মেমফিসঃ রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি

আধুনিক ইতিহাসবিদ আর প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে স্বর্গউদ্যান হিসেবে প্রসিদ্ধ মেমফিস। এই প্রাচীন নগরীটি হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাচীন সভ্যতা আর স্থাপত্যের জ্বলজ্বলে স্বাক্ষর বহন করে চলেছে স্বমহিমায়। মেমফিস প্রাচীন মিশরের রাজধানী। মেমফিস শুধু তৎকালীন প্রাচীন মিশরের রাজধানীই ছিল না। এটি ছিল তখনকার মিশরের প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র এবং সভ্য নগরী। কায়রো শহরের ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে নীল নদের পশ্চিম তীরে এর অবস্থান । এই নগরীটির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বে মেমফিসে প্রথম লোকবসতি গড়ে উঠেছিল বলে অনুমান করা হয়। নতুন রাজবংশের আমলে থিবস এরা চলে যায়। কিন্তু তবুও এর গুরুত্ব কমে নি এতটুকু।

মেমফিসঃ রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি
মেমফিস স্কাইলাইন
Source: East Coast Sox

মিশরীয় ভাষায় মেমফিস কে বলা হত মেন নেফার’। এর অর্থ: ‘প্রতিষ্ঠিত এবং সুন্দর’। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো মিশর ভ্রমন করে অপার বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। অবলোকন করেছিলেন এর মহান সৌন্দর্য। আজও পর্যটকেরা ঘুরে ঘুরে দেখেন প্রাচীন মিশরের অতুলনীয় র্কীতি। হঠাৎ এসে থমকে যান এই মেমফিস নগরীতে এসে। সকল পর্যটকেরা এই মেমফিস নগরীর ঐশ্বর্য আর অপার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে অতীতের উপর ভর করে চলে যান হাজার হাজার বছর পূর্বে। যখন মেমফিসের এই প্রাচীন সভ্যতাগুলো সচল ছিল। প্রানের রং লেগে ছিল এর পরতে পরতে। পৃথিবী টিকে থাকলে বিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও দেখবে ‘অসাম’ এই ভাস্কর্যগুলি।

 রাজবংশের সূচনা ও মেমফিসের উত্থানঃ

মিশরে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রীস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরের এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস অবলীলায় মিশরকে বলেছেন নীল নদের দান। ৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়ের মিশরকে প্রাক রাজবংশীয় যুগ বলা হয়। সে সময় মিশর কতগুলো ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। সেগুলোকে বলা হতো ‘নোম’।

মেমফিসঃ রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি
নোম
Source: Wikipedia

৩২০০ খ্রীষ্টপুর্বাব্দে মেনেস নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে একত্রিত করে একটি নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। দক্ষিন মিশরের মেমফিস হয় এর রাজধানী। এভাবেই মিশরে রাজবংশের সূচনা হয়েছিল। অর্থাৎ মিশরের রাজবংশের উদ্ভবের সাথে মেমফিস শহরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুরনো রাজবংশের আমলে (২৬৪৯ থেকে ২৫৭৫ খ্রিস্টপূর্ব ) মেমফিস আর থিবস ছিল প্রাচীন মিশরের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রাচীন মিশরীয় ফারাওদের দীর্ঘকালীন ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় মেমফিসই ছিল প্রাচীন মিশরের প্রশাসনিক কেন্দ্র। কাজেই প্রাচীন রাজবংশগুলি আরাধ্য দেবতার উপাসনালয়, সমাধি সৌধ নির্মাণ করেছিল।

 মেমফিসের ঈশ্বরঃ তাহ্

মেমফিস নগরের প্রধান দেবতা তাহ্ । তাহ্ এর স্ত্রী সেকমেত এবং সন্তান নেফাত-টম। তাহ এর মত এরাও পূজিত হতেন। দেবতা তাহ এর পরিচিত প্রতিকৃতি হল- দাড়িওয়ালা, মমিকৃত এবং মাথায় করোটির টুপি; হাতে রাজদন্ড এবং জীবনের প্রতীকরূপে ‘আনখ’ এবং স্থায়ীত্বে চিহ্নরূপে ডিজেড। দেবতা ‘তাহ’  দক্ষ কারিগর এবং স্থপতিদের পৃষ্ঠপোষক। মেফফিসে তার উপাসনালয়ের কাছে চমৎকার চুনাপাথর পাওয়া গেছে। কারুশিল্পী হিসেবে রাজবংশের ব্যাক্তিবর্গের স্বর্গীয় দেহ রূপ দিয়েছিল। ফারাও ২য় রামেসেস (প্রাচীন মিশরের এক বিখ্যাত ফারাও) -এর শরীরও নাকি তিনিই খোদিত করেছিলেন। Egypt  নামটি উৎপত্তির ক্ষেত্রে মেমফিস শহর চমৎকার গূরত্ব বহন করে। কারন মেমফিস এর পুরনো নাম ছিল ‘Hikuptah’ এর মানে: ‘তাহ -এর আত্মার ভবন’। শব্দটিকে রোমানরা বলত:  Aegyptvs’ । এই শব্দটি থেকেই আধুনিক ইংরেজিতে Egypt শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। দেবতা তাহ এর উপাসনালয়টিই ছিল প্রাচীন মেমফিসনগরে সবচে উল্লেখযোগ্য কাঠামো । এর নামও ‘Hikuptah’ (তাহ এর আত্মার ভবন)অবশ্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে এককালে এটিই ছিল মিশরের সব বড় স্থাপত্য।

মেমফিসঃ রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি
Statue of Ptah
Source: LookLex

মেমফিস নগরের পুরোহিতরা তাহ কেই মনে করত সর্বেস্বর্বা, পৃথিবীর স্রষ্টা, দেবতাদেরজনক, পৃথিবীর সকল প্রাণির জীবনীশক্তির উৎস এবং প্রারম্ভের জনক ( মানে যারদ্বারা সব কিছুর সূচনা হয়েছিল)। আস্তে আস্তে দেবতা তাহ্ এর প্রভাব মেমফিস থেকে সারা মিশরে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। মিশরের এক একজন দেবতার উদ্ভব এবং এর বিস্তৃতি, সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠা মূলত মিশরের রাজনৈতিক উত্থান পতনের উপর নির্ভর করতো। তেমনি দেবতা তাহ মিশরের মধ্যে সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে মেমফিসে প্রাচীন রাজবংশের উদ্ভবের ফলে।

রহস্যময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি মেমফিসঃ

নীল নদের পশ্চিম তীরে মেমফিস অবস্থিত। মিশরের কৃষি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল মূলত নীল নদকে কেন্দ্র করেই। তাই মেমফিসের অবস্থান নীলনদের তীরে হওয়ায় এ শহরের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক বিকাশ ঘটেছে স্বমহিমায় বেশ দ্রুততার সাথেই । তাছাড়া প্রাচীন মিশরীয় ফারাওদের দীর্ঘকালীন ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় মেমফিসই ছিল প্রাচীন মিশরের প্রশাসনিক কেন্দ্র। ফলে প্রসিদ্ধ নগরী হিসেবে এটি বিস্তৃতি লাভ করে শুধু মিশর নয়, সমগ্র সভ্য পৃথিবীব্যাপী। মেমফিস শহরে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পিরামিড, উপাসনালয় এবং সমাধিসৌধ। মেমফিস নগরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত সাককারা। এখানেই রয়েছে মিশরের প্রাচীনতম পিরামিডটি। ওখানেই রয়েছে গিজার পিরামিড এবং বিখ্যাত স্ফিংস।

মেমফিসঃ রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি
গিজার পিরামিড এবং বিখ্যাত স্ফিংস।
Source: Anfrix

স্ফিংক্স  নামটা শুনলেই সবার মনে যে দৃশ্যটা ভেসে আসে তা হলো এক বিশাল মানুষ্যরূপী সিংহ মুর্তি যে কিনা তার বিশাল দুটো থাবা সামনে বাড়িয়ে বসে আছে চিরন্তন মরুভুমির বালির চাদরে । গিজার স্ফিংক্স হচ্ছে বিস্ময় এর আধার এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা মিশর যাকে ‘ল্যান্ড অব মিস্টী’  বলা হয় তার সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টিই হচ্ছে এই গ্রেট স্ফিংক্স । গ্রেট স্ফিংস মূলত সিংহের শরীরে মানুষের মাথা সম্বলিত বিশাল এক ভাস্কর্য। এই ভাষ্কর্যে আস্ত একটা বিশাল পাথরকে সিংহের শরীরের অবয়ব দেয়া হয়েছে, আর তার ওপর খোদাই করা হয়েছে মানুষের মাথা। আর এই মেমফিস শহরের অদূরে নীল নদের পশ্চিম তীরে খাফ্রার পিরামিডের কাছে পূর্ব দিকে মুখ করে গ্রেট স্ফিংসের অবস্থান। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মনোলিথিক ভাস্কর্য এবং মনুমেন্টাল ভাষ্কর্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। একসময় স্ফিংসের একটি ১ মিটার লম্বা নাক ছিল কিন্তু সেটি আজ আর নেই। কথিত আছে নেপোলিয়নের সৈন্যরা গ্রেট স্ফিংসকে নিশানা বানিয়ে কামানের গোলা ছুঁড়েছিল। ফারাও এর প্রতিমূর্তি স্বরূপ গ্রেট স্ফিংসের দাঁড়ি ছিল; কিন্তু বহুদিন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেসব। একটি লেজও আছে এই স্ফিংসের, গুটানো অবস্থায়। তবে এটি নির্মাণের কারণ, এর চেহারা কার প্রতিমূর্তি, কখন এবং কারা এটি নির্মাণ করেন এসব নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। কালের বিবর্তনে এসব ভাস্কর্যে এসেছে কিছুটা মলিনতা। কিন্তু পৃথিবীতে আধুনিকতা বাড়ার সাথে সাথেই যেন বাড়ছে এসবের সৌন্দর্য, বাড়ছে রহস্য।

মেমফিসঃ রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি
নীল নদ
Source: CoraViral

মিশর নামটি শুনলেই যেন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজার বছরের রহস্যের চাদরে মোড়ানো বড় বড় সুউচ্চ পিরামিড, মমি করে সংরক্ষন করা মানুষের দেহ। আরো কত রহস্যময় স্থাপত্য… হ্যা এ সবই অবস্থিত এই মেমফিস শহরে। মেমফিস তার সৌন্দর্য শুধু নিজের মধ্যেই আবদ্ধ করে রাখেনি, বরং ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য পিপাসুদের মনের গহীনে, অন্তরাত্মায়।

 

তথ্যসূত্রঃ

Wikipedia

http://en.wikipedia.org/wiki/Memphis,_Egypt

http://www.egyptianmyths.net/ptah.htm

http://www.egyptartsite.com/ptah.html

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More