ঈশ্বরের আপন দেশ তকমা নিয়ে ভারতের আলাদা প্রদেশ হিসেবে মানচিত্রে দক্ষিণ-পশ্চিমে ১৯৫৬ সাল থেকে আজ অবধি সুগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে শিল্প সংস্কৃতি আর জৌলুসের রাজ্য কেরালা। ইতিহাস আর গাম্ভীর্যে রাজ্যটি আলাদা হয়ে আছে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে।

বছরের প্রতি সেপ্টেম্বর কেরালায় বয়ে যায় আনন্দের হিল্লোল। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই বুঁদ হয়ে থাকে নাচগান আর আনন্দ উৎসবে, ঘরে ঘরে আয়োজন করা হয় বাহারি রঙের খাবার, তরুণ-তরুণীরা গায়ে জড়ায় এক বিশেষ ধরণের পোশাক। ২৬ পদের রান্না করে আয়োজন করা হয় মহাভোজের। সামর্থ্যবান ও সামর্থ্যহীন যে যেভাবে পারে প্রদর্শন করে তাদের সামর্থ্যের মাত্রা, যেন কোন কার্পণ্য থাকা চলবে না। উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। গ্রাম থেকে মফস্বলে, মফস্বল থেকে শহরে উৎসবের আমেজ যেন শেষ হতে চায় না। টানা দশদিন ধরে চলা এ উৎসবের নাম ‘ওনাম’।
ওনাম উৎসবের প্রেক্ষাপটের সাথে জড়িয়ে আছে এক চমৎকার লৌকিক উপাখ্যান। আজকের লেখায় আমরা জানব উপাখ্যানের নায়ক অসুররাজ মহাবলী এবং তার ত্যাগের মাধ্যমে ওনাম উৎসবের সূচনাপর্ব।
অসুররাজ মহাবলী ও ঈশ্বরের হিংসা
অসুরদের সম্পর্কে মন্দ ও দূরাচারত্ব নিয়ে মানুষের ধারণাকে পাল্টে দিতে স্বয়ং ঈশ্বর মহাবলীকে পাতাল থেকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। পৃথিবীতে এসে মহাবলী রাজা হয়ে কেরালায় তার শাসনভার গ্রহণ করেন। তার ন্যায়পরায়ণতা, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ত্যাগী বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। মহাবলীর শাসন তার এলাকায় এনে দিয়েছিল শান্তি ও সমৃদ্ধি। অসুর রাজা মহাবলীর সুনাম দিনকে দিন বাড়ছিল। তার শাসনে জনসাধারণ স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করতে পেরেছিল। অসুর মহাবলীর শক্তি ও ঔদার্যতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে ঈশ্বর শংকিত হয়ে পড়েন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে করেই হোক মহাবলীকে দমন করতে হবে। কারণ মহাবলীর ধারাবাহিক মহত্ত্ব ও ঔদার্য্যে মানুষ ঈশ্বরকে ভুলতে শুরু করে। ঈশ্বর মনস্থির করলেন, তিনি মহাবিষ্ণুর কাছে সাহায্য চাইবেন, যাতে করে মহাবলীর একটা ব্যবস্থা হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। ঈশ্বর ধর্না দিলেন মহাবিষ্ণুর কাছে। আর্জি পেশ করলেন মহাবিষ্ণু সমীপে,
“অসুররাজ মহাবলীর ক্ষমতা কমিয়ে দিতে হবে অথবা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে”। দুষ্ট অসুরদের উচিত শিক্ষা দিতে মহাবিষ্ণু যুগে যুগে কাজ করে গেছেন। ঈশ্বরের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না। হাজার হোক ঈশ্বর বলে কথা!
ভামানা দেবতার আগমন ও মহাবলী বধ
প্রভু মহাবিষ্ণু ‘ভামানা’ (চতুর্থ দেবতা) নাম নিয়ে বালকের ছদ্মবেশে মহাবলীর দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। রাজার কাছে বরপ্রাপ্ত হয়ে ভামানা একটি আবদার করে বসেন। তার আবদার ছিল রাজা মহাবলী যাতে তাকে মাত্র তিন পদক্ষেপে যাওয়া যায় এমন পরিমাপ জমি উপহার হিসেবে দেন। মহান রাজা ভাবলেন এ আর এমন কি! সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলেন। এখানেই ফেঁসে যান অসুররাজ মহাবলী।
পরবর্তীতে ভামানা নামধারী ঐ বালক উচ্চতায় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তার প্রথম পদক্ষেপে ১৪ ভুবন ছেয়ে যায়, দ্বিতীয় পদক্ষেপ আকাশ ছেয়ে ফেলে। অবশিষ্ট পদক্ষেপ নিলেই পৃথিবী হয়ে যাবে ধ্বংস! মহাবলী সবকিছু বুঝতে পেরে ভামানাকে অনুরোধ করেন যাতে সে তার তৃতীয় পদক্ষেপ তার মাথায় ফেলে দেয়। পদক্ষেপ যদি মাথায় ফেলে তবে এ যাত্রা পৃথিবী রক্ষা পাবে। এভাবে ভামানার তৃতীয় পদক্ষেপে মহাবলী প্রেতলোকে পতিত থেকে যায়। তার তৃতীয় পদক্ষেপ প্রেতলোকে পতিত হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ভামানা, রাজা মহাবলীকে একটি বর উপহার দিয়ে যান, যাতে রাজা প্রতিবছর একবার ভামানার সাথে দেখা করতে পারেন। প্রতি বছর অসুররাজ মহাবলীর এ দেখার আনুষ্ঠানিক উৎসবই হল কেরালার ওনাম উৎসবের নেপথ্যের কাহিনী। এ সময়ে রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এসে উৎসবে যোগ দিয়ে তার প্রিয় প্রজাদের খোঁজখবর নিয়ে যান।
তথ্যসূত্র : কেরালা সৌন্দর্যের দেবী, ড. প্রভাস চন্দ্র রায়।