ভ্রমণ করতে তো কমবেশি সবাই ভালোবাসে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পাহাড়, সমুদ্র, খোলা-প্রান্তর কোথায় না ছুঁটে যায় মানুষ। তাইতো নজরুল বলেছেন, “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে”। এক জীবনে কি বিশ্ব ভ্রমণ করে শেষ করা সম্ভব? তবুও আপনি যদি ট্র্যাভেল ফ্রিক হয়ে থাকেন বাকেট লিস্টে আজই যোগ করে ফেলুন এমন কিছু জায়গা যেখানে গেলে আপনার মনে হবে বেঁচে থাকাটা স্বার্থক।
আমরা কি কখনো জানার চেষ্টা করেছি, ইন্টারনেটে ওয়ালপেপার খুঁজতে গিয়ে যে নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য আমরা দেখতে পাই সেগুলোর অস্তিত্ব আদতে আছে কিনা! বা থাকলেও কোথায় লুকিয়ে আছে সেই ছবির জায়গাগুলো। আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই এমন সেরা ১৪টি অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য্যের আধার যেগুলোকে প্রকৃতি ঢেলে সাজাতে কোন কার্পণ্য করেনি :-
১৪. মাউন্ট রোরাইমা, দক্ষিণ আমেরিকা
মাটিতে দাঁড়িয়ে মেঘ ছুঁতে চান? মাউন্ট রোরাইমা তার এমনই রহস্যময় অপার সৌন্দর্য নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে ভ্রমণ পিপাসুদের ৷ পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূতাত্ত্বিক গঠনগুলোর মাঝে অন্যতম এই পর্বতমালার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সমতল পর্বত চূড়া ৷

মাউন্ট রোরাইমা পর্বতমালা তিনটি দেশের সীমান্তে অবস্থিত (ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা এবং গায়ানা) ৷ ৯ মাইল দীর্ঘ পর্বতটিতে সারাবছর বৃষ্টিপাত হওয়ার দরূন সর্বোচ্চ সংখ্যক জলপ্রপাত দেখা যায় এখানে ৷ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, বিরল প্রজাতির গাছ, দুর্বোধ্য ট্রেকিং এই সবকিছু যেন মাউন্ট রোরাইমাকে ট্যুরিস্ট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
১৩. টানেল অফ লাভ, ইউক্রেন
প্রেমের সুরঙ্গও বলা যেতে পারে ইউক্রেনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও রোমান্টিক জায়গা হিসেবে পরিচিত এই টানেল অফ লাভকে ৷ ক্লেভান শহরে অবস্থিত টানেলটি মূলত তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ট্রেন টানেল যা দুপাশে গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত ।

প্রকৃতি এবং মানবসৃষ্ট স্থাপত্যবিদ্যা অদ্ভূত সেতুবন্ধন দেখতে পাওয়া যায় এখানে আসলে। ফটোগ্রাফার এবং প্রেমিক যুগলদের আনাগোনাই বেশি এখানে। এই স্থান সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে, কোন প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল যদি হাত ধরে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যায় এবং তাঁরা যদি কোন ইচ্ছা পোষণ করে তাহলে তা বাস্তবে পরিণত হয়। এজন্যই টানেল অফ লাভ কে বিশ্বের অন্যতম রোমান্টিক জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ৷
১২. হিটাসি সিসাইড পার্ক, জাপান
জাপানের ইবারাকি শহরে অবস্থিত এই জায়গাটিকে ফুলের স্বর্গ বললেও ভুল হবে না ৷ ১৯০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পার্কটিতে আছে চোখ ধাঁধানো ফুলের সমারোহ। বছরের পুরোটা সময় ধরে ঋতুভেদে রঙ পরিবর্তন হয় বাগানের ফুলের বৈচিত্রতার জন্য।

পার্কের অন্যতম মূল আকর্ষণ বেবি ব্লু আইস৷ বেবি ব্লু আইস যখন ফুটে পুরো পার্ক নীল সমুদ্রে পরিণত হয়৷ এছাড়াও ড্যাফোডিল, টিউলিপ সহ হরেক প্রজাতির ফুলের দেখা পাওয়া যায় হিটাসি পার্কে ৷
জাপান ভ্রমনে এসে হিটাসি পার্ক না দেখলে ট্যুর টাই বৃথা মনে হতে পারে আপনার।
১১. তিয়ানজি মাউন্টেন, চায়না
চায়নার হুনান প্রদেশে অবস্থিত তিয়ানজি মাউন্টেনকে বলা হয় “Son of heaven” বা স্বর্গের পুত্র ৷ তিয়ানজিপর্বতমালা ছোট, বড় হাজারখানেক পর্বতশৃঙ্গ নিয়ে গঠিত ৷ সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২৬২ মিটার উঁচুতে অবস্থিত ৷

এখানের একেকটি পাহাড় একে অন্যকে ছাড়িয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। সাদা তুলোর মতো মেঘের ভেলা, দীপ্তিময় চাঁদের আলো কি নেই এখানে! শীতকালে বরফে ঢাকা পাহাড়গুলিতে যখন সূর্যের কিরণ পড়ে, এক অসাধারণ সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে। জেমস ক্যামেরুনের “Avatar” মুভিতে এই তিয়ানজি মাউন্টেন দেখতে পাওয়া যায় ৷
১০. আলগার্ভ কেইভ, পর্তুগাল
পর্তুগালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট অত্যাশ্চর্য আলগার্ভ গুহাটি আলগার্ভ সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত ৷ প্রতিনিয়ত ঢেউয়ের ধাক্কায় এই পাথুরে গুহা তৈরি হয়েছে ৷

দেখে মনে হয় সমুদ্র তীরে কেইভটি ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে ৷ পাথুরে দেয়ালের ভিতর দিয়ে সমুদ্রের জোয়ার – ভাটা আর সূর্য রশ্মির কিরণই আলগার্ভ কেইভকে পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
৯. হেমিল্টন পুল, টেক্সাস ,আমেরিকা
প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট পুলটি ২৩২ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এমন একটি পুল যা কখনো শুকিয়ে যায় না ৷ ধারনা করা হয়,হাজার হাজার বছর আগে ভূগর্ভস্হ নদীর গম্ভুজ ভেঙ্গে এই পুলের সৃষ্টি হয়েছিল ৷ স্থানীয় এবং বহিরাগত ট্যুরিস্টদের জন্য গরমকালে সাঁতার কাটার উত্তম জায়গা হচ্ছে এই লেক ৷ বিরল প্রজাতির পাখিও দেখতে পাওয়া এখানে ৷

পুলের ছাদ নিখুঁত পাথুরে তৈরি এবং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট চুনাপাথর দ্বারা বেষ্টিত ৷ পুলটির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে ৷ ফিশিং, বাইকিং এবং ক্যাম্পিং সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ এখানে ৷
৮. গ্রেট ব্লু হোল, বেলিজ, সেন্ট্রাল আমেরিকা
বেলিজের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রগর্ভস্হ গর্ত এটি ৷ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র গর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয় ৷ বিস্ময়কর চোখের আকৃতিতে সৃষ্ট গ্রেট ব্লু হোল স্কুভা ডাইভারদের প্রিয় জায়গা।

নার্স শার্ক এবং রিফ শার্কের মতো বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণি দেখতে পাওয়া যায় এখানে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় রয়েছে এই গ্রেট ব্লু হোল।
৭. মোরেইন লেক, কানাডা
চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা টারকোয়েজ রঙের পানির জন্যই এই লেকটির নাম বিশ্বজুড়ে সমাদ্রিত। লেকের নীলচে সবুজ রঙ মূলত আলোর প্রতিসরনের কারণে সৃষ্ট ৷ গ্ল্যাসিয়ার হচ্ছে লেকের সৌন্দর্য্যের মূল উৎস।

মোরেইন লেকের মূল আকর্ষণ হল ক্যানুয়িং এবং হাইকিং ৷ বার্ডস আই ভিউ দেখার জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা ও আছে এখানে।
৬. সাগানো ব্যাম্বু ফরেস্ট, জাপান
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে, জীবন যখন বাঁশ বাগান। আপনিও চাইলে ঘুরে আসতে পারেন জাপানের ঐতিহ্যবাহী সেই বাঁশ বাগান বা সাগানো ব্যাম্বু ফরেস্ট থেকে।

প্রায় ১৬ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা ব্যাম্বু ফরেস্ট কিয়োটো শহরে অবস্থিত ৷ বনের সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাতাসের দুলুনিতে যে রোমাঞ্চকর শব্দের সৃষ্টি হয় তা সত্যিই শিহরণ জাগিয়ে দেওয়ার মত ৷ পর্যটকদের হাঁটার জন্যও বনের মাঝখান দিয়ে চলে গেয়ে আঁকা বাঁকা পথ।
৫. সন ডুং গুহা, ভিয়েতনাম
এ যাবতকালের আবিষ্কৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা সন ডুং গুহা । Ho khanh নামে স্থানীয় একব্যক্তি ১৯৯১ সালে এই গুহাটি আবিষ্কার করেন ৷ ১৫০ মিটার উচ্চ, ২০০ মিটার প্রশস্ত এবং ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই গুহা প্রতিনিয়ত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পুনর্গঠিত হচ্ছে ৷

গুহার ভিতরে রয়েছে চেনা-অচেনা বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদসহ পানির ফোয়ারা ও অসংখ্য সুরঙ্গপথ । এসব সুরঙ্গ দিয়ে অনায়েসেই ভিয়েতনামের এক প্রদেশ হতে অন্য প্রদেশে যাতায়াত করা সম্ভব।
বিবিসি গুহাটিকে “সবচেয়ে আকর্ষণীয়” গুহা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ৷ জনসাধারণের জন্য এই গুহাটি এখনো উন্মুক্ত হয়নি তবে খুব শীগ্রই হবে বলে আশা করা যায়৷
৪. আইস কেইভ, চিলি
চিলির পাতাগুনিয়া তে অবস্থিত আইস কেইভ নানা রঙের শ্বেত পাথরে তৈরি৷ একে মার্বেল কেইভও বলা হয় ৷

বছরের পর বছর ধরে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের দেয়ালে ঢেউয়ের ধাক্কা লাগায় গুহার দেয়ালগুলি মসৃণ এবং প্যাঁচানো ধরনের হয়ে গেছে। হ্রদের নীল পানিতে গুহার দেয়ালের প্রতিবিম্ব দৃশ্যটিকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। জলের প্রতিফলনে সূর্যের আলো পড়লে তা এতই আকর্ষণীয় হয় যে, এমন রঙের খেলা সচরাচর কোথাও দেখা যায় না।
বসন্ত কাল হচ্ছে গুহার প্রাকৃতিক রঙ উপভোগ করার উপযুক্ত সময়।
৩. ল্যাভেন্ডার গার্ডেন, লন্ডন
বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ল্যাভেন্ডার বাগান এটি ৷ ল্যাভেন্ডার প্রেমিকদের ভূ-স্বর্গটি ২৫ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ৷

নভেম্বর এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় হচ্ছে এখানে ভ্রমনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়৷ এখানে একদম প্রাকৃতিক উপায়ে ল্যাভেন্ডার চাষ করা হয় ৷
ফুলের পাশাপাশি নানা রঙ-বেরঙের প্রজাপতি ও পাখির দেখা মেলে এখানে ৷
২. সালার দে ইয়ুনি, বলিভিয়া
বলিভিয়ার আন্দিজ পাহাড়ের পাদদেশে সালার দে ইয়ুনির অবস্থান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়নাও বলা যেতে পারে একে।প্রাচীনকালে অনেকগুলি লেকের একসাথে মিলনের ফলে সালার দে ইয়ুনির জন্ম হয়েছিলো।

বর্ষাকালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লবণ-সমতল হয়ে যায় ১০৫৮২ কিলোমিটার বিশাল এই সালার দে ইয়ুনি। স্যাটেলাইটের শক্তি বা ক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য এটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আনুমানিক ১০ বিলিয়ট টন মজুদ রয়েছে এখানে ৷
অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, শুধুমাত্র লবণের টানেই আজ সালার দে ইয়ুনিতে গোটা বিশ্ব থেকে ছুটে আসে দলে দলে পর্যটক আর ফটোগ্রাফাররা। গোটা অঞ্চলকে আসলে লবণে ঢাকা একটি সমভূমি বলা চলে।
১. অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়ন, অ্যারিজোয়ানা
ধারণা করা হয়, কয়েক মিলিয়ন বছর আগে পানির প্রবাহের কারণে গভীর গিরিখাতটি সৃষ্টি হয়েছিলো। এর গভীরে আলো কম পৌঁছায় বলে এটাকে আরো বেশি গভীর মনে হয়। এর দেয়াল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রঙে দেখা যায়।

আমেরিকার বিখ্যাত এই গিরিখাদের দুটি অংশ আছে। ওপরের অংশটিতে সহজে যাতায়াত করা যায় বলে এই অংশেই ট্যুরিস্ট সমাগম বেশি হয়। নিচের অংশটিতে অপেক্ষাকৃত চড়াই-উতরাই বেশি।
বেলে পাথরের ক্যানিয়নটির রঙ বদলানো চেহারা দেখে যে কেউ স্তম্ভিত হতে বাধ্য।
তথ্যসুত্রঃ বিবিসি, TMW