্যে ঠাঁসা সে শহরটাতে কি এমন আছে যা এমন কল্পকথার জন্ম দেয়? অনুসন্ধিৎসুদের মাথায় এই প্রশ্নটা বারবারই ঘুরপাক খায় বিধায় গত ৪০০ বছরে অনেকেই দলবেঁধে উক্ত শহরের সন্ধানে বের হয়েছিলেন কিন্তু বিধিবাম, কেউই শহরটির কোন সন্ধানই পায় নিই।
রহস্যে ঘেরা সেই শহরটি নাম “Lost City of the Monkey God” যার নামকরণের পিছে লোকমুখে অনেক কথাই শোনা যায়। দুর্গম পথের শহর বলতেই প্রথমে আমাদের চোখে যা ভাসে তা হলো চারিদিকের ঘন জঙল যেখানে সূর্য্যের দেখা মেলে খুবই সামান্য এবং সারাবছর ঘন বৃষ্টিতে সিক্ত থাকে। অনেকসময় গাছপালা, লতাগুল্ম আর ঝোপঝাড় দ্বারা ঘেরা জঙল এতোটাই ঘন হয় যে আদৌ ওইখানে সূর্যরশ্মি কবুও উঁকি মেরেছে কিনা সন্দেহ। পদেপদে রয়েছে মৃত্যুর হাতছানি। হয়তো পাশেই লুকিয়ে আছে হিংস্র প্রাণী, বিষে ভরা ভয়ংকর পোকামাকড়। মধ্য আমেরিকার প্রায় ২০ হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত হন্ডুরাস এমনই এক জায়গা যেইখানে উপরোল্লিখিত সব বৈশিষ্টের দেখা পাবেন যা গুয়েতমালার পশ্চিমে আর এল সালভাদরের দক্ষিণে অবস্থিত। এ দেশটিতে একসময় বসবাস ছিলো “মায়ান” নামক এক জাতির।
“হন্ডুরাস” শব্দটি স্প্যানিশ যার অর্থ হলো “গহিন”। নামের অর্থের সাথে মিল রেখেই দেশটির অধিকাংশ জায়গাই ছিলো অনাবিষ্কৃত, এক ধরণের ঘন জঙলের জালে ঘেরা। এমনও কিছু জায়গা আছে যেখানে মানুষের পদচিহ্ন না থাকাতে এতোটাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে এর অবস্থান যে অনেকেই আর বুঝতেই পারে না আসলে স্থানটি কোন জায়গায়। এমনই এক হারানো শহরের নাম হলো – “লা সিউদাদ ব্ল্যাংকা (স্প্যানিশ) বা The White City “ যাকে বানর দেবতার শহর বলা হয়।
সময় ১৯২৭, বিমানচালক চার্লস লিন্দেরবারগ হন্ডুরাসের পুর্বাঞ্চল দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় “দি হোয়াইট সিটি” নামক শহরটির দেখা পান। তবে সর্বপ্রথম এই শহর সম্পর্কে প্রকাশ করেন লুক্সেম্বরগ এর নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী ‘এডুয়ার্ড কনজিমিয়াস’
যার মতে, শহরটির ধ্বংসাবশেষ বিগত পঁচিশ বছর আগে আরেকজন আবিষ্কার করেছিলো যিনি “পউলায়া” নদী এবং “প্লাতান’’ নদীর মাঝে রাবার খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। শহরটিকে “হোয়াইট সিটি” বলা হতো কারণ এ শহরের দালান এবং দেয়াল সাদা পাথর দ্বারা নির্মিত ছিলো।
এরপরে ১৯৩৯ সালে, ‘থিওডোর মরডি’ নামের অভিযাত্রী মাঙ্কি গড এর শহর এর আবিষ্কারের দাবী তুলেছিলেন তবে তিনি কোন নির্দিষ্ট তথ্য দেন নি শহরটির অবস্থান সম্পর্কে এবং তিনি ১৯৫৪ সালে নিজেই আত্মহত্যা করেন কিন্তু এরই মাঝে ১৯৫২ সালে “তিবর সেকেজি” নামক আরেকজন অনুসন্ধানকারী একটি ছোট পরিসরে অসফল অভিযান চালান “হোয়াইট সিটি” সম্পর্কে যার জন্যে অর্থ যোগান দেন খোদ হন্ডুরাসের সংস্কৃতিমন্ত্রী।
লোকমুখে শোনা যায়, শহরটি একটি বিত্তশালী জনপদ সমৃদ্ধ ছিলো যা হঠাৎ কোন এক অভিশাপে উধাও হয়ে যায়। সে শহরটিও ছিলো অজানা অভিশাপের বেড়াজালে বিদ্ধ যেখানে কেউ শখের বশে বা অনুসন্ধানে যায় আর ফিরে আসে না। ঘটনা যখন অসহনীয় এবং বেগতিক হয়ে পড়ে তখন হন্ডুরাস সরকার বাধ্য হয়ে ওই এলাকার খোঁজে আসা অভিযাত্রীদের উক্ত এলাকার সন্ধানে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে।
তবে দমে যাওয়া মতো ব্যক্তি ছিলেন না ‘ডগলাস প্রেস্টন’। বিশ্বজুড়ে রহস্য ও রোমাঞ্চ জনারের লেখক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি। মাথার মধ্যে তিনি এক ধরণের গেঁথেই নিলেন মধ্য আমেরিকার ২০ হাজার বর্গ মাইল জুড়ে থাকা এই গভীর জঙ্গলের মাঝে সেই অভিশপ্ত হারানো শহরটি খুঁজে বের করবেন কিন্তু বিগত সব প্রাণঘাতী দূর্ঘটনার কারণে হন্ডুরাস সরকারের নিষেধাজ্ঞা তখনও বলবৎ ছিলো যার কারণে চাইলেও সহজেই অনুসন্ধানে বের হতে পারবেন না তারা। সরাসরি সরকারের কাছে আবেদন করলেন যথাযথ ভাবে এবং অবশেষে অনুমতিও মিলে গেলো।
খুব একটা বেগ পেতে হলো না তাঁর। অভিযানের নিমিত্তে গঠিত দলের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত অনুসন্ধানী অভিযাত্রী স্টিভ এলকিন, সাবেক ব্রিটিশ SAS সৈন্য এন্ড্রো উড এবং সুপরিচিত খ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা বিল বেনিনসন।
সাবেক ব্রিটিশ এয়ার সার্ভিসের সৈন্যরা অভিযাত্রী দলদের বহনের জন্য হেলিকপ্টার প্রস্তুত করলেন। যাত্রা শুরু মসকুইটিয়া রেইনফরেস্ট হতে যার গন্তব্য অজানা।
যাওয়ার আগে স্থানীয়দের মুখে অনেক কথা শুনেছিলেন তাঁরা। উনাদের ভাষ্যমতে একসময় খুব জমজমাট ছিলো ওই শহরটা। সংকীর্ণ, প্রায় দূর্ভেদ্য রাস্তার পাহাড় পেরিয়ে যেতে হতো ওই শহরে। যে শহরটির শাসনকর্তা ছিলো এক মহা শক্তিশালী বানর। ঘটনা শুরু হলো যখন বহিরাগত প্রবেশ করলো ওই শহরে যার কারণে বানর রাজা খুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং শহরটিকে অভিশাপ দেয়।
আবার অনেকে বলেন, বানর রাজা এক স্থানীয় মহিলাকে অপরহরণ করে। পরবর্তীতে অর্ধেক মানুষ এবং অর্ধেক বানরের বৈশিষ্টের বাচ্চা প্রসব করে। পরে অই বাচ্চাগুলো প্রতিশোধ নেয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এরপর হতেই ঘটনার শুরু। একের পর এক মানুষের মৃত্যুর খবরে চারপাশ ভারী হতে থাকে। প্রায় ষোড়শ শতাব্দীর দিকে শহরটি একরকমের জনশূন্য হয়ে পড়ে।
তবে বিজ্ঞানীরা কথাটি সরাসরি গ্রহণ না করে মতামত দেন এই অবস্থার পিছে কোন অভিশাপের কারণ নেই বরং শ্বেতাঙ্গদের বহন করা সংক্রামক রোগ-ব্যাধিতে নাকাল হয়ে শহরটি হয়ে পড়ে জনমানবহীন।
প্রেস্টন অবশ্য এক সপ্তাহ যাবত হন্ডুরাসের নিকটবর্তী জঙ্গলে থেকেছেন। এসময়ে তিনি এবং তাঁর দল পৃথিবীর অন্যতম বিষাক্ত সাপ Fer-de-lance এর মুখোমুখি হয়। তাছাড়া চোরাবালি এমনকি শিকারী হিংস্র এক প্রকার বন্য মানুষখেকো মাংসাশী প্রাণীর সম্মুখীন হয়।
তাঁদের সব কষ্ট শুধুমাত্র তথাকথিত হাজার বছরের পুরোনো ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে জানা যা সবচেয়ে প্রাচীন এবং রেইন ফরেস্টের মধ্যে প্রায় ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে চাপা পড়ে আছে যার সম্পর্কে কেউই জানে না।
প্রেস্টনের অনুসন্ধানী দল পায়ে হেটে পুরো স্থান ঘুরে দেখেন এবং সেখানে আশ্চর্যজনক ভাস্কর্যের দেখা পায় যা ভুগর্ভ হতে নিচে পুঁতে রাখা হয় যা দেখে প্রেস্টনের ধারণা হয় শহরটিতে থাকা সভ্যতা কতোটা শক্তিশালি, অগ্রসর এবং সংস্কারী ছিলো।
দলটি প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ পেয়েছিলো পুরোনো ‘সেস্না স্কাইমাস্টার প্ল্যান’ এর সাহায্যে যার মধ্যে ‘লেজার ইমেজিং’ উপকরণ সংযুক্ত ছিলো। যার দ্বারা মাত্র কয়েকদিনে ওই এলাকার প্রায় কয়েকশো মাইল বিস্তৃত জঙ্গল পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব ছিলো। সংগ্রহিত তথ্যের মাধ্যমে থ্রিডি কম্পিউটার মডেল প্রস্তুত কারক অনুসন্ধানী দল তাঁদের স্থির লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে পারে। তবে, প্রেস্টনের মতে লেজার টেকনোলজির মাধ্যমে তাঁরা জানতে পারে এখানে আরো একটি প্রাচীন জায়গা ছিলো যা তখনোও অনাবৃষ্কিত ছিলো।
প্রেস্টন এবং তাঁর টীম প্রায় ২০ হাজার বর্গমাইল ঘুরেছিলেন হন্ডুরাস রিনফরেস্ট এবং নিকারাগোয়ায় প্রাচীন হারানো শহরের খোঁজে। সফরটি হন্ডুরাস সরকারের নজর কাড়ে এবং তাঁরা নিজস্ব সেনা দল পাঠান অনুসন্ধানী দলের সাথে সফরসঙ্গী হতে।
সফর শেষে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন লেখনির মাধ্যমে যা জন্ম দেয় ২০১৭ সালের সর্বাধিক বিক্রিত বই, “ The Lost city of the Monkey God ” এর।
তবে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরে প্রেস্টন এবং তাঁর দলের লোকজন কিছু দুশ্চিন্তামূলক শারিরীক রোগের শিকার হোন। কারো শ্বাসকষ্টের সমস্যা তো কারোও চামড়ায় গভীর ক্ষতের চিহ্ন দেখা দিতে শুরু হয়। আবার কারোও কন্ঠনালীতে সমস্যা দেখা দেয় যার কারণে কোনকিছু গিলতে সমস্যার সম্মুখীন হয়।
তৎক্ষণাৎ প্রেস্টন এবং তাঁর সহযোগীদের National Institute of Health এর অধীনস্থ বিশেষ ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয় যেখান হতে ধারণা করা হয় তাঁরা হতে পারে কোন এক সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে মধ্য আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে। পরবর্তীতে জানা যায় “MucocutaneousLeishmaniasis” নামক রোগে আক্রান্ত হয়েছে যা মধ্য আমেরিকার কিছু উড়ন্ত কীটের মাধ্যমে ছড়ায়। এ রোগের প্রধান লক্ষণ হলো উক্ত রোগে এক ধরণের মাংসখেকো কীট শরীরে বাসা বাঁধে যা সাধারণত মানবদেহে প্রবেশ করে নাক এবং মুখ দিয়ে যার কারণে তাঁরা শ্বাসকষ্ট এবং গলাধঃকরণের সমস্যায় ভুগছিলেন। এই কীট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মাংস কুটে খেয়ে শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে যার পরিণতি একমাত্র যন্ত্রণাময় মৃত্যু। ধারণা করা হচ্ছিলো সেই পুরোনো মিথ যাতে সবাই বলতো বানর দেবতার অভিশাপ তাঁদের উপর পড়েছে কিন্তু চিকিৎসকদের সুনির্দিষ্ট তথ্য কথাগুলো উড়িয়ে দেয়।
ভাগ্য নেহায়েত ভালোই বলতে হয় প্রেস্টন এবং তাঁর সহযোগীদের কারণ এ রোগের চিকিৎসা ছিলো তবে বেশ ব্যয়বহুল কিন্তু প্রেস্টনের এ ব্যাপারে কোন অর্থসমস্যা ছিলোই না। দৈনিক ৬ থেকে ৮ ঘন্টার চিকিৎসার মধ্যে ছিলো শিরায় উচ্চমাত্রার ডোজ নেয়া যা ছত্রাকগুলো ধ্বংস করতে সাহায্য করতো। প্রায় তিন সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার পর প্রেস্টন সুস্থ তবে অনেকেরই আরো বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়েছিলো সুস্থ হতে। তবে আরো দুঃখের বিষয় হলো, শরীরে বাসা বাঁধা ছত্রাক নিধনে ব্যবহৃত উচ্চমাত্রার ডোজ ছত্রাক নির্মুলের পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিসাধন করে বসে যার মধ্যে প্রেস্টনের এক সহযোগী ছিলো যার লিভার প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, “MucocutaneousLeishmaniasis” রোগের প্রকোপ প্রায় ৯০ টি দেশে দেখা দেয় যার মধ্যে বেশি সংখ্যক মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত। বছরে প্রায় ২০ হতে ৩০ হাজার মানুষ এই রোগে মারা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে এই রোগের সৃষ্টির অন্যতম কারণ মনুষ্য সৃষ্ট বৈষ্ণিক উষ্ণতা।
আজও অনেক বিশেষজ্ঞে সন্দেহ পোষণ করে আসলেই প্রেস্টন সেই হারানো শহর আবিষ্কার করেছেন কিনা তবে প্রেস্টন নিজের বইতে তুলে ধরেছেন সেই বানর দেবতার শহর খুঁজার সময়কার প্রতিটা পদাবলীর বর্ণনা যার জন্য তিনি এবং তাঁর দলের সদস্যরা নিয়েছেন নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি যার ফলে বিশ্ববাসী পেয়েছে এক হারানো শহরের খোঁজ যাকে আমরা জানি “The Lost City of the Monkey God” নামে।