দস্যি ছেলে লক্ষী আজঃ সুকুমার রায় সেই দস্যি ছেলেটি।

2

বাংলা সাহিত্যের হালকা পাঠক বলে অপমান করতে পারেন, কিন্তু আজীবন আমি বলে যাব বাংলা সাহিত্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের দুইজন লেখক একজন সুকুমার রায়, আর একজন শিবরাম চক্রবর্তীকেন এঁরা এই প্রশ্ন যদি আমাকে বলা হয় তবে বলব ভাষা নিয়ে খেলেছেন এঁরাভেঙেছেন, জোড়া দিয়েছেন, যা ইচ্ছা তাই করেছেন

সুকুমার রায়ের ভাষায়,

“হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),

হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।”

কিংবা,

“কাটা ছেঁড়া ঠুক্‌ঠাক্, কত দেখ যন্ত্র,

ভেঙে চুরে জুড়ে দিই তারও জানি মন্ত্র।

চোখ বুঝে চট্‌পট্ বড়-বড় মূর্তি,

যত কাটি ঘ্যাঁস্ ঘ্যাঁস্ তত বাড়ে ফূর্তি।”

কয়দিন আগেই আমার এই প্রিয় সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের জন্মদিন ছিল, ৩০ অক্টোবরবিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছেলে তিনিআদতে তাঁরা ছিলেন ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রামের অধিবাসী,  তারপর কলকাতা চলে যানসুকুমার রায় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতি ছাত্র, এবং বিলেত থেকেও বেশ খানিকটা পড়াশোনা করে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর পরিচয় যদি দিতে হয় তাহলে এগুলো কোন পরিচয়ই নাতাঁর পরিচয় দিতে হবে তাঁরই ভাষায়,

“আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা

    স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,

আয়রে পাগল আবোল তাবোল

    মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।

আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে

    নাইকো মানে নাইকো সুর,

আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়

    মন ভেসে যায় কোন সুদূর।”

সুকুমার রায়কিছু কি বুঝতে পারলেন? মনে হয় পুরোপুরি নানিজের মত করে, নিজের ভাষায়, নিজের আনন্দের যে এত অসাধারন লিখা যায় তা সুকুমার রায়ের লেখা না পড়লে বোঝাই যেত নাবাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম ননসেন্স রাইম তিনি রচনা করেছেনতাঁর প্রথম কবিতার বই ‘আবোল তাবোল’ এর আবোল তাবোল জগতে যে হারিয়েছে সেই বুঝবে হাসির মাঝেও কঠিন সত্য কিভাবে লুকিয়ে থাকেমূলত ‘সন্দেশ’ নামক মাসিক পত্রিকা যেটা প্রথম বের করেন তাঁর বাবা উপেন্দ্রকিশোর সেখানেই তাঁর লেখার হাতেখড়িনিজেদের বাড়িতেই ছিল ছাপাখানা, সবাই লিখছে, বিভিন্ন লেখকের আসা যাওয়া হচ্ছে বাড়িতে এই রকম পরিবেশে কলম যে তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাবে, ফুলঝুরির মত লেখা বের হবে সেটাই স্বাভাবিকতার উপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বন্ধু স্থানীয় ছিলেনউপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর পর সুকুমার রায় বেশ কিছুদিন নিজেও এই সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনা করেন

কলেজে পড়ার সময় তিনি এক ক্লাব খুলেন, নাম হল ‘মন্ডা ক্লাব’কেমন যেন লাগছে যেন নামটা, তাই না? আসলে এটা Monday Club এর সুকুমার রায় ভার্সনএই ক্লাবের সভ্যদের নিয়েযে সভা হত তার দাওয়াত পত্র গুলো ছিল বেশ অদ্ভুতনিচে কিছু নমুনা দিচ্ছি ।

“আমাদের মন্ডা-সম্মিলন।

আরে না – তা’ না, না –

আমাদের Monday সম্মিলন।

আমাদের হল্লারই কুপন।

তার উড়ো চিঠির তাড়া

মোদের ঘোরায় পাড়া পাড়া,

কভু পশুশালে হাসপাতালে আজব আমন্ত্রণ।

( কভু কলেজ-ঘাটে ধাপার মাঠে ভোজের আকর্ষণ )।”

কিংবা,

“শনিবার ১৭ই

সাড়ে পাঁচ বেলা,

গড়পারে হৈ হৈ

সরবতী মেলা।

অতএব ঘড়ি ধ’রে-

সাবকাশ হয়ে,

আসিবেন দয়া করে

হাসি মুখ লয়ে।

সরবৎ, সদালাপ,

সঙ্গীত ভীতি –

ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,

জেনে রাখ “

একটা মজার নিয়ম ছিল এই ক্লাবের সভ্যদের জন্যএই ক্লাবে কোন গুরুগম্ভীর কথা বলা যাবে নাতাছাড়া তিনি ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে একটি নাটকের গ্রুপ খুলেছিলেন

শুধু কবিতা নয় গদ্যেও তাঁর প্রতিভা ছিল অসাধারন‘হযবরল’ থেকে শুরু করে ‘পাগলা দাশু’ সবগুলোই ছিল অসাধারনহযবরল যে শুধু হাসির গল্প তা নয়, সমাজের বিভিন্ন দিকের অবস্থা বিভিন্ন চরিত্রের ভাষ্য দিয়ে ফুঁটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনিএই যেমন শেয়াল যখন হিজবিজবিজকে প্রশ্ন করল যে তুমি কোর্ট চেনতখন উত্তরে হিজবিজবিজ বলল, “তা আর জানি নে? একজন নালিশ করে তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী। তারও একজন উকিল থাকে। এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে। আর একজন জজ থাকে, সে বসে-বসে ঘুমোয়। ” এই যে হাসির মাঝখানে বলা অনেক কথা সেটা সুকুমার রায় ছাড়া এক শিবরাম আরেক সৈয়দ মুজতবা আলির লেখায় আমি পেয়েছিবরং সুকুমার রায় সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলি নিজেই বলেছেন, “সুকুমার রায়ের মত হাস্যরসিক বাংলা সাহিত্যে আর নেই সে কথা রসিক জন মাত্রেই স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু এ কথা অল্প লোকেই জানেন যে, তাঁর জুড়ি ফরাসী, ইংরেজী, জর্মন সাহিত্যেও নেই, রাশানে আছে বলে শুনিনি। এ-কথাটা আমাকে বিশেষ জোর দিয়ে বলতে হল, কারণ আমি বহু অনুসন্ধান করার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছি।”

নাট্যসাহিত্যেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘শব্দকল্পদ্রুম’, ‘হিংসুটে’, ‘অবাক জলপান’ এই নাটক গুলো পড়ে দেখতে পারেনভাষার চমৎকার প্রয়োগ, আর অসাধারণ বাচনভঙ্গি সমাহার ছড়িয়ে আছে নাটকগুলোতেতিনি নিজেই বলে গেছেন, ” কথায় কাটে কথার প্যাঁচ।”

বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের শুরুটাও অনেকটা উনারই হাত দিয়ে‘প্রফেসর হেসোরাম হুশিয়ারের ডায়েরী’ সম্ভবত বেশ সার্থক একটা কল্পবিজ্ঞানের গল্পকল্পনার বিস্তার যে কত ব্যাপক তাঁর লেখা না পড়লে বোঝা সম্ভব নাএত চমৎকার মুক্তভাবে মনের জানালা, ভাষার জানালে খুলে সাহিত্য উদ্যানে ঘুরে বেড়ানো মানুষ তিনি

এত প্রতিভাবান মানুষটি মারা গেছেন মাত্র ৩১ বছর বয়সেবাংলা সাহিত্যের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে উনার অকাল প্রয়াণে সেটা যিনি উনার লেখা পড়েছেন তিনিই বুঝতে পারবেনসুকুমার একজনই ছিলেন, আর সুকুমার জন্মায়নি, জন্মাবেও নাতিনি মারা গিয়েছিলেন কালা জ্বরেতখন কালা জ্বরের কোন চিকিৎসা ছিল নাআফসোস তখনই উনার মৃত্যুর পরের বছরই কালা জ্বরের ঔষধ সোডিয়াম স্টিবোগ্লুকোনেট আবিষ্কৃত হয়ইস আর একটা বছর আগে যদি আবিষ্কার হত, আমরা হয়ত এত প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিককে হারাতাম না

Leave A Reply
2 Comments
  1. Vwdthw says

    buy glycomet medication – purchase losartan online cheap order precose pills

  2. Lclgjf says

    repaglinide 1mg uk – jardiance cost order empagliflozin 25mg without prescription

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More