বিজ্ঞান, কৌশল আর ইলিউশানের সম্মিলিত মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় একটি শিল্প। সে শিল্পের কেতাবি নাম ম্যাজিক। বাংলায় যাকে বলা হয় যাদু। পাড়ার হাটবাজার থেকে শুরু করে রামপুরাস্থ বিটিভি ভবন পর্যন্ত যাদুবিদ্যা দ্বারা আবালবৃদ্ধবনিতাকে বিমোহিত করে আসছেন যাদুশিল্পীরা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার অন্যতম আকর্ষণ ছিল জুয়েল আইচের একক ম্যাজিক শো। রুমালের ভেতর থেকে পায়রা বের করা, মুখ দিয়ে দুধ খেয়ে সেই দুধ কান দিয়ে বের করে দেয়া, জলজ্যান্ত তরুণীকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়ার মত ভেলকিবাজিতে মাতিয়ে রাখতেন দর্শকদের। বলে রাখা ভাল, আমাদের জুয়েল আইচ বিশ্বের তাবৎ বাঘা বাঘা যাদুশিল্পীর মধ্যে একজন যিনি কিনা পৃথিবীর ২৯৫ জন শ্রেষ্ঠ যাদুশিল্পীর তালিকায় লাল সবুজ পতাকার ঝাণ্ডা বহন করে আছেন অত্যন্ত গৌরবের সাথে। জুয়েল আইচ ‘ইতিবৃত্ততে’ যথাসময়ে আসবেন তবে তার আগে আমাদের পাঠকদের জন্য নিয়ে এলাম কিছু ম্যাজিকের গোপন ফর্মুলা। যা পরিপক্বতার সাথে পালন করতে পারলে খোদ আপনিই হয়ে যেতে পারেন একজন পুঁচকে ম্যাজিশিয়ান। তবে আর দেরি কেন চলুন জেনে আসি আপনার দেখা কিছু ম্যাজিকের গোপন কৌশল।

দুধ ও পানির যাদু
একটি টেবিলের উপর একটি বোতল আর দুইটি কাঁচের গ্লাস থাকবে। বোতলে থাকবে স্বচ্ছ পানি। ম্যাজিশিয়ান পানির বোতল থেকে প্রথম গ্লাসে পানি ঢালবেন। চোখের পলকে পানিটুকু দুধে পরিণত হবে। ম্যাজিশিয়ান তখন সেই দুধ দ্বিতীয় গ্লাসে ঢালবেন। প্রথম গ্লাসের দুধ আবার পানিতে পরিণত হয়ে যাবে। দর্শক হা করে তাকিয়ে থাকবে।
*উপকরণ : এই যাদুটি আপনি নিয়মমাফিক অনুশীলন করলে নিজেও করে দেখাতে পারেন। তবে প্রাথমিকভাবে এর জন্য কিছু উপকরণের দরকার পড়বে। একটা বোতল, দুটি কাঁচের গ্লাস, চুনের পানি, সোডিয়াম কার্বনেট এবং হাইড্রোক্লোরিক এসিড জোগাড় করতে পারলেই যাদুটি মঞ্চস্থ করা সম্ভব।
*কৌশল : অল্প পরিমাণ চুনের পানি, পানিতে মিশিয়ে ছেঁকে বোতলে পুরে দিতে হবে। প্রথম গ্লাসে কিছু সোডিয়াম কার্বনেট পানির সাথে মিশিয়ে রাখতে হবে। এবার বোতল থেকে চুনের পানির মিশ্রণ প্রথম গ্লাসে ঢেলে দিতে হবে। সোডিয়াম কার্বনেটের স্পর্শে প্রথম গ্লাসের পানি সাদা দুধের মত হয়ে যাবে। দ্বিতীয় গ্লাসে থাকবে পরিমাণমত হাইড্রোক্লোরিক এসিড। প্রথম গ্লাসের নকল দুধ দ্বিতীয় গ্লাসে ঢাললেই হাইড্রোক্লোরিকের স্পর্শে তার সাদা ভাবটা কেটে যাবে। ফলে আগের মত পরিষ্কার পানির রূপ ধারণ করবে। ব্যস হয়ে গেল দুধ আর পানির ম্যাজিক!
তরুণী অদৃশ্যের ম্যাজিক
মঞ্চে একটি উঁচু টেবিল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং তারপাশে একটি কাঠের সিঁড়িও আছে। তরুণী সিঁড়ি বেয়ে টেবিলের উপর গিয়ে দাঁড়ালো। যাদুকর তার চাঁদর দিয়ে তরুণীকে ঢেকে দিলেন। ওয়ান, টু, থ্রি রব তোলে চাঁদর ধরে টান দিতেই তরুণী অদৃশ্য! দর্শকদের চোখ যেন বিশ্বাস করতে চায় না। এটা কিভাবে সম্ভব?
*কৌশল : তরুণী যে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছিল প্রকৃত অর্থে সেটি কোন সিঁড়ি নয়, সিঁড়ির আদলে একটি বাক্স। সিঁড়ির ঠিক উপরে একটি গোপন দরজা আছে যেটি ব্যবহার করে সহজে মেয়েটি ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। পাশে রাখা টেবিলে একটি বিশেষ জিনিস লুকানো আছে, যাদুবিদ্যার ভাষায় যাকে বলা হয় ‘গিমিক’। গিমিকের লোহার পাতগুলো নাটবল্টুর সাহায্যে ঢিলাভাবে ক্রস করে লাগানো থাকে। যার কারণে এটিকে লম্বালম্বিভাবে খোলা যায়, ভাঁজও করা যায়। টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখা গিমিকের মাথায় দুদিক থেকে বাঁকা একটি গোল তার এমনভাবে লাগাতে হয় যাতে করে চাঁদর ঢাকা অবস্থায় এটিকে মনে হয় কোন মেয়ের মাথা ও কাঁধ। গিমিকের একটি পাত টেবিলের ভেতর অংশে লাগানো থাকবে। অন্য পাতের সাথে বাঁধতে হবে একটি শক্ত সুতা। সুতাটি একটি কপিকলের ভেতর দিয়ে টেবিলের নিচে ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে একজন সহকারীর হাতে থাকবে। সহকারী সুতো ধরে টান দিলে এটি লম্বালম্বিভাবে টেবিলের উপর উঠে যাবে। আবার সুতোলে ঢিল দিলে ভাঁজ হয়ে টেবিলের মধ্যে চলে যাবে।
তরুণী সিঁড়ি দিয়ে টেবিলে উঠার পর জাদুকর তাকে ঢাকতে থাকবেন। এরই ফাঁকে সে সিঁড়ির মধ্যে লুকিয়ে পড়বে। যাদুকরের সহকারী সুতো ধরে টান দেয়ার সাথে সাথেই গিমিক খাড়া হয়ে উঠে যাবে। যাদুকর গিমিককে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিবেন। ঠিক এ জায়গাটিতে দর্শক বোকা বনে যাবে এবং মনে করবে এটি আসলেই ঐ তরুণী। এরপর যাদুকর ওয়ান, টু, থ্রি বলে চাঁদরটি সরিয়ে নেয়ার ভান করবেন এবং পেছনের লুকানো সহকারী সুতো ঢিল দিবে। যার ফলে চাঁদর ভাঁজ হয়ে টেবিলের মধ্যে ঢুকে যাবে। আর দর্শক বোবা হয়ে তরুণীকে খুঁজতে থাকবে।
টাকা অদৃশ্য করার যাদু
বাম হাতের মুঠোয় একটি কয়েন রেখে যাদুকর মুঠোতে ফুঁ দিবেন। সাথে সাথে টাকা অদৃশ্য!
*কৌশল: মূলত এই ম্যাজিকের জন্য চুম্বকের সর্বাংশ সাহায্য নিতে হবে। চুম্বক নিকেলের কয়েনকে ভাল আকর্ষণ করে। অদৃশ্য করার জন্য তাই নিকেলের কয়েনের সাহায্য নিতে হবে। দর্শকদের ভ্রমে ফেলার জন্য কোটের বাম হাতের আস্তিনে রাখতে হবে ছোট্ট একটি চুম্বক।
ডান দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে কয়েনটিকে উঁচিয়ে ধরতে হবে এবং কয়েনের দৃশ্যমানতার নিশ্চয়তা নিতে হবে। তারপরে বাম হাতের তালুতে কয়েনটি রাখতে হবে। ডান হাত দিয়ে আবার বাম হাতের তালু থেকে কয়েন তুলে নিতে হবে। তৎক্ষণাৎ বাম হাতের আস্তিনে দ্রুতগতিতে কয়েন ছুড়ে দিতে হবে যাতে চুম্বকের সাথে লেগে থাকে। এবার ভান ধরতে হবে যে আসলেই ডান হাতেই কয়েনটি আছে। তারপর ডান হাতের তালু বাম হাতের তালুতে লাগিয়ে মুঠোবন্দি করতে হবে। দর্শক মনে করবে এবার বুঝি কয়েন বাম হাতেই আছে। মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে হাত বাম হাত খুলতেই দেখবে কয়েন উধাও!
আগুনের ম্যাজিক
টেবিলের উপর ‘পেট্রোল’ লেখা একটি বোতল ও লাইটার রয়েছে। ম্যাজিশিয়ান দর্শকদের কাছ থেকে একটি রুমাল চেয়ে নিলেন। লাইটার দিয়ে রুমালে আগুন ধরিয়ে দিলেন। রুমাল জ্বলে উঠতে লাগল। ঠিক তখন দু হাত চেপে ধরে যাদুকর আগুন নিভিয়ে দিলেন। দর্শকদের সামনে রুমাল উঁচিয়ে ধরলেন। কিন্তু রুমালে কোন আঁচই লাগেনি!
*উপকরণ : এক বোতল ইথাইল এলকোহল, একটি রুমাল ও লাইটার।
* কৌশল: টেবিলে ‘পেট্রোল’ লেখা বোতল হচ্ছে এই ম্যাজিকের মূল অস্ত্র। পেট্রোল লেখা থাকলেও আদতে ওখানে থাকবে ইথাইল এলকোহল। রুমালে ইথাইল এলকোহল লাগিয়ে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাতে হবে। মোটামুটি জ্বলবার আগেই রুমালকে চাপা দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলতে হবে। যার ফলে রুমালটি অক্ষতই থেকে যাবে।
সুতো দিয়ে বরফ তোলা
পানিভর্তি একটি কাঁচের গ্লাস ও বরফের একটি টুকরো টেবিলে রাখা আছে। বরফের টুকরো পানির মধ্যে ভাসছে। যাদুকর কয়েকজন দর্শককে স্টেজে ডাকলেন। সুতো দিয়ে বললেন,
বরফের টুকরো তুলতে। সবাই ব্যর্থ হলেন। এবার যাদুকর মন্ত্রটন্ত্র পড়ে সুতো দিয়ে বরফের টুকরোকে স্পর্শ করলেন। সুতোটি দিয়ে বরফের টুকরোকে স্পর্শ করলেন। সাথে সাথে বরফ উঠে এল।
*উপকরণ : বড় সাইজের একটি কাঁচের গ্লাস, লম্বা সুতো, অল্প পরিমাণ পানি ও লবণ
* কৌশল : সুতো বা বরফে কোন কৌশল নেই, কৌশল লবণে। দর্শক যখন ব্যর্থ হবেন তখন যাদুকর তাদের যার যার আসনে ফিরে যেতে অনুরোধ করবেন। এরপর তিনি যাদুর ভঙ্গিমায় সুতো দিয়ে বরফ তুলার চেষ্টা করতে থাকবেন। এমন ভান ধরবেন যে আসলেই মন্ত্র পড়ে তুলে ফেলবেন। আসলে মন্ত্রপড়ার সময় খুব তড়িৎগতিতে বরফখন্ডে কিছুটা লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে। সেই লবণ মাখানো বরফ খণ্ডে সুতো আলতো করে ধরলেই বরফের সাথে সুতো আটকে যাবে। ফলে সহজেই সুতো দিয়ে বরফখণ্ড তুলা যাবে।
ভাসমান সুঁচ
টেবিলের উপর পানিভর্তি একটি বাটি ও তার পাশে ২ টি সুঁচ থাকবে। যাদুকর দর্শকদের সুঁচ দুইটি দেখালেন। একটি সুঁচ পানিতে ফেলে দেয়ার সাথে সাথে ডুবে গেল। অন্য সুঁচ পানিতে ফেলে দিলে দেখা গেল সেটি ডুবে না গিয়ে ভেসে আছে! দর্শকদের আক্কেল গুড়ুম!
*কৌশল: পানিভর্তি একটি বাটি, ২ টা সুঁচ ও অল্প পরিমাণ মোম উপকরণ হিসেবে রাখতে হবে।
দুটি সুঁচের একটিতে মোমের কাটিং দেয়া থাকবে। যে সুঁচটিতে মোমের কাটিং দেয়া থাকবে সেটি ডুবে না গিয়ে ভেসে থাকবে। এই হচ্ছে ভাসমান সুঁচের কৌশল।
আগুন খাওয়ার যাদু
টেবিলে আপেল, কমলা, আঙুর ইত্যাদি বাহারি ফল সাজানো আছে। যাদুকর ফলের স্তুপে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। এবার যাদুকর কাঁটাচামচ দিয়ে নিশ্চিন্ত জ্বলন্ত ফলের টুকরো আয়েশ করে খেতে লাগলেন!
*উপকরণ : কিছু টুকরো ফলের অংশ, কাঁটাচামচ আর কিছুটা ইথাইল এলকোহল।
* কৌশল: কাটা ফলের টুকরোয় আগে থেকেই কিছুটা ইথাইল এলকোহল ছড়িয়ে রাখতে হবে। পরবর্তীতে আগুনের ছোঁয়া পেলেই ফলের টুকরোয় আগুন ধরে যাবে। এই আগুন দেখতে ভয়াবহ হলেও প্রকৃত অর্থে ফলের টুকরোগুলো তেমন গরম হয়না। কাঁটাচামচ দিয়ে ফলের টুকরো মুখের কাছে এনে প্রশ্বাসের মাধ্যমে আগুন নিভিয়ে ফেলে সাথে সাথে খেয়ে ফেলতে হবে। অভ্যাস থাকলে সামান্য গরম গায়ে লাগবে না। ব্যস হয়ে গেল আরেকটি সহজ ম্যাজিক!
তথসূত্র: যাদু রহস্য, তপন চৌধুরী
mazmin.com 24|06|17