একজন গার্মেন্টস মারচেন্ডাইসারের ছুটি মেলে বছরে দু’বার। দু ঈদে। পলক ফেলতেই ছুটি শেষ হয়ে যায়। এবারের ২০১৭ এর ঈদুল আযহার ছুটিটুকু কাজে লাগাতে চাইলাম আমরা ফ্যাক্টরির জনাকয়েক মারচেন্ডাইসার, উদ্যোক্তা আরমান ভাই, সাথে গনেশ সরকার। আমি শুরু থেকেই দলে।পাশের চেম্বারের রবিন ভাই সম্মতি প্রকাশ করলেন তিনিও আছেন। দলের আরেক সদস্য সিফাত মালটি একজন ডি জে কাম মারচেন্ডাইসার। সেও তৈরি।
আমাদের টেকনিকাল ইঞ্জিনিয়ার তপন দা খানিক রুগ্ন কিসিমের মানুষ, সাহস করে ফেললেন সাথে এসিস্টেন্ট প্রদীপ বাবুও।
সদস্য দাড়াল ৭ জন, গন্তব্য প্রথমে ছিল নেপাল। ইন্ডিয়ার ট্রান্সপোর্ট ভিসা সংগ্রহ এবং সমসাময়িক জটিলতায় নেপাল বাতিল, সিদ্ধান্ত নিলাম ভুটানের ।
দেশের বাইরে কোথাও প্রথম যাত্রা, আমরা চেয়েছিলাম শতভাগ নিরাপত্তা ,মধুর অভিজ্ঞতায় টইটম্বুর হোক।
খরচের ব্যাপারটাও একেবারে গা ঘেঁষা। সবার সমর্থনে আমরা কোন প্যাকেজের আওতায় যাওয়াকে প্রাধান্য দিলাম।
কসমস হলিডের প্যাকেজ–জনপ্রতি ১৯৫০০।
আমার মতে এমন কমার্শিয়াল চিন্তাধারার প্যাকেজে না যাওয়াই ভাল।
পথ থেকে পথে ০৪/০৫-০৯-১৭
আমরা বিকেলে ঘর ছেড়ে বের হয়েছি। কল্যাণপুর থেকে বাস।আটটার গাড়ি ছাড়ে এগারোটায়।প্যাকেজের আওতায় লোক সংখ্যা ত্রিশজন। বাসে যে যার মত। ভেতরে এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। গানে গানে প্রায় ঘুম ঘুম ভাব। হঠাৎ তন্দ্রা ছুটতেই দেখি গাড়ি বগুড়ার ফুড ভিলেজে। এখানে খাবারের প্রচুর দাম,কিন্তু মান ঠেকেছে তলানিতে, হালকা নাশতা শেষে আবার যাত্রা শুরু করে আমরা যখন বুড়িমারি বর্ডারে পৌঁছেছি তখন প্রায় সকাল সাতটা । ইমিগ্রেশন জটিলতা শেষ করে ইন্ডিয়াতে ঢুকতে ঢুকতে সূর্য তখন মধ্যগগনে। ওপারের ফর্মালিটিস শেষ করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জিপ যোগে জয়গাঁও বর্ডার। প্যাকেজ থেকেই সে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনিতে এই ধরনের জিপ ২০০০/২৫০০ রুপিতে পাওয়া যাবে আবার একলা গেলে বাস সুবিধা আছে। জয়গাঁও থেকে ডিপার্চার এর সময় ঘড়ি জানান দিচ্ছে বেলা চারটে । পেটে তখন ছুঁচো রীতিমত হিপ হপ পারফর্ম করছে।
আমরা সামনে এগুতে লাগলাম, কিছুদূর সামনেই বিশাল রাজকীয় ফটক। তার ওপারেই ভুটানের শহর ফুন্সুলিং।
বাম পাশে ছোট করে যাবার রাস্তা, কারন প্রধান ফটক দিয়ে কোন মানুষ যাতায়াত করতে পারবে না। দরজাটা পেরোতেই হুট করে যেন এক রূপকথার দেশ। পরিস্কার রাস্তাঘাট, কোলাহল ছাড়া ,ছিমছাম, ছোট ছোট বাড়িঘর।

Source: bhutanholidays.net
হোটেল নামগায়।আমাদের তখনকার আবাস।
হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ড বুফেটে লাঞ্চ শেষে ভিসার কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা সন্ধ্যায় বের হলাম । রাতের ফুন্সুলিং যেন অনন্য রূপবতী। নিয়ন হলুদ আলোয় এক রকম স্বর্গীয় সন্ধ্যা নামে প্রতিদিন।
সে রাতে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াতে বেশ ভাল ঘুম হয়েছিল।
জ্ঞাতব্য-১ ধূমপান নিষিদ্ধ, জরিমানায় প্রথমবারে ৫০০ রুপি, দ্বিতীয়বারে দু থেকে সাত বছরের জেল।
জ্ঞাতব্য-২ ট্রাফিক আইন খুবই কড়া, রাস্তা পারাপারে অবশ্যই জেব্রা ক্রস ব্যবহার করুন।
থিম্পু অভিমুখে ০৬-০৯-১৭
দিন শুরু করেছিলাম বেশ ভোরে, এক রাশ চনমনে ফূর্তি আর চঞ্চলতা নিয়ে।
হোটেল মুখেই নব্বই দশকে নির্মিত এক বৌদ্ধ উপাসনালয়, ‘জাংদলপেরি’ স্বাস্থ্যসচেতন ভুটানিজরা উপাসনার সাথে প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফেলে। তাছাড়া এখানে দর্শনীয় তেমন কিছু নেই।
নাস্তা শেষে গন্তব্য রাজধানী থিম্পু, ছয় ঘণ্টা ব্যাপী প্রায় ১৭০ কিলোমিটার পথের জার্নি।যাত্রাপথের ছয় ঘণ্টা প্রাকৃতিক নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম পুরো সময় জুড়ে, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে রাস্তা, চারপাশে সবুজের হাতছানি, তেজস্বী ঝর্নার সমারোহ কিছু বাদে বাদেই। তেনজিং ওইয়েংডি নামে একজন ছিলেন আমাদের চালক। ভুটানের শেষ দিন পর্যন্ত সাথেই ছিলেন ।
থিম্পু শহর অতিমাত্রায় গোছানো, পাহাড়ের বুকে ছোট ছোট বাড়ি শহরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
হোটেল শান্তিদেবায় তখনকার মত চেক ইন করলাম। আবহাওয়ার আচরণ বরাবরই লাজুক। এত ঘণ্টার জার্নি গায়ে একটু আঁচও পড়েনি।
দুপুরের লাঞ্চ শেষে আমরা বিশ্রাম নিলাম। বিকেলে শহরটা দেখতে বের হয়েছি। হোটেলের ঠিক ওপর পাশে বিশাল জায়গা। ক্লক টাওয়ার, বলা চলে আমাদের টি এস সি । আকারে ছোট কিন্ত পরিপাটি।
সে সন্ধ্যায় থিম্পুর পথঘাট আর কিছু কেনাকাটা করেই পার করলাম।
জ্ঞাতব্য-১ ভুটানের এবং বাংলাদেশের সময় এক।
জ্ঞাতব্য-২ ভুটানের মুদ্রা ভারতের মুদ্রার সমমান।
নতুন থিম্পু ০৭-০৯-১৭
রাতের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার আবেশে দারুন ঘুম আমাদের সকালে এনে দিয়েছিল চমৎকার তারুণ্য।
শহর জীবিত হয় মূলত নয়টায়। পরিকল্পনায় এবার থিম্পু শহর সাইটসিয়িং।
একটু বলি মাঝে, প্যাকেজের বড় অসুবিধা হল, আপনার মত প্যাকেজের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। যেমন লেট করে গাড়ী তে আসা, স্পটে সময় বেশী নেওয়া, মুখ বুজে মেনে নিতেই হবে।
আমরা কয়েকটা স্পট ঘুরি লাঞ্চের আগ পর্যন্ত ।
- বুধা ধরেনমা, এন্ট্রি ফি নেই।
শহরের অদূরে ঐতিহাসিক বৌদ্ধ উপাসনালয়, ছাদের উপর গোল্ড প্লেট মালয়েশিয়ান অর্থায়নে করা বৌদ্ধমূর্তি।
এখানে কলার ছাড়া জামা পড়ে ঢোকা নিষেধ। মহিলাদের জন্যে ফুলহাতা বাঞ্ছনীয়। এবং ক্যামেরা নট এলাউড।
বুদ্ধের মূর্তির মুখোমুখি ছবি তোলা যাবে না। - মথিথাং তাকিং প্রিসারভেশন।
তাকিং মূলত এদেশের জাতীয় পশু, ছাগল ভেড়া প্রজাতির।এই খামারে ঢুকতে ১০০ রুপি খরচ করতে হবে আপনাকে। প্রোপারলি ওয়েস্ট অফ মানি।মথিতাং তাকিং প্রিসারভেশন - আরচারি ফেডারেশন
আরচারি বা তিরন্দাজি ভুটানের জাতীয় খেলা। আহামরি কোন কিছু নেই।এন্ট্রি ফ্রি।
তার ঠিক ওপাশে রাস্তার ধারে ছোট বেনামি পার্ক আছে, সুন্দর । - টপ ভিউ থেকে থিম্পু শহর।
এছাড়া মেমরিয়াল চরতেন, টেক্সটাইল মিউসিয়াম সহ আরও দর্শনীয় স্থান ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের আস্থাকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে সেগুলো সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। দুপুরের লাঞ্চের পর আমাদের থিম্পু দর্শন এখানেই শেষ,কিছু সময় বিশ্রাম নিলাম, সন্ধ্যায় কেনাকাটা।থিম্পুর জন্যে এক রাশ শুভকামনা নিয়ে সে রাতে বিছানায় গেলাম।
অন দ্যা ওয়ে টু পারো ০৮-০৯-১৭
সকাল আটটার গাড়ী কয়েকজন সদস্যের বদৌলতে ছাড়ল নয়টা ত্রিশের খানিক পরে । গন্তব্য নিকটস্থ শহর পারো।
থিম্পু থেকে আনুমানিক ৫০ কিঃ মিঃ অদূরে ছবির মত শহর।
আমরা হোটেলে যাবার আগে কয়েকটা প্লেস ঘুরে ফেলি।
পারো এয়ারপোর্ট
বিশ্বের সেরা দশ ভয়ংকর এয়ারপোর্টের একটি। তাই প্লেন ভাড়া বেশ চওড়া। ভেতরে যাওয়া যাবে না, টপ ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখতে হবে।

পারো মিউসিয়াম
সাজানো গোছানো, ছোট। এন্ট্রি ফী ত্রিশ রুপি। ক্যামেরার নিষেধাজ্ঞা এখানেও ।
ভেতরে কিছু স্টাফ করা প্রাণী, তাদের দেবতাদের মুখোশ , কিছু এন্টিক কালেকশন।

পারো ডেজং
আরেকটি ঐতিহাসিক উপাসনালয়। এন্ট্রি ফি ৩০০ রুপি।দেশে ফেরার পর মনে হচ্ছে ভেতরে না যাওয়াটা ভুল ছিল। দুপুরের লাঞ্চ আর বিশ্রাম কুয়েনফেন হোটেলে। লাগোয়া বারান্দা,পাশে বিশাল খালি জায়গা, একেবারে স্বর্গীয় সুন্দর।
সময় স্বল্পতার দরুন সে আমেজ ভালমত উপভোগ করা হয়নি।
লাঞ্চ শেষে আমরা রওনা দিলাম ভুটানের প্রখ্যাত ‘তাকসাং মনস্টারি’।
টাইগার নেস্ট নামেও এর ব্যাপক পরিচিতি আছে। ভুটানের বিস্ময় আর অবারিত সৌন্দর্যের প্রতীক।
ভূমি থেকে প্রায় তিন হাজার ফিট উপরে অবস্থিত, মূলত এটি একটি মন্দির।
প্যাকেজের কমার্শিয়াল চিন্তা-ভাবনার কুফলে আমরা সেখানে পৌঁছোই বিকেল নাগাদ, অথচ থিম্পুর জন্যে দুই দিন নয় পারোর জন্যে দুই দিন প্রয়োজন।
ধারে কাছে টপ ভিউ পয়েন্ট আছে সেখান থেকেও দেখা যায়, কপালদোষে আমরা সে সুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিলাম।
পারো তে হ্যান্ডিক্রাফট শপের ছড়াছড়ি বহুমাত্রায়, দাম আকাশছোঁয়া। সন্ধ্যাটুক ঘুরে বেড়িয়ে রাতে ফিরে গেলাম হোটেলে। রাতভর সহকর্মীদের সাথে আড্ডাবাজি আর হই-হুল্লোড়।
ভুটানের উপসংহার ০৯/১০-০৯-১৭
এরপর শুধু বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা,জীবনের ফিরতি ডাক নিয়ে। খুব ভোরে রওনা দিই আমরা, ফেরার পথ আগের মতই, পারো থেকে সোজা ফুন্সুলিংয়ের বর্ডার, জয়গাঁও পেরিয়ে সোজা চেংরাবান্দা এরপর দেশের কাছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে ভুটাননামা এখানেই শেষ।
এখন জীবনের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে বিভীষিকাময় রাতের গল্প বলতে হয়। বর্ডার যখন পেরোই, সূর্য তখন তার দোকান গুছিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। গাড়ি ছেড়ে যাবার কথা সন্ধ্যা সাতটায়, বিভিন্ন তথ্য পেয়ে যাচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে।

শেষে জানা গেল, গাড়ি এখন টাঙ্গাইল আটকে আছে, পরের দিন অফিস ধরবার চিন্তা, তার উপর সেদিনের টানা জার্নি। রাত কেবল বিছানা খুজছিল। কিন্তু তেমন সুবিধা সেখানে কই?
বাইরে বৃষ্টির প্রকোপ, সমানতালে মশার উৎপাত যাত্রীদের বিরক্তি চরম পর্যায়ে, ঈদের শেষে সবার বাড়ি ফেরার তাড়া।আমরা নানানভাবে হিসেব কষে যাচ্ছিলাম, কোন সান্ত্বনামূলক ফলাফল নেই তবুও।
শেষমেশ মাঝরাতে পাওয়া লোকাল বাসের শেষ সিংহাসনে চড়েই ফিরতে হয়,ঢাকার মহাখালিতে নামি বিকেলে।
এক নজরে ভুটান
*জনসংখ্যাঃ সাড়ে সাত লক্ষ
*ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত শিক্ষা ফ্রি।
*গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ফ্রি।
*ধূমপান নিষিদ্ধ।
*আপেল,কমলা আর কিছু ফল ছাড়া সব কিছুই ইম্পোরটেড সুতরাং জিনিসপত্রের দাম বেশ চওড়া।
*রাজা এবং রাজপরিবার এখানে সর্বেসর্বা।ষষ্ঠ রাজার শাসন চলছে।
*আয়ের মূল উৎস টুরিসম এবং আপেল/কমলা রপ্তানি।
*ছোটবড় কমবেশ সবাই হিন্দি জানে
যা যা প্রয়োজন
ইন্ডিয়ান ট্রানজিট ভিসা,
গাড়ির টিকেট, হোটেল বুকিংয়ের কাগজ,ব্যাংক স্টেটমেন্ট, 2×2 সাইজ ছবি (২ কপি)
ইন্ডিয়ার ট্রান্সজিট ভিসা হলেই ভুটানের ভিসা পোর্ট এন্ট্রি পাস পাওয়া সহজ।
আপনার ট্যুর হোক শান্তিপূর্ণ।