এডসন আরান্তে ডো নাসিমেন্তো, নামটি কি কখনও লোকমুখে শুনেছেন? শুনেননি হয়তো! তাহলে আরেকটু সহজ করে দেই। মানুষটির নাম ‘পেলে’, যাকে ইউরোপ অথবা আমেরিকা নয় বরং পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়া বিংশ শতাব্দীর সকল ক্রীড়াবিদদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়।
২৩ অক্টোবর, ১৯৪০ । ব্রাজিলিয়ান এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিল একটি শিশু। বৈজ্ঞানিক টমাস আলভা এডিসনের নামের সাথে মিল রেখে মা-বাবা ছেলের নাম রাখলেন এডসন। তখন কি আর কেউ জানত যে ছেলেটি টমাস আলভা এডিসনের সাথে পাল্লা দিয়েই সারা পৃথিবীতে সুখ্যাতি ছড়াবে।
ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের ছোট শহর ট্রেস কোরা-সয়েস। ক্ষুদে এডসন এই শহরের বস্তিতেই দারিদ্রের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বড় হয়েছে। কিশোর বয়সে পরিবারকে সাহায্য করতে গিয়ে তাকে চাকরও খাটতে হয়েছে। স্থানীয় রেল স্টেশনে করতে হয়েছে মুচির কাজ। তবে যখন তার বয়স ১১ তখন এলাকার মানুষ বুঝতে পারল যে তার অসাধারণ একটি গুণ রয়েছে। ফুটবল দিয়ে সে যে কেরামতি গুলো দেখাত সেগুলো তার দ্বিগুণ বয়সের ছেলেরাও অনুকরণ করে দেখাতে পারত না। স্থানীয় একজন ফুটবল কোচ তার প্রতি আগ্রহ দেখালেন এবং এডসনকে প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করলেন। প্রশিক্ষণের শুরুতে এডসনকে কোন ফুটবল দেওয়া হয়নি। সংবাদপত্র মুড়িয়ে সেটাকে একটা মোজাতে পুরে দড়ি দিয়ে বেঁধেই সে বানিয়ে নিত তার নিজের মনগড়া ফুটবল।
এডসনের পরিবার তাকে ডিকো নামে ডাকতো। তবে তার বিশ্বখ্যাত ডাকনামটি এসেছে অন্যভাবে। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ভাস্কো দা গামার তৎকালীন গোলরক্ষকের নাম ছিল ‘বিলে’ যাকে এডসন ‘বিলে’ না বলে ‘পিলে’ ডাকতো। এক স্কুলবন্ধু তাই মজা করে তার নাম দিল ‘পেলে’। সেই থেকে জন্ম নিল ফুটবলার ‘পেলে’ আর গড়ল ফুটবলের অনন্য ইতিহাস।
পেলের ভিনগ্রহী ফুটবল কারুকাজই তাকে সর্বকালের সেরা এবং সফল ফুটবলার বানিয়েছে। সে যখন ক্যারিয়ারের সোনালি সময় গুলো পার করেছে তখন দেশ, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে তার সুনাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাজিলিয়ান কৃষ্ণবর্ণের এই মানুষটির খেলা দেখা নিয়ে ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ান গৃহযুদ্ধে গোলাগুলি পর্যন্ত হয়েছে। এমনকি ফুটবল খরার দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও দর্শকদের নজর কেড়েছিল এই পেলে। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ শুধু তাকে খেলতে দেখার জন্য স্টেডিয়ামে ভিড় করত। সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার একবার তার সম্পর্কে ইএসপিএন ডট কমকে বলেছিলেন, “বীরেরা একাই পথ পাড়ি দেয়, তবে যখন তারা অন্যকে সাহায্য করে তাদের জীবনকে মহিমান্বিত করে আর তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয় তখন তারা লোকমুখের রূপকথায় পরিণত হয়। যারা ফুটবলকে ভালবাসে তাদের কাছে এডসন আরান্তে ডো নাসিমেন্তো অথবা আপনারা যাকে পেলে বলে ডাকেন, সে একজন বীর”।
পেলের কোন সাফল্যই একদিনে অর্জিত হয়নি। ছোটবেলায় যখন সে হাঁটতে শিখেছে তখন থেকেই সে শুধু ফুটবল নিয়ে মেতেছে। যখন অন্যান্য শিশুরা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করত তখন পেলে ফুটবল নিয়ে তার পায়ের কলাকৌশল গুলো অনুশীলন করত। যখন তার বয়স মাত্র ১৪ তখনি সে বিভিন্ন নামকরা প্রতিযোগিতাগুলোতে খেলতে শুরু করে এবং এক বছর পরই তার কাছে পেশাদার ফুটবলে খেলার সুযোগ আসে। পেলে সাক্সেস ডট কমকে বলেন, “আমি সবসময় আমার পরিবারকে সাহায্য করতে আগ্রহী ছিলাম আর সেটাই আমার সাফল্য অর্জনের পেছনে প্রেরণা দিয়েছে। এজন্য আমার বাবা আমার প্রতি গর্ববোধ করতেন। আমার বয়সের অন্যান্য ছেলেরা যেসব সুবিধা ভোগ করত সেগুলো আমি ত্যাগ করেছিলাম। তার পরিবর্তে আমি আমার ফুটবল অনুশীলন এবং পায়ের কারুকাজের উপর ধ্যান দিয়েছিলাম”।
১৫ বছর বয়সেই পেলে ফুটবল কারুকাজে এতটা পারদর্শী হয়ে উঠেছিল যে ব্রাজিলের নামকরা পেশাদারি ফুটবল ক্লাব সান্তোস থেকে তার ডাক এসেছিল। সান্তোসের একটি প্রীতি ম্যাচে তিনি প্রথম গোল করেন। পরবর্তী বছরের শুরুতে অর্থাৎ ১৯৫৭ তেই পেলে মাত্র ১৬ বছর বয়সে সান্তোসের হয়ে নিয়মিত খেলার সুযোগ পান। শীঘ্রই তিনি লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এবং ব্রাজিল জাতীয় দলে খেলার ডাক পান। দক্ষিন আমেরিকার বাইরের মানুষেরা তাকে তেমন চিনতো না তবে তারা কয়েক মাস পরেই টের পায় যে ফুটবলের রাজা তার রাজত্ব করতে এসে গেছে।
সুইডেনে অনুষ্ঠিত হওয়া ১৯৫৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ছিল পেলের প্রথম বিশ্বকাপ। তখন তার বয়স মাত্র ১৭, বিশ্বকাপ ইতিহাসের কনিষ্ঠতম ফুটবলারও বটে। শুধু তাই নয়, কোন বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা এবং গোল করা কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়ও হয়ে যান তিনি। সুইডেনের বিপক্ষে খেলা সেই ম্যাচেই তিনি তার কৃতিত্ব সারা পৃথিবীকে জানান দেন। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে একসাথে দুই ডিফেন্ডারের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুর্দান্ত একটি গোল করেন। এটিকে ফুটবল ইতিহাসের সেরা বাক্তিগত প্রচেষ্টা হিসেবেও মানা হয়।
১৯৫৮ এর বিশ্বকাপ বিজয় ছিল পেলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের কেবল একটির গল্প। ১৯৫৯ সালে দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রাজিলের হয়ে অংশগ্রহণ করেন পেলে। ৮ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন তিনি। যদিও তার দল পুরো টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি তবে মাঠে ঠিকই আলো ছড়ান এই কালো মানিক।
১৯৬২ সালে চিলি বিশ্বকাপের শুরুতে পেলেকে সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল এবং তিনি তার জাত বিশ্ববাসীকে ২য় বারের মত চিনালেন। প্রথম ম্যাচেই মেক্সিকোর বিরুদ্ধে একটি এসিস্ট এবং ৪ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে একটি অসাধারণ গোল করেন। তবে পরের ম্যাচেই চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে একটি দূরপাল্লার শট নিতে গিয়ে ইনজুরির কবলে পড়েন। আর কোন ম্যাচেই খেলা হল না পেলের। তবে এবারের বিশ্বকাপ ফাইনালে আরেক প্রতিভাধর খেলোয়াড় গারিঞ্চার নেতৃত্বে ব্রাজিল চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে আবারও চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর মাঠ মাতাল।
১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ আসতে আসতে পেলেকে চিনে ফেলেছে পুরো বিশ্ব। সবার মুখে এক নাম, “পেলে”।
প্রথম ম্যাচেই বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রি কিক থেকে গোল পান পেলে। তবে বুলগেরিয়ান ডিফেন্ডারদের অত্যধিক ফাউলের শিকার হন তিনি। তাই পরের ম্যাচে বেঞ্চেই থাকতে হয় তাকে। তবে শেষ ম্যাচে বাঁচা মরার লড়াইয়ে পেলেকে ইনজুরিতে থাকা সত্ত্বেও মাঠে নামান কোচ ভিসেন্তে ফেওলা। ম্যাচ চলাকালীন পর্তুগীজ ডিফেন্ডার জোয়াও মোরাইস পেলেকে পৈশাচিক ভাবে ফাউল করলেও সেটাকে তোয়াক্কাই করলেন না রেফারি জর্জ ম্যাককাবে। যেহেতু সে সময় খেলোয়াড় পরিবর্তনের কোন নিয়ম ছিল না তাই পেলেকে খুড়িয়ে খুড়িয়েই বাকিটা সময় খেলতে হয়েছে। এই ম্যাচের পর তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আর কখনও বিশ্বকাপে খেলবেন না। যদিও পরবর্তীতে তার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়।
১৯৬৯ সালে পেলেকে আবার ব্রাজিল জাতীয় দলে ডাকা হয়। তিনি প্রথমে খেলতে অনিচ্ছা দেখিয়েছিলেন তবে পরে খেলতে রাজি হন। সেবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তিনি ৬ ম্যাচে ৬ বার ব্রাজিলের হয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়ান। ১৯৭০ এর মেক্সিকো বিশ্বকাপকেই পেলের শেষ বিশ্বকাপ হিসেবে মেনে নিয়েছিল সবাই। তবে ততদিনে তার ব্রাজিলিয়ান সতীর্থ খেলোয়াড়রা যথা গারিঞ্চা, নিল্টন সান্তোস, ভালদির পেরেইরা আর জিল্মাররা অবসরে চলে গিয়েছিল। যাই হোক, পেলে, জাইরজিনিও, গারসন, কার্লোস আলবার্তো তোরেস, টোস্টাও এবং ক্লোদোয়ালদোদের নিয়ে গড়া ১৯৭০ সালের এই ব্রাজিল দলকে এখনও ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৭০ এর মেক্সিকান বিশ্বকাপে পেলের নেতৃত্বে জাইরজিনিও, টোস্টাও, গারসন ও রিভেলিনো মিলে এক অপ্রতিরোধ্য আক্রমণভাগ তৈরি করেছিল। গুয়াদালহারাতে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে পেলের গোলেই চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে ২-১ গোলের লিড পায় ব্রাজিল। শেষ পর্যন্ত সেটি গড়ায় ৪-১ ব্যবধানে। ২য় ম্যাচে পেলের ফ্লিক থেকে বল লুফে নিয়ে একমাত্র গোলটি করেন জাইরজিনিও। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে রোমানিয়ার বিপক্ষে পেলে ২ টি গোল করেন আর ৩-২ গোলে জয় পায় তার দল ব্রাজিল। পেলের সুগঠিত নেতৃত্বের উপর ভর করে কোয়ার্টার ও সেমিফাইনালেও যথাক্রমে পেরু ও উরুগুয়েকে হারায় ব্রাজিল ।
মেক্সিকো সিটির আজটেকা স্টেডিয়ামে এবারের ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ইতালি। দুর্দান্ত এক হেডার গোল করে সূচনা করেন পেলে। পরের দুইবার বল বাড়িয়ে গোল করতে ভূমিকা রাখেন তিনি। গোল পায় জাইরজিনিও ও কার্লোস আলবার্তো। ম্যাচের একেবারে শেষ গোলে সাধিত হয় এক অনন্য কীর্তি। মাঠের বাইরে থাকা ২ খেলোয়াড় বাদে দলের বাকি সবাই এই গোলে অবদান রাখে। ফুটবল ইতিহাসে এটিকে অনেকেই শ্রেষ্ঠ সংঘবদ্ধ গোল হিসেবে মনে করে। অন্যদিকে, ১২ বছরে ৩য় বারের মত বিশ্বকাপ জিতে যায় পেলে ও তার দল। জুলে রিমে ট্রফি আজীবনের জন্য ঘরে তুলে নেয় ব্রাজিল। ম্যাচ শেষে পেলের মার্কারের দায়িত্বে থাকা ডিফেন্ডার বুর্গনিখ বলেন, ‘খেলার আগে আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, সবার মত পেলেও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, কিন্তু আমি ভুল ছিলাম’।
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ১৮ জুলাই ১৯৭১ সালে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে পেলে ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। পেলের মাঠে থাকাকালীন ব্রাজিলিয়ান দলের রেকর্ডঃ ৬৭ জয়, ১৪ ড্র আর ১১ হার। পেলে এবং গারিঞ্চা একসাথে খেলা অবস্থায় ব্রাজিল কখনও কোন ম্যাচে হারেনি।
৫ ফুট ৮ ইঞ্চির একজন মানুষ হওয়া হওয়া সত্ত্বেও পেলের হেডিং কৌশল ছিল অসাধারণ। বলকে হেড করার জন্য প্রায় অধিকাংশ ডিফেন্ডারের চেয়ে বেশি উচ্চতায় লাফাতে পারতেন। এছাড়া পেলের বেন্ডিং শটগুলি তাকে ফ্রি কিক ও পেনাল্টি কিক নিতে সহায়তা করত। যদিও তিনি পেনাল্টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন কারন তিনি মনে করতেন পেনাল্টি গোল করার জন্য কাপুরুষদের অবলম্বন করা মাধ্যম।
পশ্চিম জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী কাপ্তান ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মতে, ‘পেলেই সর্বকালের সেরা ফুটবলার, সে ফুটবল বিশ্বে প্রায় ২০ বছর রাজত্ব করেছে। ডিয়াগো ম্যারাডোনা, ইউহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি সবাই তার নিচে। পেলের সাথে আর কারো তুলনা হয় না’।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান পেলেকে হোয়াইট হাউজে স্বাগত জানানোর সময় বলেছিলেন, “আমার নাম রোনাল্ড রিগান, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তোমার তো নিজের পরিচয় বলার কোন দরকার নেই। কারণ সবাই জানে পেলে কে!’
ফুটবল ইতিহাসের তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি একে একে তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেছেন। তার বাকি অর্জনের গল্পগুলো আরও দুর্দান্ত। লিগে সর্বোচ্চ ১১ মৌসুমে গোলদাতাদের তালিকায় শীর্ষে থাকার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এছাড়া তিনি ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩২ টি অফিশিয়াল দলীয় শিরোপাও জয় করেছেন।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তাকে শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে ভূষিত করে। অন্যদিকে, টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিংশ শতাব্দীর ১০০ গুরুত্বপূর্ণ বাক্তিবর্গের একজন হিসেবে সম্মাননা দেয়।